ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মোস্তাফা জব্বার

একুশ শতক ॥ উৎপাদক ও রফতানিকারকের দেশে

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৫ নভেম্বর ২০১৭

একুশ শতক ॥ উৎপাদক ও রফতানিকারকের দেশে

॥ দুই ॥ প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বস্তুত একটি জাতীয় দিক-নির্দেশনা প্রদান করেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়কে অফিসিয়ালি কিছু সুপারিশ করেছে। এই বিভাগের সাবেক সচিব শ্যামসুন্দর সিকদার ৩০ মার্চ ১৬ অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সরকারের সচিবদের বৈঠকে যে ধরনের প্রস্তাবনা পেশ করেছিলেন সেটি হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের এই সময়ে এখন প্রয়োজন দেশীয় পণ্যকে পৃষ্ঠপোষকতা করা।’ তার বক্তব্যের মূল সুর ছিল, ৯৮/৯৯ সালের বাজেটে কম্পিউটারের শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহারের ফলে কম্পিউটারের ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু এখন সেই চাহিদা পূরণে হাজার হাজার কোটি টাকা আমদানি ব্যয় হচ্ছে। আগামীতে দেশের সরকারী অফিস-আদালত ও ছাত্র-ছাত্রী-শিক্ষার জন্য ডিজিটাল ডি-ভাইস দিতে হলে লক্ষ কোটি টাকার আমদানি করতে হবে। এখন প্রয়োজন স্মার্ট ফোন, ট্যাব, কম্পিউটারের দেশীয় উৎপাদনকে সহায়তা করা। আমাদানিকারক থেকে উৎপাদকে পরিণত হওয়া। ৬ আগস্ট ১৫ প্রধানমন্ত্রী ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভায় সেই কথাই বলেছেন। ক. এর জন্য সম্পূর্ণ উৎপাদিত কম্পিউটার পণ্যের ওপর করারোপ ও ভ্যাট আদায় করা যায়। যন্ত্রাংশ বা কাঁচামালকে শুল্ক ও ভ্যাট মুক্ত করা যায়। এতে দেশের রাজস্ব বাড়বে এবং ডিজিটাল যন্ত্র দেশে উৎপাদিত হবে। বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে। খ. সফটওয়্যারের মতো হার্ডওয়্যার উৎপাদনকেও কর সুবিধা প্রদান করা যায়। গ. সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিদেশী ব্র্যান্ড কেনার বদলে দেশীয় ব্র্যান্ড ডিজিটাল ডিভাইস কেনার বিধান করা যায়। এর মান পরীক্ষা করার দায়িত্ব আইসিটি ডিভিশন নিতে পারে। সচিব মহোদয় দেশীয় সফটওয়্যারের বিষয়েও তার বক্তব্য পেশ করেন। তিনি বলেন, ‘দেশীয় সফটওয়্যার ও সেবা খাত বড় হতে পারছে না কারণ তারা দেশে কাজ করতে পারে না। বিদেশী সহায়তার বড় প্রকল্প করার ক্ষমতা তাদের নেই-টেন্ডারেও ওরা অংশ নিতে পারে না। সরকারী কাজে দেশী প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’ প্রসঙ্গত তিনি এই কাজগুলোর সমন্বয়ের দায়িত্ব আইসিটি বিভাগকে দেবারও অনুরোধ করেন। সচিব মহোদয় অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাবার পর বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সঙ্গে কথা বলেন এবং সমিতির পক্ষ থেকে ৩১ মার্চ ১৬ অর্থমন্ত্রী, আইসিটি বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমদ পলক ও আইসিটি বিভাগের সচিব শ্যামসুন্দর সিকদারের কাছে একটি পত্র লেখা হয় এবং তাতে দেশীয় শিল্পকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়। সমিতির সাবেক সভাপতি এ এইচ এম মাহফুজুল আরিফ স্বাক্ষরিত এই পত্রে যেসব প্রস্তাবনা পেশ করা হয় সেগুলো