ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

জাফর ওয়াজেদ

ইতিহাস বর্জিত তকমার ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’

প্রকাশিত: ০৩:০১, ৬ নভেম্বর ২০১৭

ইতিহাস বর্জিত তকমার ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’

ঐতিহাসিক কোন সত্যকেই মিথ্যাচার দিয়ে ঢাকা যায় না। সম্ভবও নয়। সত্য শত হাত মাটি খুঁড়ে যথারীতি বেরিয়ে আসবেই। যত উচ্চকণ্ঠেই নিনাদিত হোক না কেন, মিথ্যা আপাতত পাতে পড়লেও শেষতক তা মিলিয়ে যায় ধুলোতে। সমকালের মিথ্যাচার ভাবীকালে প্রমাণিত হয়ে যায়, তার অন্তঃসারশূন্যতা। কিন্তু মিথ্যা প্রতিষ্ঠিত করা হলে তা কখনও সখনও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে। কিংবা অজ্ঞতাপ্রসূত যে বক্তব্য রাখা হয়, তা সমাজ ও জীবনকে কলুষিত করে। কিন্তু সে সবই সাময়িক। অজ্ঞতা কখনও কোন অহঙ্কার হতে পারে না। বিশেষ করে শিক্ষিতজন যদি হয় এই অজ্ঞতায় আক্রান্ত, আর সোচ্চার মিথ্যা কিংবা বিকৃত তথ্য পরিবেশন করেন তবে তা মানুষের বিশ্বাসবোধে সন্দেহের বীজ বুনে দিতে পারে, যা কাম্য নয়। ইতিহাসের তথ্য বিকৃতি করায় পারদর্শী যারা, তারা নিজেরাই এক সময় নিক্ষেপিত হয় ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। আমাদের সমকালেই আমরা দেখে আসছি, মিথ্যা ইতিহাস দিয়ে মানুষকে বেশিদিন বিভ্রান্ত করা যায়নি। সত্য আপন গতিতে ক্রমশ প্রকাশিত হয়, হচ্ছে। তাই আজ যারা সমকালীন ইতিহাসকে অসত্য তথ্যে ভরপুর করে বাজারজাত করায় সচেষ্ট, তারা বেশিদিন এই তথ্য বিক্রি করতে পারবেন না। যে যা নয়, যে বিষয়ে নেই যার অবস্থান, তাকে সেই বিষয়ে উচ্চাসনে ঠাঁই দিতে মিথ্যার বেসাতি করার প্রবণতা অতি পুরাতন হলেও, প্রায়শই এসবের মুখোমুখি হতে হয় দেশ ও জাতিকে। আবেগতাড়িত হয়ে যেসব বাক্যই উচ্চরণ করা হোক না কেন, সবই বিফলে যেতে বাধ্য। অবাক হতে হয়, ইতিহাসের সত্যকে চাপা দিয়ে বায়বীয় তথ্য তুলে ধরার মধ্য দিয়ে একটা হীন উদ্দেশ্য সাধনের প্রবণতাই পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বাধীন বাংলাদেশকে যারা পাকিস্তানী ধারায় ফিরিয়ে নেবার জন্য হত্যা, গুম, ক্যু চালিয়েছেন, তাদের এই কর্মকা-কে গুরুত্ব দিয়ে প্রশংসিত বাক্য উচ্চারণের মধ্য দিয়ে এক ধরনের আনুগত্যের প্রকাশ ঘটানো গেলেও বাস্তবতা তাকে স্থায়িত্ব দেয় না। রবীন্দ্রনাথ তো গত শতাব্দীর শুরুতেই বলেছিলেন, ‘নৌকার খোলে যদি ছিদ্র থাকে তবে নৌকার মাস্তুল কখনই গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়াতে পারবে না। তা তিনি যতই উচ্চে থাকুন না কেন।’ উচ্চাসনে বসে একুশ দিন আগে গত ১৫ অক্টোবর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠকে যা বলেছেন, তা ইতিহাস বিকৃতি শুধু নয়, অর্জিত স্বাধীনতার সুফলের বিপরীতই বলা যায়। চালাকি দিয়ে যে মহৎ কাজ হয় না, তা নিশ্চয়ই তিনিও জানেন। কিন্তু এক ধরনের চালাকির আশ্রয় যে নেয়া হয়েছে, তা তার পরবর্তী ভাষ্যেও স্পষ্ট হয়েছে। প্রশংসামূলক যেসব বাক্য নির্গত হয়েছে তার কণ্ঠস্বর থেকে, তাতে সত্যের লেশমাত্র নেই। এই বক্তব্যগুলো তিনি ধারণ করেছেন, স্বাধীনতাবিরোধী ও জান্তা শাসকের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা গণমাধ্যমের উপর্যুপরি প্রচারণার ফসল হিসেবে। বিপরীত এক তথ্যকে তিনি এমনভাবে ব্যক্ত করেছেন, তাতে সচেতন মানুষ বিস্মিত হতে বাধ্য। সমালোচিত হবার পরও তিনি সংবাদ সম্মেলন ডেকে আরও জোর দিয়ে বলেছেনও, ‘জিয়াই বহুদলীয় গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা।’ তিনি নিজেও তা ধারণ করেন বলেই আরও বলতে পেরেছেন, ‘তথ্যভিত্তিক কথা বলছেন।’ এমনও বলেছেন, ‘পঁচাত্তরের আগে গণতন্ত্র ছিল। পঁচাত্তর থেকে সাতাত্তর পর্যন্ত গণতন্ত্র ছিল না। জিয়াউর রহমান এসে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। আওয়ামী লীগসহ বহু দলকে নিয়ে নির্বাচনও করেন। এর মাধ্যমেই বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরে এসেছিল।’ একজন স্বৈরাশাসকের সব অপকর্মকে চাপা দিয়ে তাকে ধোপদুরস্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য এই যে প্রচেষ্টা, তাতে দুরভিসন্ধি অনেকেই খুঁজে পেতে পারেন। কিন্তু বক্তব্যসমূহে যদি সত্যের লেশমাত্র থাকত, তবে তাকে বাহবা দেয়া যেত। কিন্তু অসত্যের নর্দমায় দুর্গন্ধযুক্ত ভাষ্য পরিবেশকে দূষিত ও কলুষিত করা ছাড়া আর কোন পথ ও পন্থা ধারণ করতে পারে না। তথ্যভিত্তিক কথা বলছেন বলে উচ্চকণ্ঠে যে দাবি তিনি করেছেন, ইতিহাসের খেরো খাতার পাতার পর পাতা উল্টে গেলেও এই তথ্য মেলে না। এসব মেলে স্বাধীনতাবিরোধী ও জান্তা শাসকদের প্রচারিত গণমাধ্যমে। যেখানে জান্তা শাসককে সত্য-মিথ্যার ছাঁচে ফেলে ‘মহান পুরুষ’ বানানোসহ নানা বিশ্লেষণে বিশেষায়িত করা হয়েছে। সেসব মন ও মননে, মস্তিষ্কে ধারণ করার ফসলই হচ্ছে এই অসত্য তথ্যভিত্তিক বক্তব্য। কোন্ ইতিহাসে তিনি পেলেন এসব অর্থহীনতায় আবৃত কথামালা, তা তিনিই জানেন। এর পরিবর্তে যদি সত্যি তথ্য হিসেবে সামরিক জান্তা শাসক কীভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থা ধ্বংস করেছে, গণভোট নামক প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে; কীভাবে নির্বাচন কমিশনকে করেছে বশংবদ, তাহলে স্পষ্ট হতো তার তথ্যভিত্তিক কথামালার সত্যতা। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নামে বর্তমান সিইসির পূর্বসূরিরা ‘মার্শাল গণতন্ত্রের’ আওতায় জান্তা নির্ধারিত ফলাফল ঘোষণা করেছে, তার কোন তথ্য তিনি প্রদান না করে বরং তা চাপা দিতে চেয়েছেন বল্লে ভুল বলা হয় না। ক্ষমতা দখলকারী ‘স্বৈরশাসক ও রাজাকার পুনর্বাসনকারী জিয়া’ তার অবৈধ ক্ষমতার বৈধতা পাওয়ার জন্য ১৯৭৭ সালে প্রহসনের গণভোটের আয়োজন করেছিলেন। ভোটকেন্দ্রে ভোটারদের ব্যাপক অনুপস্থিতির পরও এই তথাকথিত গণভোটে জান্তা শাসক জিয়া ৯৮ ভাগ ভোট পেয়েছেন বলে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করে। এই গণভোটে জিয়ার কোন প্রতিপক্ষ ছিল না। শতকরা ৫ থেকে ১০ জন ভোটারও ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি ছিল না বলে সেদিন বিবিসি প্রচার করেছিল। রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা অপচয়ের এই নির্বাচনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ হারিয়েছিল তার ভোটাধিকার এবং বিনষ্ট হয়েছিল সব গণতান্ত্রিক পরিবেশ আর ধ্বংস হয়েছিল নির্বাচনী ব্যবস্থাসমূহ। এর ধারাবাহিকতা দেখা গেছে পরবর্তী সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখলকারী এরশাদের সময়ও ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণআন্দোলনে পতন পর্যন্ত। জিয়ার নিকৃষ্টতম ভোট জালিয়াতির বিষয়ে বর্তমান সিইসি যদি কিছু উল্লেখ করতেন, তবে তা হতো তথ্যভিত্তিক। গণভোটের পর জিয়া ১৯৭৮-এর তিন জুন অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হন সেনাবাহিনীর প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ না করেই। অথচ সংবিধান অনুযায়ী সরকারী চাকরিতে নিয়োজিত থেকে কোন ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারেন না। এই অবস্থায় জিয়া নিজের স্বার্থে ১৯৭৮ সালের ২৯ এপ্রিল অধ্যাদেশ জারি করেন সংবিধানকে দলিত করেই। অধ্যাদেশে বলা হয়, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে বহাল থাকবেন এবং তিনি প্রত্যক্ষভাবে কিংবা