ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এমন তথ্য পেয়েছে র‌্যাব গোয়েন্দারা

নাইন-ইলেভেন স্টাইলে বিমান নিয়ে হামলার ছক কষেছিল সাব্বির

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৫ নভেম্বর ২০১৭

নাইন-ইলেভেন স্টাইলে বিমান নিয়ে হামলার ছক কষেছিল সাব্বির

শংকর কুমার দে ॥ গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে বিমান নিয়ে হামলার পরিকল্পনা করেছিলেন বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কো-পাইলট (ফার্স্ট অফিসার) সাব্বির এনাম সাব্বির। সাব্বিরসহ জঙ্গী সংগঠন নব্য জেএমবির (সারোয়ার-তামিম গ্রুপের) চার জনকে জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতার করে আদালত থেকে সাত দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদে এই ধরনের তথ্য পেয়েছে র‌্যাব-গোয়েন্দারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীর বিশেষায়িত ইউনিট এসপিবিএন ও এসএসএফের সমন্বয়ে গঠিত বিশেষায়িত বাহিনীর মাধ্যমে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়। আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটসের (আইএস) আদলে বিমানের কো-পাইলট সাব্বিরের নেতৃত্বে গণভবনে বিমান ক্রাশ করে নাশকতার ছক কষেছিল নব্য জেএমবি। গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার আগে ও পরে নব্য জেএমবির (সারোয়ার-তামিম গ্রুপের) নেতা সারোয়ার জাহানের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছিল সাব্বির ও তার পরিবারের সদস্যসহ জঙ্গীরা। সুযোগের অপেক্ষায় থাকা জঙ্গীদের এই ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই কো-পাইলট সাব্বির ও তার সহযোগীরা ধরা পড়ে যাওয়ায় বড় ধরনের নাশকতা থেকে রক্ষা পেয়েছে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন ও কার্যালয়। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট র‌্যাব-গোয়েন্দা সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সূত্রে জানা গেছে, জঙ্গী সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে গ্রেফতারের পর রাজধানীর দারুসসালাম থানায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা মামলায় বুধবার বিমানের কো-পাইলট সাব্বির এনামকে সাত দিন, তার মা সুলতানা পারভিনকে পাঁচ দিন ও আসিফুর রহমান আসিফ ও আলমকে ছয় দিনের রিমান্ড দিয়েছে আদালত। গত ২৬ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ থেকে জঙ্গী আব্দুল্লার ঘনিষ্ঠ সহযোগী বিল্লাল হোসেনকে (২৩) গ্রেফতার করার পর আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়। তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত মিরপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিমানের কো-পাইলট সাব্বিরসহ এই চারজনকে গ্রেফতার করা হয়। বিমানের কো-পাইলট সাব্বিরের বাসভবন মিরপুর মাজার রোডের ‘কমল প্রভায়’ জঙ্গী আস্তানায় গত সেপ্টেম্বরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান চলাকালে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে জঙ্গী আব্দুল্লাহ তার দুই স্ত্রী, দুই সন্তান এবং দুই সহযোগীসহ ৭ জন নিহত হন। কমল প্রভা নামে বাড়ির মালিক হাবীবুল্লাহ বাহার আজাদসহ ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়। সাব্বির এনাম সাব্বিরের মিরপুর মাজার রোডের কমল প্রভায় গত সেপ্টেম্বরে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত জঙ্গী আব্দুল্লাহর সহযোগী মোঃ আলম ও আসিফ পালিয়ে যায়। জঙ্গীদের সঙ্গে বৈঠক করে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের কায়দায় যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে হামলার আদলে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়ে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেন সাব্বির এনাম সাব্বির। বিমান যাত্রীদের জিম্মি করে মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক দেশে অবতরণ করার পরিকল্পনাও ছিল এই জঙ্গী গোষ্ঠীর। বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোর আগেই সাব্বিরসহ জঙ্গীদের গ্রেফতার করে ফেলে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। গত ১০ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জ থেকে র‌্যাবের হাতে আটক সম্রাট মিয়া ও শাহাদত হোসেন ওরফে আমির হামজাকে গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে সাব্বিরসহ তার পরিবারের জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ার তথ্য পেয়ে নিশ্চিত হয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়। জঙ্গী সম্রাট ও হামজা মিরপুরের মাজার রোডের সাব্বিরদের বাসভবনে নিহত জঙ্গী আব্দুল্লাহর সহযোগী। