ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

তিস্তার চরে আলুর আবাদ

প্রকাশিত: ০৫:১৪, ৫ নভেম্বর ২০১৭

তিস্তার চরে আলুর আবাদ

তাহমিন হক ববী, তিস্তাপার হতে ॥ সাম্প্রতিককালের বন্যায় লন্ডভন্ড তিস্তার চরের আবাদি জমিগুলো প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে। চরের জমিতে আগাম আমন ধান ও বাদাম আবাদের পর এবার ওই জমিগুলো আলুর আলোয় উদ্ভাসিত হতে শুরু করেছে। তিস্তাপারের কৃষক পরিবারগুলো কোমরবেঁধে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ফসল ফলাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আলু আবাদ শেষে ওই জমিতে শুরু হবে ভুট্টা ও সরিষা আবাদ। নদীর এপারে বসত। ওপারে চরের আবাদি জমি। শুক্রবার সকালে সরেজমিন দেখা মেলে কৃষক পরিবারের নারী-পুরুষ সদস্যরা নৌকাযোগে ওপারের দোলাপাড়া বাঘেরচরের জমিতে ছুটে চলছে। তাদের যেন বসে থাকার সময় নেই। তারা বন্যার ভয়াবহ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চরের কোন জমি পতিত ফেলে রাখতে রাজি নয়। নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি ইউনিয়নের তেলির বাজার, তিস্তার বাজার গ্রামসহ বিভিন্ন গ্রামের কৃষক পরিবারগুলো আগাম আমন ধান আবাদের পর আলু আবাদে ঝুঁকে পড়েছে। তিস্তার চর এলাকায় এবার ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু চাষ করবে চরের পরিবারগুলো। এতে বিঘাপ্রতি আলু উৎপাদন হবে ১২ মণ। তিস্তার প্রতিটি চরে প্রতি বছর ভুট্টার বাম্পার ফলন হয়। ভুট্টা চাষ পাল্টে দেয় তিস্তাপারের দরিদ্র কৃষকের জীবনযাত্রার মান। জীবন সংগ্রামে ঘরে ঘরে ফিরে আসে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা। চরাঞ্চলে প্রজেক্টভিত্তিতে ও কৃষক পরিবারের মাধ্যমে ভুট্টা চাষে সরকারী-বেসরকারী ব্যাংক ও এনজিওর মাধ্যমে কয়েক শ’ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়। ভুট্টার পাশাপাশি চরের জমিতে ধান, গম, সরিষা, তরমুজ, মসলা ফসল, মিষ্টি কুমড়া, বাদামসহ প্রায় সব খাদ্যশস্যই উৎপাদন হয়। এবারের ভয়াবহ বন্যায় স্বাবলম্বী হয়ে গড়ে ওঠা তিস্তাপারের কৃষকদের কোমর ভেঙ্গে যায়। এমনকি চরের বসতঘর পর্যন্ত হারিয়ে যায়। তাদের আশ্রয় মেলে নদীর ডান তীরের বাঁধের বিভিন্ন স্থানে। তাই তারা বন্যার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে মাঠে ফসল উৎপাদনে পরিশ্রম করছে। চরের কৃষক ওপিছার (৫০) বললেন, বর্তমান শেখ হাসিনার সরকার কৃষিবান্ধব সরকার। এ সরকারের সময় ৪-৫ বছর ধরে তিস্তা নদীর চরে ভুট্টা আবাদ করে পরিবারের সচ্ছলতা এসেছে। বন্যার কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ওই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে তিস্তার চরে ব্যাপক আগাম আমন ধান আবাদ করা হয়েছে। এবার চরের জমিতে আলু চাষ করা হচ্ছে। পরিবারের সবাই মিলে সকালে নৌকাযোগে এপার হতে ওপারের চরের জমিতে গিয়ে দিনভর কাজ করে সন্ধ্যায় এপারের বসতঘরে ফিরে আসি। তিনি বলেন, লালপাকুড়ি জাতের আলু বালুমাটিতে ভাল হয়। বিঘাপ্রতি ১২ মণ পর্যন্ত আলু পাওয়া যাবে। এতে খরচ ১০ হাজার টাকা পড়লেও লাখ টাকায় আলু বিক্রি হবে। তিনি বলেন, আমরা নদীর মানুষ। যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে জানি। তাই আমাদের জীবন থেমে নেই। চরের অপর আলুচাষী ফরিদুল (২৭) জানান, তিনি এবার চরের দুই বিঘা জমিতে আলু চাষ করছেন। আলুতে লাভ বেশি পাওয়া যাবে। আলু আবাদের পর ওই জমিতে সরিষা আবাদ করব। তারপর ভুট্টা। তিস্তাপারের কৃষক পরিবারের গৃহবধূ ফরিনা বেগম (৪০) জানান, এখানে আমরা নারী-পুরুষ সমান। সবাই সংসারের কাজের পাশাপাশি ফসলি জমিতে শ্রম দেই। নদীর বন্যা আর খরার প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষদের সঙ্গে আমরা নারীরাও থেমে নেই। গৃহবধূ জেসমিন (৪০) জানান, অতীতে গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ আর গোয়ালভরা গরু ছিল। নদীর বন্যা ও ভাঙ্গনে নিঃস্ব হই। ভিটের মাটিটুকু পর্যন্ত ছিল না। ত্রাণের পানে চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকতে হতো এক সময়। অভাব-অনটন, অনাহার-অর্ধাহার ছিল জীবনের সঙ্গী। এখন দিনবদলে বর্তমান সরকারের সহযোগিতায় এবং বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার অর্থায়নে অসহায় নারীদের জীবনমানে পরিবর্তন এসেছে। তিস্তার চরে ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি আমরা নারীরা ক্ষুদ্র ব্যবসা, কাপড় সেলাই, গবাদিপশু পালন, এমনকি দোকানও দিয়েছি। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখায় ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাতে অনলাইন মার্কেট ধরতে ব্যবহার করছি ট্যাব বা স্মার্টফোন। তাই এ পরিবর্তনের ধারায় নারী সদস্যের জীবন-জীবিকা, জীবনমান, আর্থসামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা, জীবন ব্যবস্থা, তাদের চলাফেরা, প্রযুক্তি, পরিবারের সদস্য সংখ্যা, উপার্জনের ব্যবস্থাসহ নানা দিক নিয়ে নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তিস্তা নদীর অববাহিকায় বন্যা মোকাবেলা করে আজ পুনরায় জীবন সংগ্রামকে গুছিয়ে তুলছে। অপর গৃহবধূ কাজলী বেগম জানান, স্বামীসহ নিজেও ফসলি জমিতে কাজ করি। সকালে স্বামী ফরিদুলসহ নদীর ওপারে চলে যাই, সেখানে ফসলের ক্ষেতে কাজ করি। অবসর সময় আয়বর্ধক কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছি। কাপড় সেলাই করেও আয় হচ্ছে। এ ছাড়া লেখাপড়াও করছি। আগামীতে এইচএসসি পরীক্ষা দেব। মোমেনা বেগম বলেন, তার দুই মেয়ে। স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে। তাই বলে তিনি আর হাহুতাশ করেননি। মাঠে নেমে কাজ করেন। ক্ষুদ্র ব্যবসা করছেন। এক মেয়ে নাছরিনের বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে সুরভী অষ্টম শ্রেণীতে পড়ছে। আজ তার দুঃখ-দুর্দশা কেটে গেছে। তিনি বলেন, এবারের বন্যায় অনেক ক্ষতি হয়েছে। তার পরও আমরা তিস্তাপারের মানুষজন সব ক্ষতি পুষিয়ে নিজেদের জীবন পুনরায় গড়ে তুলছি। ডিমলা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, তিস্তার চরে শীতকালীন ভুট্টা চাষ হয় ২০ হাজার ৩৬৮ হেক্টর জমিতে। ভুট্টা উৎপাদন হয় এক লাখ ৪৭ হাজার ৮০২ মেট্রিক টন। সারাদেশে ভুট্টা উৎপাদনের ২৫ শতাংশ। গ্রীষ্মকালে ভুট্টা চাষ হয়েছে পাঁচ হাজার ৭৯০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন হয় ৩৪ হাজার ৭৪০ মেট্রিক টন। তিনি আরও জানান, এবারের বন্যায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তার পরেও বন্যার পর তিস্তা নদীর চরে বাম্পার আমন ধান হয়েছে। এবার চরের কৃষকরা আলু আবাদেও মাঠে নেমেছে। তিনি বলেন, আমরা তিস্তার চরের কৃষকদের ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে অন্যান্য কৃষকদের চেয়ে বেশি সহযোগিতা করে থাকি। তিনি মনে করেন, এবার তিস্তার চরে প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদ করবে কৃষকরা।
×