ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পাতালের পানির স্তর দ্রুত নামছে

প্রকাশিত: ০৩:১৪, ৬ নভেম্বর ২০১৭

পাতালের পানির স্তর দ্রুত নামছে

সমুদ্র হক ॥ গত চল্লিশ বছরে দেশে পাতালের (ভূতল বা ভূগর্ভস্থ) পানি ব্যবহার বেড়েছে অন্তত শতভাগ। এখন সুপেয় ও চাষাবাদের সেচের জন্য পানির ৮০ শতাংশ মেটাতে হয় পাতালের উৎস থেকে। অপরিকল্পিতভাবে গভীর ও অগভীর নলকূপ বসিয়ে পানি উত্তোলনের ফলে পাতালের পানি আশঙ্কাজনক হারে নিচে নামছে। পাতালের পানি অপচয় রোধে সেচযন্ত্র স্থাপনে ‘সমন্বিত ক্ষুদ্র সেচ নীতিমালা ২০১৭’র খসড়া মন্ত্রিসভা বিভাগ থেকে অনুমোদন পেয়েছে। আরেকদিকে ভূপরিস্থ পানি (সারফেস ওয়াটার) ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে। সাধারণত শুষ্ক মৌসুমে বোরো আবাদের সময় সেচের জন্য গভীর ও অগভীর নলকূপে পানি উত্তোলন বেড়ে যায়। এই পানি উত্তোলন করা হয় পাতাল থেকে। বোরো আবাদটি সম্পূর্ণ সেচনির্ভর। ষাটের দশকের শেষে দেশে পাতালের পানির সেচ দিয়ে ইন্টারন্যাশনাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইরি) ধানের আবাদ শুরু হয়। এই আবাদ বেড়ে গেলে তা সেচনির্ভর বোরো মৌসুমে পরিণত হয়। বর্তমান পরিচিতি বোরো ধান। অধিক উৎপাদনের এই বোরো খাদ্য চাহিদা মিটিয়ে বর্তমানে রফতানিমুখী হয়েছে। সত্তর দশকের মধ্যভাগে দেশে প্রথম কোরিয়ানরা এসে গভীর নলকূপ বসায়। তারপর ব্রিটেনের ম্যাকডোনাল্ড এ্যান্ড পার্টনার গভীর ও অগভীর উভয় ধরনের নলকূপ বসাতে থাকে। গভীর নলপূপের ইংরেজী ‘ডীপ টিউবওয়েল’ নামটি পারচিতি পায়। অগভীর নলকূপ পরিচতি পায় শ্যালো টিউবওয়েল নামে। কৃষক ডীপ ও শ্যালো যন্ত্রে পানি উত্তোলন করতে থাকে। গভীর ও অগভীর কোন টিউবওয়েলই দূরত্বের নিয়ম মেনে বসানো হয়নি। যার ফলে দিনে দিনে পাতালের পানি নিচে নামতে থাকে। দেশে বর্তমানে অন্তত ৫০ লাখ গভীর, অগভীর ও অন্যান্য নলকূপ ব্যবহার হচ্ছে। শুকনো মৌসুমে পাতালের পানির স্তর নিচে নেমে গেলে অন্তত ৬ লাখ নলকূপ অকেজো থাকে। অনেক নলকূপের পানি উত্তোলনের জন্য শ্যালো ইঞ্জিন মাটি খুঁড়ে ৫ থেকে ৭ ফুট নিচে নামাতে হয়। সত্তরের দশকের মধ্যেভাগে অগভীর নলকূপের পানি পাতালে ৫০ ফুট (প্রায় ১৭ মিটার) নিচে মিলত। বর্তমানে অগভীর নলকূপের পানি পেতে ড্রিলিং করে এলাকাভেদে পাতালের দেড় শ’ থেকে ২শ’ ফুট (৫০ থেকে ৭০ মিটার) নিচে যেতে হয়। অগভীর নলকূপ বা শ্যালো ইঞ্জিনের সেচে পানি মেলে ৩০ থেকে ৩৫ ফুট (১০ থেকে ১২ মিটার) নিচে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে মৌসুমী বৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা ঢলে পানির যে রিচার্জ হচ্ছে তা পাতালের পানি উত্তোলনের চেয়ে কম। সুপেয় পানির জন্য পাতালের অনেকটা নিচে যেতে হচ্ছে। এক সূত্র জানায়, মহানগরী ঢাকায় পানির স্তর সমুদ্রপৃষ্ঠের ১শ’ ৬০ ফুট নিচে নেমে গেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ঢাকার ভূস্তরের উচ্চতা ৫০ ফুট। হিসাব করে নিন ঢাকায় পাতালের পানি কত গভীরে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) এক সূত্র জানায়, শুকনো মৌসুমের আবাদে সেচের ৮০ শতাংশ পানি সংগ্রহ করা হয় পাতালের উৎস থেকে। বাকি ২০ শতাংশ পানি মেলে ভূপরিস্থ (সারফেস) থেকে। বিএডিসির গ্রাউন্ড ওয়াটার জোনিং ম্যাপ অনুযায়ী দেশের ৩২ জেলার পাতালের পানির স্তর প্রতিবছর একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় নিচে নেমে যাচ্ছে। যার মধ্যে উত্তরাঞ্চলের জেলা বেশি। পদ্মা, ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা অববাহিকা বিস্তৃত দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পাতালের পানির স্তর নিত্য বছর ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার হারে নিচে নেমে যাচ্ছে। একজন পানি বিশেষজ্ঞ জানান, কৃষিতে যন্ত্রশৈলী প্রবেশের পর বর্তমান সময় পর্যন্ত আধুনিক কৃষিতে পাতালের পানি ব্যবহার অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। এই ব্যবহার আর সীমিত করা যায়নি। সমন্বিত ক্ষুদ্র সেচ নীতিমালার যে খসড়া অনুমোদন করা হয়েছে তাতে বলা হয়, পাতালের পানির ব্যবহার এবং সেচ কার্যক্রম তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সেচ কমিটি গঠন করা হবে। একই সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে জেলা পর্যায়ে জেলা প্রশাসক ও বিএডিসির নির্বাহী প্রকৌশলীসহ ১৬ জনের কমিটি এবং উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা চেয়ারম্যানসহ ১৬ জনের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এদিকে পাতালের পানির ওপর চাপ কমাতে ভূপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। সূত্র জানায়, প্রায় ৯০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘বৃহত্তর বগুড়া-দিনাজপুর জেলা ক্ষুদ্র সেচ উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রকল্প সারপত্র তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্প প্রস্তাবটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির বৈঠকে (একনেক) উপস্থাপনার জন্য চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে খাল-নালা পুনর্খনন ও অন্য সব অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে অন্তত ২০ হাজার হেক্টর জমিতে ভূপরিস্থ পানির সেচ দেয়া যাবে। এতে পাতালের পানি ব্যবহার কিছুটা হলেও কমবে।
×