তাদের স্টাফ প্রধানদের মাধ্যমে তাদের পরিদর্শন, নির্দেশ প্রদান এবং নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ব্যবহার করবেন। দ্বিতীয়ত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক প্রজাতন্ত্রের কোন্ চাকরিতে নিযুক্ত এবং বেতন-ভাতাদি ভোগ করছেন বলে বিবেচিত হবে না। এই এক জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছিলেন জিয়া। চাকরিতে থেকে বেতন-ভাতাদি নিলেন কিন্তু আইন করলেন, এসব ভোগ বিবেচিত হবে না। সিইসির জ্ঞাত গণতন্ত্র চর্চার নমুনা এটাই হয়ত। সিইসির বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অধ্যাদেশে নিজেকে সকল ত্রুটির উর্ধে রাখার অপপ্রয়াসকে কার্যকর করেছিলেন। ১৯৭৮ সালের ২ মে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিনে এবং তিন জুন নির্বাচনের দিনেও সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধানের পদে বহাল ছিলেন। দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি না নেয়ার এই ঘটনাকে সিইসির কাছে গণতান্ত্রিক আচরণ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে হয়ত। অথচ পুরো ব্যাপারটিই ছিল অসাংবিধানিক। আরও ‘গণতান্ত্রিক’ আবহ পাওয়া যায় জিয়ার কর্মকা-ে। কাগজে-কলমে জেনারেল এরশাদকে সেনাপ্রধান বানিয়ে জিয়া নিজে ওই পদে আরও ৮ মাস দায়িত্বে বহাল ছিলেন। সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান এরশাদকে ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে সেনাপ্রধান নিয়োগ করা হয়। এক ডিসেম্বর এরশাদকে নিয়োগপত্র প্রদান করেন স্বয়ং জিয়া। পেছনের তারিখ দিয়ে দায়িত্ব প্রদানের মতো গর্হিত ও বিধিবিধান বিরোধী কাজটি ‘গণতন্ত্রের প্রবক্তা’ জিয়াই করেছিলেন। ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল জিয়া তারই জারি করা প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ২৯ এপ্রিল থেকে নিজেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উন্নীত করেন। আবার একই তারিখে অপর একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে লে. জেনারেল হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এ রকম চালিয়াতি ও জালিয়াতির নমুনা কোথাও আর মেলে না। ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর জিয়া ক্ষমতার দ-মু-ের কর্তা বনে যান। ’৭৫-এর ২৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর খুনীচক্র জিয়াকে সেনাপ্রধান নিযুক্ত করেছিল। তিন মাসের মধ্যে উপপ্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন শুরু করেন। বিচারপতি সায়েম তখন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হলেও ক্ষমতার রশি জিয়ার হাতেই ছিল। ১৯৭৬ সালের ২৮ নবেম্বর প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের পদ সায়েমের কাছ থেকে কেড়ে নেন। আর ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল রাষ্ট্রপতির গদি ছিনিয়ে নেন সায়েমকে অসুস্থ দেখিয়ে অস্ত্রের মুখে। রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মকা- নিষিদ্ধ করে, কোন দল বা ব্যক্তিকে অংশ নেবার সুযোগ না দিয়ে এককভাবে ১৯৭৭ সালের ৩০মে যে গণভোট করেছিলেন, সেই পথ ধরে তিনি অগণতান্ত্রিক পথে এগিয়ে যান। