ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

চলতি মাসেই ষোড়শ সংশোধনী রায়ের রিভিউ আবেদন

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৫ নভেম্বর ২০১৭

চলতি মাসেই ষোড়শ সংশোধনী রায়ের রিভিউ আবেদন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ চলতি মাসেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করা হবে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। রিভিউ আবেদনে আপীল বিভাগের দেয়া পুরো রায় নিয়েই প্রশ্ন তোলা হবে বলেও জানান তিনি। শনিবার সুপ্রীমকোর্টে এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন সংক্রান্ত দেড় ঘণ্টার এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের একথা জানান আইনমন্ত্রী। বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে নিয়ে সংবিধানে আনা ষোড়শ সংশোধন বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে আপীল বিভাগ দেশে গণতন্ত্র, সংসদ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বেশ কিছু মন্তব্য করে, যা আদালতের এখতিয়ারের বাইরে বলে ক্ষমতাসীনদের দাবি। রায় নিয়ে সংসদ ও সরকারের তীব্র প্রতিক্রিয়া, আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীদের আন্দোলনের হুমকির প্রেক্ষাপটে রায়দানকারী প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা দীর্ঘ ছুটি নিয়ে বিদেশে গেছেন। এরপর তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়টিও প্রকাশ পায়। বিক্ষুব্ধ সংসদে আইনমন্ত্রী রায় রিভিউয়ের আবেদন করবেন জানিয়ে সংসদ সদস্যদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, রিভিউতে কামিয়াব হবেন বলে আশাবাদী। বৈঠকের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নে আইনমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বসেছিলাম গ্রাউন্ডগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য। আমরা গ্রাউন্ডগুলো ফাইনালাইজ করেছি। এখন দাখিল করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এ মাসের মধ্যেই রিভিউ পিটিশন দাখিল করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রিভিউ করব, তার মানে পুরো রায়কেই প্রশ্ন করছি। বৈঠকে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, মমতাজ ফকির, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোতাহার হোসেন সাজু, একরামুল হক টুটুল, অমিত তালুকদার, বিশ্বজিৎ দেবনাথ, খন্দকার দিলীরুজ্জামান, মাসুদ হাসান চৌধুরী, সরদার রাশেদ জাহাঙ্গীর ও সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল বশির আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। গত ২০ অক্টোবর এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, রিভিউ আবেদন করতে সহকর্মীদের নিয়ে ১১ সদস্যের কমিটি করেছেন তিনি। শনিবার তাদের নিয়েই বৈঠকটি হয়েছে। এ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, সিদ্ধান্ত হয়েছে এ মাসেই রিভিউ করা হবে। এর আগে ১১ অক্টোবর রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার কথা জানান রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়, যাতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়। সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নবেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নবেম্বর রুল জারি করেন। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চাওয়া হয়। ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয় ওই বছরের ১১ আগস্ট। তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মোঃ আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন। রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপীল করলে গত ৮ মে আপীল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে ওই আপীল আবেদনের শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা। পাশাপাশি এ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রীমকোর্টের ১০ আইনজীবীর বক্তব্যও শোনেন আপীল বিভাগ, যাদের মধ্যে একজন বাদে অন্য সবার কথায় হাইকোর্টের রায়ের পক্ষে অবস্থান প্রকাশ পায়। গত ২ জুলাই হাইকোর্টের রায় বহাল রেখেই রায় দেন আপীল বিভাগ। এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ পায় গত ১ আগস্ট। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মোঃ আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। পূর্ণাঙ্গ অনুলিপিতে দেখা যায়, রায়ের আদেশের অংশে আপীল বিভাগের বিচারপতিরা সর্বসম্মত হলেও পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সর্বসম্মত হতে পারেননি। ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি অনেক অপ্রাসঙ্গিক মন্তব্য তুলে ধরেন। জাতীয় সংসদ ও নির্বাহী বিভাগের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে সমালোচনা করা হয় সুপ্রীমকোর্টের এই রায়ে। মামলায়র বিবেচ্য বিষয় নয় বলে প্রধান বিচারপতির লেখা পর্যবেক্ষণের সঙ্গে সরাসরি দ্বিমত করে রায় লিখেছেন আপীল বিভাগের ওই বেঞ্চের দুই বিচারপতি। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। সুপ্রীমকোর্টের এই রায় প্রকাশের পর প্রধান বিচারপতির লেখায় অংশ নিয়ে সরকারদলীয় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের মধ্যেও ক্ষোভ প্রকাশ পায়। সাবেক প্রধান বিচারপতি ও আইন কমিশনের চেয়ারম্যান এবিএম খায়রুল হক প্রধান বিচারপতির রায়কে ভ্রমাত্মক বলেও মন্তব্য করেছেন। জাতীয় সংসদেও এ রায়ের সমালোচনা করা হয়। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় এবং তার কিছু পর্যবেক্ষণের বিষয়ে আইনী পদক্ষেপ নিতে জাতীয় সংসদে একটি প্রস্তাবও গ্রহণ করা হয়। ওই প্রস্তাব পাসের আগে সংসদে আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আদালত তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে সংসদে আনা সংবিধান সংশোধন বাতিলের এই রায় দিয়েছে। সংসদ ও গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে এই রায় দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সরকার প্রধান।
×