ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

কৃত্রিম বুদ্ধি যেখানে নিজেই সমাধান দেয়

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৫ নভেম্বর ২০১৭

কৃত্রিম বুদ্ধি যেখানে নিজেই সমাধান দেয়

গো নামে একটি খেলা চীন, জাপান ও কোরিয়ায় এমন এক স্থান দখল করে আছে যা পাশ্চাত্যে দখল করে আছে দাবা। গত বছর সিউলে এক প্রতিযোগিতায় বিশ্বের অন্যতম সেরা গো খেলোয়াড় লি সিডল আলফাগো নামে এক কম্পিউটার প্রোগ্রামের কাছে ৪-১ গেমে হেরে যায়। গো’র ইতিহাস ও কৃত্রিম বুদ্ধির ইতিহাসে এ এক বিশাল ঘটনা। এরপর আলফা গো অনলাইনে এই খেলায় বেশ কয়েক ডজন নামজাদা খেলোয়াড়কে হারিয়ে দিয়েছে। শেষে গত মে মাসে বিশ্বের সেরা গো খেলোয়াড় চীনের কি জাইকে ও ৩-০ তে হারিয়ে দেয়। এর বেশকিছু আগে ১৯৯৭ সালে বিশ্বের সেরা দাবারু গ্যারি কাসপারও ডিপব্লু নামে এক আইবিএম কম্পিউটারের কাছে দাবা খেলায় হেরে যান। তবে আলফাগোর কৃতিত্বটা আরও অনেক বেশি। কারণ আলফাগো বিশেষজ্ঞ খেলোয়াড়দের হাজার হাজার খেলা পর্যালোচনা করে গো খেলা শিখেছে। ওসব খেলা থেকে নিয়মকানুন ও স্ট্র্যাটেজি বের করে নিয়ে এই কম্পিউটার প্রোগ্রামটি নিজের সঙ্গে আরও লাখ লাখ ম্যাচ খেলে ‘সেইসব নিয়মকানুন ও স্ট্র্যাটেজিকে আরও উন্নত এবং পরিশীলিত করেছে। তার ফলে এটি যে কোন মানব খেলোয়াড় থেকে অধিকতর শক্তিশালী হয়েছে। তারপরও আলফাগোর প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ডিপ মাইন্ড আস্থার সঙ্গে মনে করে তারা এই প্রোগ্রামকে আরও উন্নত করতে পারে। তারা আলফাগো জিরো নামে প্রোগ্রামের সর্বশেষ সংস্করণ বের করেছে। এটা আরও উন্নত। আরও দ্রুত খেলা শিখে নিতে পারে এবং খেলায় ভাল করার জন্য অনেক কম কম্পিউটিং হার্ডওয়্যারের প্রয়োজন হয়। সবচেয়ে বড় কথা, আলফা জিরো নিজেই নিজেকে খেলা শেখাতে সক্ষম হয়েছে যেটা মূল সংরক্ষণটি পারেনি। এক্ষেত্রে কোন মানব বিশেষজ্ঞের সাহায্য লাগেনি। সেরা যতগুলো খেলা আছে সেগুলোর মতো গো খেলাটিও শেখা সহজ তবে পারদর্শিতা অর্জন করা কঠিন। বিশেষজ্ঞ খেলোয়াড়রা উচ্চতর পর্যায়ে খেলাটি বোঝার উপর দৃষ্টি নিবন্ধ করেন। গোর সহজ নিয়মকানুন থেকে উৎপন্ন হয় বেশকিছু কাঠামো। খেলোয়াড়রা ‘চোখ’ ও ‘মই’য়ের মতো বৈশিষ্ট্যগুলোর কথা বলেন, তেমনি বলেন ‘হুমকি’ ও ‘জীবন-মৃত্যুর’ কথা। তবে মানব খেলোয়াড়রা এসব কনসেপ্ট বুঝতে পারলেও হাইপার লিটারেল উপায়ে সেগুলো ব্যাখ্যা করার জন্য একটা কম্পিউটারের যে প্রোগ্রাম করা প্রয়োজন তা অনেক কঠিন। সেজন্য আদি আলফাগো মানুষের হাজার হাজার খেলার দৃষ্টান্ত পর্যালোচনা করেছে। এই প্রক্রিয়াকে বলে সুপারভাইজড লার্নিং। যেহেতু, মানুষের খেলায় এসব কনসেপ্ট সম্পর্কে মানব