ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাবিতে বর্ণাঢ্য মেলা

বাটারফ্লাই হাট, নানা আয়োজন প্রজাপতি দেখতে ভিড়

প্রকাশিত: ০৪:৩৫, ৫ নভেম্বর ২০১৭

বাটারফ্লাই হাট, নানা আয়োজন প্রজাপতি দেখতে ভিড়

দীপঙ্কর দাস প্রজাপতিটা যখন তখন ডানা মেলে উড়ে উড়ে ঘুরে ঘুরে চলে রাঙা মেঘের মতন... গানের সুরে তাল মিলিয়ে এই ওড়াউড়ি ঘোরাঘুরি দেখার জন্য শনিবার দেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে প্রজাপতিপ্রেমীরা ভিড় জমিয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে হাজারো শিশু-কিশোর ও তাদের অভিভাবকরা ক্যাম্পাসে ছুটে আসেন। মেলা উপলক্ষে ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছিল বর্ণিল সাজে। দিনটি দর্শণার্থীদের জন্য সম্পূর্ণ প্রজাপতিময় করে তোলার জন্য জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে ও বিশ^বিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনে মশারির ঘর তৈরি করে তাতে প্রজাপতি ছেড়ে দেয়া হয়। নানা বর্ণের প্রজাপতির ওড়াউড়ি ছিল এ মেলায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনের সামনে স্থাপনকৃত মশারি দিয়ে তৈরি প্রজাপতির ঘরে নানা রঙের প্রজাপতি দেখে প্লের শিশু শিক্ষার্থী মাঈশার হৈ-হুল্লোড় আর উল্লাস থামছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র চিন্ময় জানায়, পত্রিকায় প্রজাপতি মেলার খবর পড়ে এ মেলায় আসার জন্য সে তার মাকে রাজি করিয়েছে। আজ সকালটি তার ভীষণ ভাল লাগছে। এখানে কত সুন্দর সুন্দর প্রজাপতির দেখা মিলেছে। ঢাকা উত্তরা থেকে তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্র নিসর্গ তার মার সঙ্গে এসেছে প্রজাপতি মেলায়। শুধু দেখেই তার মন ভরেনি, নিসর্গ প্রজাপতিগুলো বাসায় নিয়ে যেতে চায়। মেলায় ঘুরতে আসা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী জয়ন্ত সরকার বলেন, অনেক দিন ক্যাম্পাসে আসা হয় না। ছুটির দিনে ক্যাম্পাসে প্রজাপতি মেলার খবর পেয়ে সুযোগ হাতছাড়া করিনি। ভালই লাগছে প্রজাপতির ওড়াউড়ি ঘোরাঘুরি দেখতে। ‘উড়লে আকাশে প্রজাপতি, প্রকৃতি পায় নতুন গতি’ এই স্লোগানকে ধারণ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অষ্টমবারের মতো অনুষ্ঠিত হয়ে গেল ‘প্রজাপতি মেলা-২০১৭’। শনিবার বেলা ১১টায় প্রধান অতিথি হিসেবে মেলা উদ্বোধনকালে জাবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম বলেন, মানুষ ও প্রকৃতির মাঝে প্রজাপতি ঘনিষ্ঠভাবে মিশে আছে। প্রজাপতির সৌন্দর্য মনকে আন্দোলিত করে। প্রজাপতির সঙ্গে প্রকৃতির কি সম্পর্ক, পরাগায়নে প্রজাপতি কি সাহায্য করে তা আমরা এ প্রজাপতি মেলার মাধ্যমে জানতে পারছি। প্রজাপতি প্রকৃতির কোন উপকার করে কিনা, তা না জেনেই আমরা প্রজাপতির পেছনে ছুটি ভাল লাগার কারণে। এ মেলার কারণে প্রজাপতি ও প্রজাপতির উপকার সম্পর্কে মানুষের মধ্যে জানার আগ্রহ তৈরি হচ্ছে। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাবি কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক শেখ মোঃ মনজুরুল হক, আইইউসিএনের (ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব ন্যাচার) বাংলাদেশ প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি এবং মেলার উদ্যোক্তা অধ্যাপক ড. মনোয়ার হোসেন বলেন, প্রকৃৃতির ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাপতি এবং অন্যান্য পোকা-মাকড়ের যেসব ইতিবাচক ভূমিকা রয়েছে সেসব তুলে ধরে গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এ আয়োজন। শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাপতির ভূমিকা তুলে ধরার জন্য আয়োজন করা হয়েছিল শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। নার্সারি থেকে ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত কয়েকটি ক্যাটাগরিতে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে আয়োজন করা হয় প্রজাপতি আকৃতির ঘুড়ি উড়ানোর। প্রজাপতি মেলায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় প্রজাপতির ভূমিকা তুলে ধরে স্বল্পদৈর্ঘের প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়েছে। এছাড়া প্রজাপতির আলোকচিত্র প্রদর্শনী, প্রজাপতি বিষয়ক কুইজ ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এছাড়া ছিল ‘বাটারফ্লাই হাট’। জীবন্ত প্রজাপতির জীবন ও বংশবৃদ্ধি সম্পর্কে জানানোর জন্য এই হাটের আয়োজন করা হয়েছিল। মেলা শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের জহির রায়হান মিলনায়তনে প্রতিযোগিতার বিজয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়। এবারের মেলায় প্রজাপতির চোখ এবং কালার ভিশনের গবেষণায় সার্বিক অবদানের জন্য জাপানের গ্র্যাজুয়েট ইউনিভার্সিটি ফর এ্যাডভান্সড স্টাডিজের অধ্যাপক কেনটারো আরিকাওয়াকে ‘বাটারফ্লাই এ্যাওয়ার্ড-২০১৭’ প্রদান করা হয়। এছাড়া ‘ইয়াং বাটারফ্লাই এনথুসিয়াস্ট এ্যাওয়ার্ড’ দেয়া হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যায়ের লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আফলাতুন কায়সারকে। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে ২০১০ সাল থেকে জাবিতে প্রতিবছর অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ব্যতিক্রমী এই প্রজাপতি মেলা। দৃষ্টিনন্দন এ পতঙ্গটির বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে অধ্যাপক মনোয়ার হোসেনের উদ্যোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের পাশে তৈরি করা হয়েছে ‘প্রজাপতি পার্ক’। এ প্রজাপতি পার্কে কৃত্রিমভাবে প্রজাপতি প্রজনন ঘটিয়ে ক্যাম্পাসে অবমুক্ত করা হয়। যা ক্যাম্পাসের সৌন্দযকে আরও বৃদ্ধি করেছে। মেলার আহ্বায়ক ড. মনোয়ার হোসেন জানান, ১৯৯৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ইসমাইল হোসেনের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রজাপতি নিয়ে প্রথম গবেষণার কাজ শুরু করি। দীর্ঘ ২১ বছর গবেষণা করে এ পর্যন্ত ১৫০টির বেশি প্রজাতির প্রজাপতি শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। প্রজাপতির নতুন নতুন প্রজাতির সন্ধান মিললেও দেশে প্রজাপতির সংখ্যা দিন দিন কমছে। বনভূমি কমে যাওয়ায় প্রকৃতির এ অলঙ্কারটির অস্তিত্ব এখন হুমকির মুখে। বাংলাদেশে প্রজাপতির সবক’টি প্রজাতির তালিকা তৈরির পাশাপাশি এদের সংরক্ষণে সরকারী-বেসরকারী গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর এগিয়ে আসা উচিত। তিনি বলেন, এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রজাপতির প্রায় ২০০টির বেশি প্রজাতি শনাক্ত করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘প্লেন টাইগার’, ‘কমন ক্রো’, প্লেম জুডি’, ‘ডিঙ্গি বুশব্রাউন’, ‘কমন ডাফার’, ‘এপফ্লাই’, ‘পি ব্লু’, ‘টাইনি গ্রাস ব্লু’, ‘ওয়েক ব্লু’, ‘কমন সেইলর’, ‘কমন রোজ’, ‘ব্লু মরমন’, ‘স্ট্রাইপড এ্যালবাট্রস’, ‘মটিলড ইমিগ্রান্ট’, ‘কমন গ্রাস ইয়েলো’, ‘স্ট্রাইপড পাইরট’, ‘মানকি পাজল’, ‘ব্লু প্যানসি’ ও ‘পেইন্টেড লেডি’।
×