ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি

প্রকাশিত: ০৩:০০, ৬ নভেম্বর ২০১৭

নির্যাতনের পুনরাবৃত্তি

সমাজের নানা স্তরে মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয় চলছে। সমাজে তার দুঃখজনক প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। কোন কোন মানুষের ভেতর অস্থিরতা এমন এক সর্বনাশা প্রভাব তৈরি করছে যে, হিতাহিত জ্ঞান পর্যন্ত লোপ পাচ্ছে অনেকের। এখানে মানুষে মানুষে সম্পর্কের যেন কোন মূল্যই নেই! পাহাড়সমান এক আত্মপরতা মানুষকে ক্রমশ নিচের দিকে নামাচ্ছে। মানুষের সহজাত মানবিক বৈশিষ্ট্যগুলো নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সর্বত্রই অসহিষ্ণুতা দেখা দিয়েছে। এরই প্রভাব পড়ছে সমাজমানসে। শিশুরাও রেহাই পাচ্ছে না। রাজধানীতে দুটি জোড়া খুন যেন তারই উদাহরণ। সমাজে উঁচুতলার মানুষের একাংশের ভেতর যেমন এটি দেখা যাচ্ছে, তেমনি পরিশ্রমী নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষও সমরূপ অপরাধী কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে বাড্ডায় বাবা-মেয়ে এবং কাকরাইলে মা-ছেলে খুনের ঘটনায় সমাজ যেন টলে উঠেছে। আমরা চলেছি কোথায়! পারিবারিক মধুর বন্ধনগুলোয় ভাঙ্গনের সূক্ষ্ম দংশন নৃশংস পরিণতি ডেকে আনছে! নারীর ওপর বিচিত্র নির্যাতনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। সরকার আগের তুলনায় নারীর সুরক্ষা দানে অধিক তৎপর। নারী নির্যাতনকারীকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তিদান নিশ্চিতের জন্য কাজ করে চলেছে। এত আন্তরিক প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের মধ্যেও নারী নিগ্রহের ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ধর্ষণ ও গণধর্ষণ এক মারাত্মক ব্যাধি হিসেবে সমাজে বিরাজ করছে। পরিসংখ্যান বলছে, গত এক মাসে ১১৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২২ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে একজনকে। ধর্ষণ একজন নারীর ওপর হত্যাতুল্য অপরাধ। কেননা ধর্ষণ নারীর মনকে ক্ষতবিক্ষত করে দেয়। সেই মন জীবন্মৃত অবস্থার ভেতর জীবন টেনে নিয়ে চলে। গণধর্ষণের শিকার নারী তার গোটা জীবনেও পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠতে পারে না, তার গভীর দহন চলতে থাকে নিরন্তর। ধর্ষণের ন্যায্য বিচার পেতে নানা সন্দেহ ও সূক্ষ্ম অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয় ধর্ষিত নারীদের। প্রতিটি ধর্ষণ ও গণধর্ষণের ঘটনা সমাজে একজন নারীর মনোজগতে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তার ভেতর নিরাপত্তাহীনতার বিস্তার ঘটে, অপমানবোধের তীর তাকে বিদ্ধ করে চলে সঙ্গোপনে। নারীর ওপর এই পাশবিকতা আদর্শবান, বিবেকবান সকল পুরুষকে বিচলিত ও লজ্জিত করে। এই অপমান সমাজে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক সঙ্গত ও সৌন্দর্যমণ্ডিত সম্পর্কের ভেতর দেয়াল তুলে দেয়। পারস্পরিক অবিশ্বাস ও অসম্মানবোধ বাড়তে থাকে। এটি সভ্যতার বিকাশকেই বাধাগ্রস্ত করে। সমাজে নারীরা এগিয়ে চলেছে সাধারণভাবে এ কথা আমরা বলে থাকি। বিগত বছরগুলোয় নারীর অবস্থা ও অবস্থানের প্রভূত উন্নতি হয়েছে বলেও আমরা মাঝে-মধ্যে আত্মশ্লাঘা অনুভব করে থাকি। অথচ হঠাৎ হঠাৎ এমন সব নারী নির্যাতনের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়, যেগুলোর প্রকৃতি ও অন্তর্নিহিত নির্মমতার পরিচয় পেয়ে আমাদের বিবেক যেন বিবশ হয়ে পড়ে। আমরা অনুধাবনে সক্ষম হই যে, সমাজ থেকে এখনও দূর হয়নি অন্ধকার। এখনও পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে দাপটের সঙ্গে বিরাজ করছে। শুধু আইন দিয়ে ধর্ষণের মতো অন্যায়-অনাচার দূর করা সম্ভব নয়। এজন্য সবার আগে চাই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে পুরুষদেরও সোচ্চার হতে হবে। পারিবারিক মূল্যবোধকে উর্ধে তুলে ধরার জন্য পরিবারের অভিভাবক, প্রতিটি শিক্ষায়তনের শিক্ষক, লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকারদের ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। মানুষকে সচেতন করার কাজটি সহজ না হলেও অসম্ভব নয়। যে কোন উপায়েই হোক নারীর ওপর নির্যাতনের এসব পুনরাবৃত্তি রোধ করতেই হবে।
×