উপলব্ধির প্রতিফলন ঘটে তাই একটা কম্পিউটার এ ধরনের প্রচুর খেলার সংস্পর্শে এলে সেটিও এসব কনসেপ্ট বুঝতে পাবে। একবার আলফাগোর মানব শিক্ষকদের সহায়তায় কৌশল ও স্ট্র্যাটেজিগুলো সুন্দরভাবে রপ্ত করে নিলে সেটি এই নির্ভরশীলতা থেকে বেরিয়ে আসে এবং নিজের সঙ্গে তদারকবিহীন লাখ লাখ ট্রেনিং গেম খেলে প্রতিটি খেলায় নিজের দক্ষতা বাড়িয়ে তোলে। তদারকি শিক্ষার প্রয়োজন আছে। কৃত্রিম বুদ্ধির সাম্প্রাতিক অনেক অগ্রগতির পেছনে এটা হলো মৌলিক ধারণা। এটি কম্পিউটারকে ছবির চেহারা শনাক্ত করা, মানুষের কথা নির্ভরযোগ্যভাবে চিনতে পারা, ই-মেইল থেকে স্পাম দক্ষতার সঙ্গে ছেঁকে তোলার মতো আরও অনেক কাজ শিখতে সাহায্য করে। তবে ডিপমাইন্ড কোম্পানির প্রধান ডেমিস হাসাবিস মনে করেন যে তদারকি শিক্ষার সীমাবদ্ধতা আছে। সেজন্যই এসব সীমাবদ্ধতা এড়াতে উদ্ভাবন করা হয়েছে আলফাগো জিরো। এখানে ট্রেনিংয়ের গোটা পর্বটাই ডিঙ্গিয়ে যাওয়া হয়। এক্ষেত্রে কম্পিউটারের যে প্রোগ্রাম রয়েছে সেটি শুরুই হয়েছে শুধু খেলার নিয়মকানুন দিয়ে এবং সে সঙ্গে রয়েছে রিয়ার্ড ফাংশন। একটা খেলায় জিতলে এক পয়েন্ট দেয়া হয় এবং হারলে থাবার ঘরে বসে এক পয়েন্ট। তারপর কম্পিউটারকে খেলা নিয়ে নানা পরীক্ষা চালাতে উৎসাহিত করা হয়। তার নিজেরই অন্যান্য ভার্সনের বিরুদ্ধে বার বার খেলানো হয়। কম্পিউটারের জন্য একটা বাধ্যবাধকতা হলো তাকে যত বেশি সম্ভব খেলায় জিতে নিয়ে নিজের রিওয়ার্ডকে যথাসম্ভব বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে। আমরা কিভাবে হাঁটতে, কথা বলতে, সাইকেলে চড়তে শিখেছি? সবার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই একই রকম হয়েছে উল্টোপাল্টা ও ভুলে ভরা। কিন্তু যতই দিন গেছে আমাদের দক্ষতা ধীরে ধীরে রপ্ত হয়েছে। প্রাণী জগতের বাইরে এখন কম্পিউটার এলগোরিদমের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। এরা বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা লাভ করছে। কৃত্রিম বুদ্ধি এখন পরিপার্শ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়ার মতো আচরণ করছে। আলফাগো জিরোই তার দৃষ্টান্ত। এই কম্পিউটার প্রোগ্রাম নিজে নিজেই শিখছে। মানুষের কোন জ্ঞান ছাড়া, মানব সম্পর্কিত কোন ড্যাটা বা বৈশিষ্ট্য কিংবা দৃষ্টান্ত ছাড়া অথবা মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই শুধুমাত্র নিজে নিজে খেলে খেলে শিখছে। নিজের বিরুদ্ধে লাখ লাখ গো গেমের সিমুলেশন পরিচালনা করে আলফাগো-জিরোকে শূন্য থেকে শিখতে এবং কিভাবে নিজ সংস্করণের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নকে হারাতে হয় সেই কৌশল রপ্ত করেছে। এ এক দারুণ ঘটনা। শুধু গো খেলার