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন করার জন্য ১৯৭৬ সালের ২৮ জুলাই সামরিক ফরমান বলে রাজনৈতিক দলবিধি ঘোষণা করেন জিয়া। কিন্তু প্রকাশ্য রাজনীতি করার অধিকার দেননি। বরং চালু করেন ঘরোয়া রাজনীতি ‘গণতন্ত্রের নামে’। রাজনৈতিক দল নিবন্ধন কাজ শুরু হয় ২০ সেপ্টেম্বর থেকে। ভাসানী ন্যাপ, জাতীয় লীগ, পিপলস পার্টি, ডেমোক্র্যাটিক লীগ, তফসিলি ফেডারেশন, গণমুক্তি পার্টি, জাতীয় দল, লেবার পার্টি নিবন্ধিত হয়। স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ নেজামে ইসলামী ও নিষিদ্ধ জামায়াতে ইসলামী যৌথভাবে ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ নামে নিবন্ধিত হয় ১২ অক্টোবর। একই তারিখে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, জাসদ ( আওয়াল) ও মুসলিম লীগ (সবুর) নিবন্ধিত হয়। আওয়ামী লীগকে বাধ্য করা হয় বঙ্গবন্ধুর নাম বাদ দিয়ে নিবন্ধন নিতে। একই সময় ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের নেতৃত্বে সে সময়ে নিবন্ধিত হয় চারটি দল। তখনও জিয়ার দল নিবন্ধিত হয়নি। বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা জিয়া রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর নিবন্ধিত হয় একমাত্র তার দলটি। অন্য কোন দল তার শাসনকালে নিবন্ধিত হয়নি। ঘরোয়া রাজনীতি চালুর মাধ্যমে সীমিত পরিসরে সংগঠন পরিচালনা করার সুযোগ দেয়া হয়। এরপর চালু করেন মুক্তাঙ্গন, যেখানে রাজনৈতিক দল সমাবেশ করতে পারবে। ঘরোয়া রাজনীতি ও মুক্তাঙ্গন জিয়ার ‘বহুদলীয় গণতন্ত্রের’ নমুনা বৈকি। ক্ষমতা দখলকারী জান্তা শাসক জিয়ার চার বছর শাসনকালে গণতন্ত্র ছিল মার্শাল গণতন্ত্র। জাতীয় সংসদ যে আইনই পাস করুক, রাষ্ট্রপতি তা বাতিলের ক্ষমতা রাখতেন। ১৯৭৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে সংসদ নির্বাচন হয়, তা ছিল ভোট কারচুপি, কেন্দ্র দখল, জনমত রহিত করে পছন্দমাফিক প্রার্থীদের নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়েছিল; সেই সংসদ স্বাধীন ও সার্বভৌম ছিল না। অথচ এই কার্যকলাপকে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’ আখ্যা দেয়ার পেছনে ইতিহাসের বর্জিত তকমাকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। জিয়া যা করেননি, সেই তকমা তাকে প্রদানের যে কাজটি বর্তমান সিইসি করেছেন, তার নেপথ্যে কোন সদুদ্দেশ্য নেই। সেনা শাসকরা কখনও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেননা। বরং গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরাতেই তাদের আনন্দ। রাজনৈতিক দলগুলো থেকে নেতা কর্মীদের ভাগিয়ে নেয়ার জন্য হামলা মামলা প্রক্রিয়া চালু করেছিলেন। দল নিবন্ধনের ব্যবস্থা নেয়া হলেও নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে দেখা যায়নি। বরং সংসদকে ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাখা হয়েছিল। সিইসি যদি প্রশংসার জন্য জিয়ার এসব কর্মকা- তুলে ধরতেন, তবে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন হতো যথাযথ। কিন্তু সে পথে যাননি। রবীন্দ্রনাথ যেমনটা বলেছেন, ‘সমস্ত বিশ্বের জ্ঞানশক্তি প্রাণশক্তি তাকে ভিতরে বাহিরে কেবলই আঘাত করছে, আমরা যে যত ছোট হই সেই জ্ঞানের দলে প্রাণের দলে দাঁড়াব, দাঁড়িয়ে যদি মরি তবু একথা নিশ্চয় মনে রেখে মরব যে, আমাদেরই দলের জিত হবে-দেশের জড়তাকেই সকলের চেয়ে বড়ো এবং প্রবল মনে করে তারই উপর বিছানা পেতে পড়ে থাকব না। আমি তো বলি- জগতে শয়তানের উপর বিশ্বাস স্থাপন করা আর ভূতের ভয় করা ঠিক একই কথা; ওতে ফল হয় এই যে রোগের সত্যকার চিকিৎসায় প্রবৃত্তিই হয় না। যেমন মিথ্যাভয় তেমনি মিথ্যা ওঝা -দুয়ে মিলেই আমাদের মারতে থাকে।’ বহুদলীয় গণতন্ত্র না বলে মার্শাল গণতন্ত্র বলা হলে তা হতো যুক্তিযুক্ত। সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের অতীত বেহাল তথ্য তুলে ধরাও সঙ্গত ছিল। মিথ্যাচারের এইসব দিকগুলো ম্লান ও মুছে যেতে পারে, যদি জিয়া শাসনামলের পূর্বাপর ঘটনার উপর শ্বেতপত্র প্রকাশ করা হয়।
×