ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অংশীদারি সংলাপ শেষে জানালেন টমাস শ্যানন

মিয়ানমারকে শাস্তি নয় সঙ্কটের কূটনৈতিক সমাধান চায় যুক্তরাষ্ট্র

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৬ নভেম্বর ২০১৭

মিয়ানমারকে শাস্তি নয় সঙ্কটের কূটনৈতিক সমাধান চায় যুক্তরাষ্ট্র

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এখনই কোন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার চেয়ে চলমান রোহিঙ্গা সঙ্কটের কূটনৈতিক সমাধানের পথেই আগ্রহ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে যুক্তরাষ্ট্র একত্রিশটি পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানিয়েছে। এদিকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে রাখাইনে সহিংসতা বন্ধের দাবি জানালেও রোহিঙ্গা আসা অব্যাহত রয়েছে বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবহিত করেছে বাংলাদেশ। রবিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র অংশীদারি সংলাপে এসব আলোচনা হয়। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র ষষ্ঠ অংশীদারি সংলাপ শেষে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ও মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যানন। সংবাদ সম্মেলনে শ্যানন বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কটের কূটনৈতিক সমাধানেই জোর দিচ্ছে তার দেশ। সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে শ্যানন বলেন, এই মুহূর্তে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নয়, আমাদের সমস্যার সমাধান করতে হবে। মিয়ানমারের ওপর অবরোধের সুযোগ তো রয়েছেই জানিয়ে সংবাদ সম্মেলনে শ্যানন বলেন, কিন্তু আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সমস্যার সমাধান করা এবং এই সঙ্কটের কূটনৈতিক সমাধান খোঁজা। মিয়ানমার থেকে পালিয়ে যারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের মানবিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টিও তাদের অন্যতম লক্ষ্য বলে জানান শ্যানন। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে কাজ করছে সেজন্য ধন্যবাদ জানান পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান শক্ত বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) মানবিক সহায়তা দিচ্ছে এবং সঙ্কট সমাধানে অন্তত ৩১ পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেয়া এসব পদক্ষেপ সঙ্কট সমাধানে কি ধরনের প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে, জানতে চাইলে শ্যানন বলেন, এসব পদক্ষেপের কারণে সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য তাদের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারে ঢোকার সুযোগ পেয়েছে। রাখাইন রাজ্য পরিদর্শনের অনুমতিও পাওয়া গেছে। শ্যানন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ অংশীদারি সংলাপের জন্য আবার ঢাকায় আসতে পেরে আমি আনন্দিত। আমি দ্বিতীয়বার অংশীদারি সংলাপে অংশগ্রহণ করছি এবং ষষ্ঠবারের মতো আমরা এই সংলাপের আয়োজন করছি। এই বার্ষিক সংলাপ আমাদের উর্ধতন কর্মকর্তাদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ দুই দেশের প্রয়োজনীয় বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার। তিনি বলেন, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক এবং আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনা করেছি, যার মধ্যে রয়েছে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে নিরাপত্তা, আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, উত্তর কোরিয়ার আচরণে আমাদের মনোভাব এবং বর্তমান রোহিঙ্গা শরণার্থী সঙ্কট। এই সংলাপ প্রমাণ করে, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে একত্রে কাজ করছে এবং অংশীদারিত্বের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এছাড়াও সহিষ্ণু, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার দূরদৃষ্টি রয়েছে যা বাণিজ্যিক সেতু হিসেবে দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জন্য কাজ করছে। শ্যানন বলেন, বাংলাদেশ এই অঞ্চলে স্থায়িত্ব এবং সমৃদ্ধির স্তম্ভ এবং একটি মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতি সরকারের প্রতিশ্রুতি আমরা প্রশংসা করি। মাত্র গত মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী টিলারসন এই বিষয় সংক্রান্ত নীতি নিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। তার (টিলারসন) দেয়া ভারত মহাসাগর অঞ্চলের সেসব নীতি ও আদর্শ ভিত্তি করে হয়েছে, যেমন দায়িত্বশীল প্রবৃদ্ধি এবং সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এই প্রচেষ্টায় বাংলাদেশের মতো অংশীদার পেয়ে আমরা আনন্দিত। তিনি আরও বলেন, পররাষ্ট্র সচিব হক এবং আমি মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তে চলমান মানবাধিকার সঙ্কট নিয়ে অনেকক্ষণ আলোচনা করেছি। উত্তর রাখাইনে হওয়া নৃশংসতার মাত্রা নিয়ে আমি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্বেগ পুনর্ব্যক্ত করেছি যার মধ্যে রয়েছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প, ভাইস প্রেসিডেন্ট পেন্স এবং সেক্রেটারি টিলারসন। পাশাপাশি ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ৬ লাখের বেশি রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য বাংলাদেশ সরকারের উদারতায় আমরা প্রশংসা জানাই। ঢাকা-ওয়াশিংটন সংলাপের বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, সংলাপে উভয়পক্ষই দ্বিপক্ষীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের বিষয়ে আলোচনায় তোলা হয়। এছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও মানবিক সমর্থনকে প্রশংসা করা হয়। আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, মিয়ানমার সাইড থেকে বলা হচ্ছে রাখাইনে সহিংসতা বন্ধ হয়েছে। তবে তাদের এই বক্তব্যের পরও মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের আসা অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জাতিসংঘের ৭২তম অধিবেশনে দেয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৫ দফা প্রস্তাবের বিষয়েও আলোচনায় তুলে ধরা হয়। সংলাপে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে তিনটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের জন্য প্রস্তাব করেছে বাংলাদেশ। কৃষি, শিক্ষা ও ফরেন সার্ভিস একাডেমির মধ্যে অভিজ্ঞতা বিনিময় সংক্রান্ত এই তিনটি প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। সংলাপে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক। আর যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যানন। মার্কিন প্রতিনিধি দলে পররাষ্ট্র দফতরের সহকারী সেক্রেটারি সিমন হেনশো, গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও শ্রমবিষয়ক উপসহকারী সেক্রেটারি স্কট বাসবি, দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত উপসহকারী সেক্রেটারি টম ভাজদা, এশিয়া বিষয়ক দফতরের পরিচালক প্যাট্রিসিয়া ম্যাহোনি ও ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট উপস্থিত ছিলেন। উন্নয়ন ও সুশাসন, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ এবং নিরাপত্তা সহযোগিতাসহ বিশদ দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক বিষয়াদি বিস্তৃত পরিসরে ও গভীরভাবে আলোচনার জন্য অংশীদারিত্ব সংলাপটি সর্বোচ্চ ফোরাম। তবে এবার আলোচনার বড় একটা অংশজুড়েই ছিল রোহিঙ্গা সঙ্কট। আগামী বছর সপ্তম অংশীদারি সংলাপ ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ৫ম অংশীদারি সংলাপ গত বছর ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয়। সেই বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দেন পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক। তার আগে ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রথম সংলাপ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত হয়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের ঢাকা সফরে অংশীদারি সংলাপের বিষয়ে এক চুক্তি সই হয়। তারপর থেকে প্রতিবছর একবার ঢাকা পরের বার ওয়াশিংটনে এই সংলাপের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ষষ্ঠ অংশীদারি সংলাপে যোগ দিতে রবিবার সকালে ঢাকায় আসেন মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি টমাস শ্যানন। ঢাকা ত্যাগের আগের রবিবার সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্র মন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গেও সাক্ষাত করেন তিনি। এছাড়া রবিবার সকালে কয়েকটি গণমাধ্যমের সম্পাদকের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি। আজ সোমবার ভোরে শ্যানন শ্রীলঙ্কার উদ্দেশে রওনা দেবেন। সোমবার ওয়াশিংটন-কলম্বোর মধ্যে অনুষ্ঠেয় অংশীদারি সংলাপে অংশ নেবেন তিনি। উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে গত ২৫ আগস্টের পর থেকে ছয় লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আগে থেকেই চার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে রয়েছে। বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। সে কারণে এই সংলাপে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়েই আলোচনা প্রাধান্য পায়।
×