ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ড. মিহির কুমার রায়

চিকিৎসা সেবা নিয়ে কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৩:০৬, ৬ নভেম্বর ২০১৭

চিকিৎসা সেবা নিয়ে কিছু কথা

সম্প্রতি কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুরে এক বেসরকারী হাসপাতালের রোগিণীর বাচ্চা প্রসবের ঘটনা; প্রথমটির বিবরণে প্রকাশ এক রোগিণী বাচ্চা প্রসবের নিমিত্তে এলাকার একটি বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হয় এবং চিকিৎসক নির্ধারিত তারিখে রোগিণীর অপারেশন সম্পন্ন করে একটি বাচ্চা প্রসব করিয়ে রোগিণীকে যথারীতি অব্যাহতি দিয়ে দেন কিন্তু রোগিণীর পেটে গোলাকার বৃত্তাকার একটা কিছুর অনুভব হলে রোগিণী আবার সেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তিনি টিউমার শনাক্ত করে রোগিণীকে বিদায় করে দেন। কিন্তু রোগিণী ক্রমাগতভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে প্রায় এক মাস পর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি করা হয়। সেই হাসপাতালের চিকিৎসক পরীক্ষা করে রোগিণীর পেটে আরও একটি বাচ্চার অস্তিত্ব খুঁজে পান। এরই মধ্যে বাচ্চাটির মৃত্যু হয় এবং সে অবস্থাতেই অস্ত্রোপচার করে বাচ্চা প্রসব করা হয়। এখন প্রশ্ন দাঁড়ায় চিকিৎসকের অদক্ষতা তথা অবহেলায় রোগীটির জীবন-মরণের সন্ধিক্ষণ ও যমজ বাচ্চা শনাক্তকরণের ব্যর্থতা। বিষয়টি নিয়ে এলাকায় বিপুল সাড়া পড়ে যায় এবং প্রশাসন, স্থানীয় নেতৃত্ব, জন প্রতিনিধিগণ এর বিচার বিভাগীয় তদন্ত তথা চিকিৎসকের বিচার দাবি করেন। এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সেই চিকিৎসকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ প্রদান করে, যা একটি গতানুগতিক প্রক্রিয়া এবং সাংবাদিকের ভাষ্য দোষী চিকিৎসকের আর কিছু হবে না এবং এভাবেই এ সকল দোষী ব্যক্তি পাড় পেয়ে যাচ্ছে প্রশাসনের সহযোগিতায়। অথচ একই চিকিৎসকের অবহেলাজনিত কারণে বাচ্চার মৃত্যু তথা ক্ষতিগ্রস্ত রোগিণীর কাজটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ বিধায় ফৌজদারি আইনে চিকিৎসককে গ্রেফতার করে আদালতে প্রেরণ করা যেত। কিন্তু বাস্তবে কিছুই হয়নি। চিকিৎসক কর্তৃক রোগিণী নিগ্রহ তথা শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় পাওয়া যায়, যা এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার একটি কুৎসিত রূপ। এ তো গেল মফস্বলের ঘটনা। খোদ ঢাকা শহরের একটি নামকরা ক্লিনিকে হার্টের চিকিৎসার জন্য রোগী যথাসময়ে চিকিৎসকের কাছে যান। রোগী দেখার চিকিৎসা ফি এক হাজার টাকা। সিরিয়াল অনুসারে রোগীর নাম ডাকা হলো এবং চেম্বারের ভেতরে গিয়ে তিনি দেখলেন চিকিৎসক ফেসবুকে গেম খেলছেন। কিছুক্ষণ পর রোগী চিকিৎসকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইলে তিনি রোগীর দিকে দৃষ্টি ফেরান এবং সার্বিক বিষয়টি জানতে চান। নির্দিষ্ট সময়ে কথোপকথন শেষ হলে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্র দিয়ে রোগীকে বিদায় করে দেন। সেই নির্ধারিত রোগী ওষুধ ক্রয়ের জন্য নির্ধারিত দোকানে গেলে সেখানকার বিক্রেতা এই ওষুধ নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে বসে এই বলে যে এসব ওষুধের ব্যবস্থাপত্র সঠিক হয়নি। এই কথা শুনে রোগী আবার নির্ধারিত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং সার্বিক বিষয়টির বিবরণ দেন। তখন সেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আবার তার প্রদেয় ব্যবস্থাপত্রে পরিবর্তন করে আবার নতুন ওষুধ ব্যবস্থাপত্রে সংযোজন করেন। এই অবস্থায় রোগীর মনে