ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এসডিজি অর্জনে বাধা

কৃষিতে নারীর অবদান যথেষ্ট, অথচ ভূমি মালিকানা সীমিত

প্রকাশিত: ০৪:৪৩, ৫ নভেম্বর ২০১৭

কৃষিতে নারীর অবদান যথেষ্ট, অথচ ভূমি মালিকানা সীমিত

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৪৯.৪ শতাংশ নারী, অথচ ভূমিতে গ্রামীণ নারীর কার্যকর মালিকানা মাত্র ২ থেকে ৪ শতাংশ। কৃষিতে নারীর সকল প্রতিবন্ধকতার মূলে ভূমিতে সীমিত প্রবেশাধিকার। কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ এবং অবদান উল্লেখযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও ভূমিহীনতা নারীকে প্রান্তিক অবস্থায় নিয়ে দাঁড় করিয়েছে। সেইসঙ্গে গ্রামীণ নারীরা এখনও অপুষ্টির শিকার। এদেশে মায়েদের এক-তৃতীয়াংশ পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। এ কারণে উচ্চতার তুলনায় তাদের ওজন কম। ভূমিতে প্রবেশাধিকার ও নারীর পুষ্টি নিশ্চিত না করা গেলে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাসমূহ যেমন-নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পরিবেশ, সামাজিক উন্নয়ন ইত্যাদি কোন লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। কৃষিতে নারীর কার্যকর অংশগ্রহণ, নারীর ভূমি মালিকানা, নারী কৃষকের স্বীকৃতি, নারী সমবায় ও নারীর পুষ্টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এএলআরডি এবং সাংগাত-এর যৌথ উদ্যোগে সম্প্রতি রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘খাদ্য সার্বভৌমত্ব ও গ্রামীণ নারীর ভূমি অধিকার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় কৃষিতে নারীর বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার চিত্র উঠে আসে। সভায় খাদ্য সার্বভৌমত্ব ও নারীর ভূমি অধিকার বিষয়ক একটি পর্যবেক্ষণপত্র উপস্থাপন করেন এএলআরডি’র উপ-নির্বাহী পরিচালক রওশন জাহান মনি। পর্যবেক্ষণপত্রের তথ্যানুযায়ী উঠে এসেছে দেশের নারীদের পুষ্টিহীনতার চিত্র যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডি ‘বাংলাদেশের নারী ও শিশুস্বাস্থ্য-২০১১’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘পুষ্টি জরিপ-২০১১’-অনুযায়ী দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নারীর পুষ্টিহীনতার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। বাংলাদেশে ৫০ শতাংশের বেশি নারীই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সমন্বিত পুষ্টি প্রকল্প এবং জাতীয় পুষ্টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এসব প্রকল্পের কার্যক্রম সাফল্য পেলেও এখনও আমাদের দেশের বহু নারী পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। ফুড সিকিউরিটি নিউট্রিশনাল সার্ভিলেন্স প্রোগ্রাম (এফএসএনএসপি) ২০১১ এর এক জরিপে দেখা গেছে-বয়সের তুলনায় খর্বাকৃতির কিশোরীর হার ৩২ শতাংশ। বয়সের তুলনায় খর্বাকৃতির নারীর হার ৪২ শতাংশ। খাদ্যে কম অপুষ্টি উপাদান গ্রহণকারী নারীর হার ৬০ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদে শক্তির ঘাটতি আছে এমন নারীর হার ২৫ শতাংশ। কৃষি কাজে নারীর অংশগ্রহণ এবং ক্রমবর্ধমান অন্তর্ভুক্তি, সম্ভাবনা, প্রতিবন্ধকতা, ভূমিতে এবং বাজার ব্যবস্থায় নারীর প্রবেশাধিকার ও দেশে নারীর পুষ্টি পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয়ে এএলআরডি সহযোগী সংস্থার সহায়তায় মাঠপর্যায়ের বাস্তবচিত্র পর্যবেক্ষণের চেষ্টা করছে। এই কাজের অংশ হিসেবে এএলআরডি পার্বত্য অঞ্চল, হাওড় অঞ্চল ও উপকূলীয় অঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকার নারীদের নিয়ে জরিপ করেছে। এতে উঠে এসেছে এসব অঞ্চলের নারীরা অপুষ্টি শিকার। এমনকি তারা কৃষিকাজে অবদান রাখলেও স্বীকৃতি পান না তারা। কারণ বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পুরুষদের হাতে অর্থ চলে যাচ্ছে। আর নারীর হাতে নগদ অর্থ না থাকায় সে নিজের পছন্দের খাদ্য ক্রয় করতে পারেন না। এএলআরডি কর্তৃক পরিচালিত এ মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দেখা যায়-হাওড় অঞ্চলের শনির হাওড় মাটিয়ান এলাকার ৭০ ভাগ নারী দরিদ্র ও ভূমিহীন। এসব এলাকার বেশিরভাগ অংশ জলাশয়, যা আগাম বন্যার সময় থেকে এখন পর্যন্ত রয়েছে। এ অঞ্চলে প্রতিবছরই কমবেশি বন্যা হয়ে থাকে। তবে পরপর গত দুবছরের বন্যায় এখানকার চাষাবাদ একেবারেই বিপন্ন। সেইসঙ্গে এ অঞ্চলে একমাত্র বোরো ধান হয়। এই ফসলকে ঘিরেই এখানকার মানুষের সারাবছরের অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাড়ি-ঘর নির্মাণ অর্থাৎ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়। বর্তমানে মানুষের কোন কর্মসংস্থান নেই অভাব প্রকট। দরিদ্র পরিবারের নারী ও শিশুরা তীব্র খাদ্য ও মানসিক কষ্টে আছে। হাওড় অঞ্চলে বসবাসকারী এক নারী আকলিমা। তিনি নিজেও অপুষ্টির শিকার এমনকি তার সন্তানরাও অপুষ্টিজনিত কারণে প্রায়ই রোগে ভুগছে। সীমাহীন কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে আকলিমা খাতুন বলেন, ‘একদিকে বন্যায় ফসল পানির নিচে, অন্যদিকে, প্রভাবশালীদের কাছে হাওড় ইজারা দেয়ার ফলে আমরা এখন হাওড়ে মাছও ধরতে পারি না। তাই অনেকেই কাজের খোঁজে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাচ্ছে। আমরা ত্রাণ পাই খুবই কম। বিতরণেও অনেক অনিয়ম রয়েছে। আমরা নারীরা ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে থেকেও ত্রাণ পাই না। এছাড়া চারদিকে পানি থাকায় আমরা প্রায় সময়ই অসুস্থ হচ্ছি। নারী, বৃদ্ধ ও শিশুরা কেউই সঠিক চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না।’ অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারীরা অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে তাদের অবস্থান পরিবর্তনে সফল হলেও নারীর ক্ষমতায়ন এখনও স্পষ্ট হয়নি। তবে যেসব নারী খাসজমির মালিকানা পেয়েছেন তারা অবশ্যই ক্ষমতায়নে এগিয়ে গেছেন। নতুন ইউনিয়ন হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়াতে এখানকার বিভিন্ন চরের নারী-পুরুষ স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন। অনেকে গ্রাম পুলিশ হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন, নতুন ইউনিয়ন হওয়াতে সরকারী সেবাও বৃদ্ধি পেয়েছে। আগে একটি ওয়ার্ডের অংশ হিসেবে তারা এসকল সুযোগ পেতেন। বর্তমানে ভিজিডি, ভিজিএফ ও অন্যান্য সেবা আগের তুলনায় বেশি মানুষ ভোগ করতে পারছে। আবার চরের ভূমিহীনদের মধ্য থেকে স্থানীয় সরকার পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় তাদের মাঝে সেবা প্রদানে আন্তরিকতা রয়েছে। তবে এখানেও নারীদের পুষ্টিকর খাদ্য ঘাটতির ফলে অসুস্থতা বৃদ্ধি পচ্ছে এবং অপুষ্ট শিশুর জন্ম হচ্ছে। যারা খাসজমি বন্দোবস্ত পেয়েছে, স্বাভাবিক সময়ে তাদের খাদ্য সঙ্কটের সমস্যা অনেকাংশে লাঘব হয়েছে। যারা খাসজমি পায়নি তারা আরও প্রান্তিক অবস্থানে আছে। তারা খাদ্যসহ অন্যান্য মৌলিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। এদিকে, পার্বত্য অঞ্চলের নারীদের জীবিকার উৎস কমে গেছে বলে জরিপে উঠে আসে। বন-জঙ্গল না থাকায় আগের মতো বন্য শূকর, পশু-পাখি শিকার বন্ধ হয়ে গেছে। নদীর মাছ, জুমের ফসল যেমন-শাক, সবজি, মসলা, ফলমূল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রতিদিনের খাদ্য চাহিদা পূরণের জন্য বাজারের ওপর তাদের নির্ভরশীলতা বেড়ে গেছে। সাজেকে বসবাসকারী তৈমুর চাকমা বলেন, ‘একদিকে ক্রয় করার পর্যাপ্ত সামর্থ্য নাই, অন্যদিকে সহজলভ্যতা না থাকার কারণে খাদ্য তালিকা থেকে মাছ, মাংস, দুধ, ডিম ও অন্যান্য খাবার বাদ পড়েছে। ক্রয় ক্ষমতা না থাকায় আমার পরিবার তিন বেলার পরিবর্তে দুই বেলা বা কোন সময় একবেলা খেয়ে থাকছি। এছাড়া, দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকায় দেখা যায় মাসে একবার মাছ বা মাংস কিনতে পারলেও তা রান্না করার মতো মসলাপাতি, তেল ঘরে থাকে না; আবার কিনলেও পরিমাণ এত কম থাকে যে পরিবারের সকল সদস্যদের খাওয়ার পর নারীর ভাগ্যে তা জোটে না।’ মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা থেকে এএলআরডি’র গবেষণায় কৃষিকাজে নারীদের অবস্থান স্পষ্ট ফুটে উঠেছে-হাওড়াঞ্চলের নারীরা কৃষি কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সকল কাজের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। উপকূলীয় অঞ্চলে দেখা গেছে যে, নারীরা মধ্যবর্তী অবস্থানে কাজ করেন। যেমন- ধান বোনার আগে এবং ধান কাটার পর যত কাজ আছে যা বাড়িতে করা হয় সেসব কাজই তারা করেন। কিন্তু, ধান কাটার কাজ তারা করেন না। পাশাপাশি বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি চাষ করেন। আবার দেখা গেছে যে, অঞ্চলভেদে আদিবাসীদের মধ্যেও তফাত আছে। অনেক আদিবাসী একেবারেই মাঠে কৃষি কাজ করেন না। তবে একটি বিষয় একই যে কোন নারীই বাজার ব্যবস্থায় ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশগ্রহণ নাই। কৃষি আবাদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা নারী কৃষকদের প্রতিবন্ধকতা হলো কোম্পানি, বীজ সংরক্ষণ, সার, কীটনাশক, কৃষি ঋণ, ভর্তুকি এবং অন্যান্য উপকরণ। পর্যবেক্ষণে নারী কৃষকদের মজুরি বৈষম্যের বিষয়টিও স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। কৃষিকাজে সারাদিন পুরুষের সমপরিমাণ শ্রম দিয়েও নারী শ্রমিক মজুরি পান মাত্র ১২০-১৫০ টাকা।
×