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হওয়ার আগে আব্দুল্লাহর প্রভাবে সাব্বিরের পরিবারও জঙ্গীবাদে জড়িয়ে যায়। গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, বিমানের কো-পাইলট সাব্বির এনাম সাব্বিরসহ নব্য জেএমবির জঙ্গীরা ধরা পড়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, গণভবনে বিমান ক্রাশ করে বড় ধরনের হামলার মাধ্যমে নাশকতার পরিকল্পনা করেছিল তারা। এই ধরনের তথ্য পাওয়ার পর প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনের পর এবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নিরাপত্তায় মাঠে নামানো হয় পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট এসপিবিএন (স্পেশাল সিকিউরিটি এ্যান্ড প্রটেকশন ব্যাটালিয়ন)। ইউনিটটি এর আগে থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে এলেও এখন তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে সাত শ’ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়ের নিরাপত্তায় এসপিবিএনের সঙ্গে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্স (এসএসএফ) সমন্বয় করে কাজ করবে এই সমন্বিত বাহিনী। নিরাপত্তার দায়িত্বে সমন্বিত বাহিনী প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাসভবন গণভবনের চারদিকের সীমানা প্রাচীর সংলগ্ন চৌকিগুলোতে নজরদারি, তল্লাশির জন্য মোতায়েন থাকবে। গাঢ় নীল রঙের প্যান্ট ও ধূসর রঙের শার্ট পরিহিত এসপিবিএন সদস্যের হাতে অত্যাধুনিক সেভেন পয়েন্ট বাষট্টি ক্যালিবারের চায়নিজ রাইফেল, যা প্রয়োজনীয় মুহূর্তেই টার্গেটকে গুলি করতে পারবে। তদন্ত সূত্র মতে, সাব্বির এনাম সাব্বির জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠন ইসলামিক স্টেটসের (আইএস) আদলে বিমান নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়ে হামলার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। আইএস জঙ্গী গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে যেভাবে হামলা চালিয়েছে, অনুরূপ কায়দায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন ও কার্যালয়ে হামলার ছক কষা হয়। এই হামলার মূল টার্গেট ছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ ছাড়াও বিমান যাত্রীদের জিম্মি করে মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক দেশে অবতরণ করার পরিকল্পনা নিয়ে অন্য জঙ্গীদের সঙ্গে গোপন বৈঠকে আলাপ-আলোচনা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত সাব্বিরের মা সুলতানা পারভীন জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, তিনি আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত আব্দুল্লাহর ভাড়া করা ফ্ল্যাটে গিয়ে ও ছাদে উঠে জঙ্গী সংগঠনের বিষয়ে আব্দুল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করতেন। তিনি জঙ্গী সারোয়ার জাহানের বাইয়াত (আনুগত্য) গ্রহণ করেন। এছাড়াও তিনি আব্দুল্লাহকে সংগঠনের জন্য বিভিন্ন সময় আর্থিক সহায়তা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আত্মঘাতী হয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত জঙ্গী আব্দুল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল কো-পাইলট সাব্বিরের। নব্য জেএমবি নেতা সারোয়ার জাহানের মাধ্যমে তিনি জঙ্গীবাদে দীক্ষা নেন। গুলশান হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী জঙ্গী নেতা সারোয়ার জাহান, আত্মঘাতী হয়ে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিহত আবদুল্লাহ ও গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেয়া কো-পাইলট সাব্বির একত্রে বৈঠকে নাশকতার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আইএস জঙ্গীদের কায়দায় কো-পাইলট সাব্বির বিমান চালিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও কার্যালয়ে বিমান ক্রাশ করিয়ে আঘাত অথবা বিমানের যাত্রীদের জিম্মি করে মধ্যপ্রাচ্যে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করাই ছিল তাদের লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টার্গেট করে বিমান ক্রাশ এবং তার সরকারের সময়ে জঙ্গীরা সংগঠিত হয়েছে বহির্বিশ্বে এমন বার্তা ছড়াতে ও আইএসের সহানুভূতি ও বাহবা পাওয়াই ছিল তাদের পরিকল্পনার অংশ।
×