সন্দেহ দেখা দেয়ায় এই ব্যবস্থাপত্রের কোন ওষুধই তিনি ক্রয় করেননি এবং সেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের প্রতি তার শ্রদ্ধাবোধ হারিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন আমরা এখন কোথায় যাব? আরেক রোগী কানের রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশের এক নামকরা চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হয়ে তার চেম্বারে যান বিকেল ৪টায়। কিন্তু চিকিৎসক তার চেম্বারে প্রবেশ করেন রাত ৮টায়। এরই মধ্যে রোগীদের অস্বস্তি ছড়িয়ে পড়ে এবং নির্ধারিত রোগী চিকিৎসকের চেম্বারে প্রবেশ করে রাত ৯টায়। যেখানে রোগী তার অবস্থা নিয়ে মাত্র তিন মিনিট কথা বলার সুযোগ পান এবং এই চিকিসকের প্রতি আস্থা বা ভরসা করতে পারেননি। কিন্তু কেন এমন হবে? সম্প্রতি ঢাকার আজিমপুরের সরকারী মাতৃমঙ্গল কেন্দ্রে এক দরিদ্র মহিলা সন্তান প্রসবের জন্য ভর্তি হতে এলে টাকা না দেয়ার কারণে তাকে সেখানকার আয়া/সেবিকারা ঘর থেকে বের করে দেয়। পরবর্তীতে ক্লিনিকের বারান্দায় রোগিণী একটি বাচ্চা প্রসব করেন এবং ক্লিনিকের সকল রোগীরা একসঙ্গে জড়ো হয়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানান। বিষয়টি মিডিয়াতে এলে তখন এই সরকারী ক্লিনিকের তত্ত্বাবধায়ককে (মহিলা চিকিৎসক) ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন দোষীদের ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এখন প্রশ্ন হলো, কেন আয়া কিংবা সেবিকানির্ভর চিকিৎসালয় যা অত্যন্ত বেদনাদায়ক যার কারণে দরিদ্র রোগীরা সরকারী হাসপাতালে কোন সেবা পায় না। বাংলাদেশে চিকিৎসাসেবা মানবিকতার ভিত্তিতে এখনও সামাজিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে ওঠেনি যা ভারতে অনেক আগেই শুরু হয়ে অনেক সফলতার স্বাক্ষর বহন করেছে। এখানে উল্লেখ্য, পশ্চিম বাংলায় সরকারী চিকিৎসকগণের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের কোন সুযোগ নেই এবং বেসরকারী খাতে কোন প্রকার মেডিক্যাল কলেজেও নেই, যা বাংলাদেশে রয়েছে। যার ফলে সেখানে মানসম্মত চিকিৎসক তৈরি হচ্ছে, যা মানবিকতা তথা নৈতিকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। অপরদিকে বাংলাদেশে মেডিক্যাল শিক্ষা বিদেশে স্বীকৃত নয় মানের মানদন্ডের বিচারে। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক নয় যে আমরা কি মানসম্মত চিকিৎসা শিক্ষা চাই কিংবা চিকিৎসাসেবা চাই? এই প্রশ্নটি নিয়ে আমাদের ভাবনার এখনই প্রকৃষ্ট সময়। কারণ দুই হাজার একুশ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে এক অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক কল্যাণ রাষ্ট্র বিনির্মাণে বর্তমান সরকার রূপকল্প (ভিশন ২০২১) অনুযায়ী স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য দৈনিক ন্যূনতম ২১২২ কিলো. ক্যালরির উর্ধে খাদ্যের সংস্থান, সর্বপ্রকার ব্যাধি নির্মূলকরণ, সকলের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ, গড় আয়ু ৭০ বছরে উন্নীতকরণ, মাতৃ মৃত্যুর হার হ্রাসকরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। এরই মধ্যে স্বাস্থ্যখাতে সরকারের অনেক সাফল্য রয়েছে যেমন দেশব্যাপী স্বাস্থ্য পরিচর্যা তথা অবকাঠামো নির্মাণ, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের হ্রাস, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, চিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণায় মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, শিশু ও মাতৃ মৃত্যুর হার কমানো ইত্যাদি। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথমত- স্বাস্থ্যনীতিতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, যা হবে মানবিক, নৈতিক, ব্যয়সাশ্রয়ী ও সমাজমুখী। যদিও কাজটি কঠিন তবুও সম্ভব। এ ব্যাপারে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকারের প্রতিশ্রুতি জরুরী। আশির দশকের মাঝামাঝি দেশে স্বাস্থ্যনীতিতে আমূল পরিবর্তনের এক উদ্যোগ নিয়েছিলেন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল সরকারী চিকিৎসকদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ। তখনকার সরকার সমর্থন দিলেও বিএমএর আন্দোলনের মুখে তা আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়ে উঠেনি; দ্বিতীয়ত- চিকিৎসকদের প্রশাসনিক কাঠামোতে অমানবিক বা অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পরার চিত্রগুলো বন্ধ করতে হবে যেমন চিকিৎসক-হাসপাতাল-ওষুধ কোম্পানির মধ্যে যে লেনদেন স্বার্থ স্বাস্থ্যখাতে গড়ে উঠেছে তা থেকে বাঁচার একমাত্র পথ হলো প্রশাসনিকভাবে বিষয়টিকে মোকাবেলা করা অর্থাৎ উপজেলা পর্যায়ে টিএইচএ, জেলা পর্যায়ে সিভিল সার্জন ও জাতীয় পর্যায়ে মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদফতর বিষয়টির ব্যাপারে তদারকি ব্যবস্থা (সড়হরঃড়ৎরহম) জোরদার করবে এবং সরকারের ওষুধ প্রশাসন দফতরে এ ব্যাপারে নজরদারি বাড়াবে। তৃতীয়ত- চিকিৎসকদের নৈতিকতা (ethics) বা মানবিকতা যাচাইয়ের কোন নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ দেশে আছে বলে মনে হয় না, অথচ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে রয়েছে। ফলে চিকিৎসা পেশা এক অনৈতিক অসম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন আর এ কারণে প্রতিনিয়তই বলি হচ্ছে রোগীরা এবং প্রতারিত হচ্ছে গোটা সমাজ। এর একটি স্থায়ী সমাধান জরুরী। এর জন্য প্রয়োজন শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ। প্রায়শই শোনা যায় চিকিৎসক দ্বারা রোগী লাঞ্ছিত কিংবা রোগীর লোকজন দ্বারা চিকিৎসক লাঞ্ছিত যা খুবই অনাকাক্সিক্ষত। চতুর্থত- বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক হেলথ সার্ভের তথ্য মতে, বর্তমানে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে শতকরা ২৩ ভাগ বাচ্চা প্রসবজনিত অপারেশন হয় এবং শতকরা ৭৭ ভাগ হয় বেসরকারী ক্লিনিকে যা টাকার অঙ্কে রোগীর ওপর এক আর্থিক চাপ অথচ এটি সম্পূর্ণ উল্টোও হতে পারত। কিন্তু তা হয়ে উঠছে না কারণ এ সকল বেসরকারী ক্লিনিক সরকারী চিকিৎসকের নিজের বা তার নিকটতম আত্মীয় দ্বারা পরিচালিত। এই ক্লিনিক ব্যবসা কিংবা রোগ নির্ণয় কেন্দ্র (diagnostic centre) ব্যবসা এমন নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে যার মানের (য়ঁধষরঃু) কথা বলাইবাহুল্য। এই ব্যবস্থার আরও একটি কুৎসিত রূপ হলো ভুয়া মেডিক্যাল সার্টিফিকেট প্রদান অর্থের বিনিময়ে অথবা এক সিনিয়র চিকিৎসকের প্যাড/সিল ব্যবহার করে জুনিয়র চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র দেয়া যা সম্পূর্ণ অনৈতিক। এই সকল অনুশীলন বন্ধের জন্য সামাজিক সচেতনতা জরুরী। পঞ্চমত- রোগী হয়ে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে যাতে রোগে আক্রান্ত না হওয়া যায় সেটাই শ্রেয়। তার জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়মাবলি পালনসহ পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ। সব শেষে বলা যায়, স্বাস্থ্য মানব সম্পদের গুরুত্বপূর্ণ সূচক যাকে মানসিকতার আলোকে সাজাতে হবে এই হোক চিকিৎসক সমাজের কাছে প্রত্যাশা। লেখক : কৃষি অর্থনীতিবিদ [email protected]
×