ক্ষেত্রে নয়, নতুন জ্ঞান কিভাবে আবিষ্কার ও করায়ত্ত করা যায় সে ব্যাপারেও বিস্ময়কর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আলফাগোর পেছনে প্রকৃত ধারণাটা খেলায় মানুষকে পরাজিত করা নয়, বরং এই কৃত্রিম বুদ্ধিকে কিভাবে মানুষের কাজে ব্যবহার করা যায় সেই পথের সন্ধান বের করা। ইতোমধ্যে কণ্ঠস্বর চেনা ও ছবি শ্রেণী-বিন্যস্ত করা থেকে শুরু করে জেনোমিক্স ও ওষুধ আবিষ্কারসহ নানা ক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধির গবেষণায় দ্রুত অগ্রগতি ঘটেছে। এখন আলফাগো জিরোর দৃষ্টান্ত থেকেই বোঝা যাচ্ছে যে, এমন এলগোরিদম সৃষ্টি করা সম্ভব যা কিনা মানুষের কোনরকম সাহায্য বা ইনপুট ছাড়াই কৃত্রিম বুদ্ধি অতি চ্যালেঞ্জপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে অতি মানবিক পারদর্শিতা দেখাতে পারে। আলফাগো জিরো শেখার এক অভিনব কৌশলকে কাজে লাগিয়েছে। সে নিজেই হয়েছে নিজের শিক্ষক। শূন্য থেকে গো খেলা শিখে নিয়ে সেটি এই খেলা সম্পর্কিত সহস্র বছরের পুঞ্জিভূত মানব জ্ঞান মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে করায়ত্ত করেছে, প্রচলিত ধারার বাইরে নতুন কৌশল উদ্ভাবন করেছে, নতুন জ্ঞান অর্জন করেছে এবং এমন সব সৃজনশীল নতুন নতুন চাল বের করেছে যা সেরা সেরা মানব খেলোয়াড়দের বিরুদ্ধে তার খেলার আগে ব্যবহৃত অভিনব কৌশলকেও ছাড়িয়ে গেছে। আলফাগো জিরোর এই সাফল্য দেখিয়ে দিচ্ছে যে, মানবজাতি সবচেয়ে বড় ধরনের যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন তার কয়েকটি কৃত্রিম বুদ্ধির দ্বারা মোকাবেলা করা খুবই সম্ভব। এমন এলগোরিদমও হয়ত একসময় বের করা যাবে, যা যে কোন ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা সম্ভব। ভেবে দেখুন তো, একসেট অতি শক্তিশালী এলগোরিদমের কথা যা কঠিন কঠিন সমস্যার অতি সহজ সমাধান এনে দিতে পারে এবং মানব সভ্যতার পুঞ্জিভূত জ্ঞান এতই দ্রুতগতিতে রপ্ত করতে পারে যে তার জন্য কয়েক দশক নয় মাত্র কয়েক দিনের প্রয়োজন পড়ে? আলফাগো জিরোর অর্জনটা রীতিমতো শিহরণমূলক। এ মুহূর্তে যদিও এই এলগোরিদম সাধারণ নিয়মভিত্তিক খেলার মধ্যে আবদ্ধ, তথাপি রসায়ন, জীববিজ্ঞান, ফার্মোকোলজি, ট্রাফিক, ট্রাভেল, লজিস্টিক ও ম্যানুফেকচারিং শিল্পসহ বিভিন্ন শিল্পে যদি সেই ধরনের এলগোরিদম উদ্ভাবন করা যায়, তাহলে দেখা যাবে কৃত্রিম বুদ্ধি নিজেই নতুন নতুন সিস্টেমের পরিকল্পনাও উদ্ভাবন করছে। এসব সিস্টেমের কোন বাইরের ড্যাটা প্রয়োজন হবে না। কোন মানব ইনপুট লাগবে না। সে নিজেই শিখবে এবং সমস্যার সমাধান দেবে। কৃত্রিম বুদ্ধি ভবিষ্যতে আমাদের এক বিস্ময়কর জগতে নিয়ে যাবে না কি? সূত্র : দি ইকোনমিস্ট ও অন্যান্য
×