ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মণিপুরী রাসলীলা উৎসব

যে দেখেনি রাস মেটেনি তার আশ হাজারো মানুষের মহামিলন

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ৬ নভেম্বর ২০১৭

যে দেখেনি রাস মেটেনি তার আশ হাজারো মানুষের মহামিলন

সৈয়দ হুমায়েদ শাহীন ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ’ মৌলভীবাজার জেলার ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অন্যতম বিশ্বনন্দিত সংস্কৃতির ধারক মণিপুরী সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব দুদিনের ‘মণিপুরী রাসলীলা’ গত শনিবার ৪ নবেম্বর দুপুর থেকে শুরু হয়ে রবিবার সকাল পর্যন্ত চলে। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও কার্তিকের পূর্ণিমা তিথিতে মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর জোড়াম-প ও আদমপুর সানাঠাকুর মন্ডপে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। আর এ উৎসবকে সামনে রেখে পুরো মণিপুরী জাতি যেন জেগে ওঠে নব উদ্যমে। তাদের ধারণা এ থেকে বিগত বছরের সকল গ্লানি দূর হয়ে একের প্রতি অন্যের প্রেম জাগ্রত হয়। প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও এখানে মহাসমারোহে পালিত হলো ১৭৫তম মহা রাস উৎসব, যা পরিণত হয়েছিল ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার মানুষের মহামিলনে। কথায় আছে ‘যে দেখেনি রাস মেটেনি তার আশ’ অর্থাৎ রাসলীলা দর্শনে মনের আশা পূর্ণ হয়। মনে জাগ্রত হয় কৃষ্ণ প্রেম। যুগ যুগ ধরে এই বিশ্বাস নিয়ে মণিপুরীরা তা পালন করে আসছে। মণিপুরের রাজা মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তার মেয়ে চিত্রাঙ্গদাকে নিয়ে প্রথম শুরু করেছিলেন এ রাসলীলা। তাকে অনুসরণ করে ১৮৪২ সালে এ এলাকায় মণিপুরীরা কমলগঞ্জ মাধবপুর জোড়াম-পে রাসলীলার আয়োজন করেন, যা বিগত ১৭৫ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। রাতভর রাধাকৃষ্ণের প্রণয়োপখ্যানের সে রাসলীলা উপভোগ করতে সারাদেশ থেকে ছুটে আসে হাজারো নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী পর্যটকসহ নানা শ্রেণী পেশার মানুষ। বর্ণাঢ্য এ আয়োজন ও কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ৪ নবেম্বর শনিবার রাতে কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর ও আদমপুরে সাড়ম্বরে অনুষ্ঠিত হয় মণিপুরী সম্প্রদায়ের প্রধানতম ধর্মীয় উৎসব মহারাসলীলা। রাসোৎসব উপলক্ষে উভয় স্থানে বসে মেলা। রাসোৎসবের আয়োজন দুই জায়গাতে হলেও বার্তা একই ছিল বিশ্বশান্তি, সম্প্রীতি ও মানবপ্রেম। রাসোৎসবকে কেন্দ্র করে কমলগঞ্জের মণিপুরী অধ্যুষিত গ্রামগুলোর ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ চলে কয়েক দিন আগে থেকে। পাড়ায় পাড়ায় গত কয়েক দিন ধরে চলে রাসনৃত্য ও রাখালনৃত্যের মহড়া। কমলগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী মণিপুরী মহারাসলীলাকে কেন্দ্র করে গোটা কমলগঞ্জ উপজেলা উৎসবে পরিণত হয়। বিভিন্ন শ্রেণী ও জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ সমবেত হন। তাদের পদচারণায় দিনরাত অপূর্ব এক মিলনমেলায় পরিণত হয় মাধবপুরের জোড়ামন্ডপ প্রাঙ্গণ এবং আদমপুর সানাঠাকুর মন্ডপ। কমলগঞ্জ উপজেলার মাধবপুর (শিববাজার) জোড়াম-প প্রাঙ্গণে মণিপুরী মহারাসলীলা সেবা সংঘের উদ্যোগে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা ১৭৫তম বার্ষিকী এবং আদমপুর ইউনিয়নের তেঁতইগাঁও সানাঠাকুর মন্ডপ প্রাঙ্গণে রাসোৎসব উদযাপন কমিটির উদ্যোগে মণিপুরী মী-তৈ সম্প্রদায়ের লোকজন ৩২তম মহারাস উৎসব উদযাপন করে। মণিপুরী সম্প্রদায়ের লোকজনের পাশাপাশি অন্যান্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে হাজার হাজার লোকজন মেতে উঠে আনন্দ উৎসবে। মহারাত্রির আনন্দের পরশ পেতে আসা হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর, কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, দেশী-বিদেশী পর্যটক, বরেণ্য জ্ঞানী-গুণী লোকজনসহ প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে গোটা উৎসব অঙ্গন। মণিপুরী সম্প্রদায়ের পূণ্যস্থান হিসেবে বিবেচিত মাধবপুর ও আদমপুরে রাসোৎসবের জন্য তৈরি সাদা কাগজের নক্সায় সজ্জিত ম-পগুলো এই একটি রাত্রির জন্য হয়ে ওঠে লাখো মানুষের মিলনতীর্থ। মণিপুরী শিশু নৃত্যশিল্পীদের সুনিপুণ নৃত্যাভিনয় রাতভর মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে ভক্ত ও দর্শনার্থীদের।
×