হচ্ছে; ১. ডিজিটাল পণ্য তথা কম্পিউটার/ল্যাপটপ/ট্যাব উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় বেশ কয়েকটি মৌলিক যন্ত্রাংশ। এগুলো কোনো দেশ বা কোম্পানি এককভাবে সবগুলো যন্ত্রাংশ উৎপাদন করে না। সবাই কারও না কারও পণ্য সংগ্রহ করে। আমাদের দেশের ক্লোন পিসি যারা বানান তারা এসব পণ্য আমদানি করে এ্যাসেম্বেলের মাধ্যমে নিজস্ব ব্র্যান্ড নামে বা নাম ছাড়া বাজারে অবমুক্ত করে। ফলে দেশের কম্পিউটার হার্ডওয়্যার শিল্প গড়ে তুলতে গেলে এসব যন্ত্রাংশ আমদানি পর্যায়ে ধার্যকৃত শুল্কমুক্ত সুবিধা চালু করা দরকার। ২. ডিজিটাল পণ্য উৎপাদনের জন্য আধুনিক মানের প্লান্ট স্থাপন করতে হলে প্রয়োজন সুবিধাজনক জমি। তাই আমরা আশা করব, সকল ইউটিলিটি সুবিধা দিয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণাধীন হাইটেক পার্কে এ জন্য উৎপাদক কোম্পানিগুলোকে পর্যাপ্ত জায়গা বরাদ্দ দেয়া হবে। ৩. বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি দেশী ব্র্যান্ডের আইটি পণ্যকে ভোক্তা পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে মূল্য সংবেদনশীলতাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। তাই আইটি পণ্য ও সেবা উৎপাদককারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি বিক্রির আগেই উৎপাদিত পণ্যে অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট (এটিভি) দিতে হয় তবে তা শুধু চ্যালেঞ্জেরই নয়, বিনিয়োজিত পুঁজি ঝুঁকিরও মুখে পড়ে। ৪. স্থানীয় বাজারে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করার স্বার্থে ভোক্তা পর্যায়ে এসব পণ্যকে সহজলভ্য করে তুলতে হলে দেশী উৎপাদিত পণ্য খুচরা পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রির ক্ষেত্রে সকল প্রকার ট্যাক্স ও ভ্যাট মুক্ত রাখতে হবে। ৫. দেশী উৎপাদক আইটি কোম্পানিগুলো যেন চাপমুক্ত হয়ে পণ্য বাজারজাতকরণে প্রণোদনা চালাতে পারে এবং দ্রুত বাজার সম্প্রসারণ করতে পারে সেজন্য তাদের অর্জিত আয়কে করমুক্ত রাখার দাবি জানাচ্ছি। ৬. দেশে ব্যবসারত আইটি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদক প্রতিষ্ঠানে মানোন্নয়নের ক্ষেত্রে অন্তত ১০ বছরের জন্য ট্যাক্স হলিডে সুবিধা চালু করা দরকার। ৭. একইভাবে এই খাতকে পোশাক শিল্পখাতের মতো সমৃদ্ধ করতে হলে দেশে উৎপাদিত আইটি পণ্যে রফতানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ ক্যাশ ইনসেনটিভ চালু করতে হবে। ৮. আমাদের দেশে শ্রমিক/কর্মীর প্রাচুর্য থাকলেও প্রযুক্তি দক্ষ মানবসম্পদ মোটেই সমৃদ্ধ নয়। ডিজিটাল শিল্পায়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান এই বাধা অতিক্রমের জন্য কারিগরি ও ব্র্যান্ডিং বিষয়ে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য একটি বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা যেতে পারে। ৯. সর্বোপরি দেশের বাজার পেরিয়ে বাংলাদেশ ব্র্যান্ড আইটি পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ধরতে সিবিট- এর মতো আন্তর্জাতিক মেলাগুলোতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা কামনা করি। এসব প্রস্তাবনায় মূলত উৎপাদিত পণ্যের যন্ত্রাংশ আমদানি শুল্ক, উৎপাদিত পণ্যের ওপর এটিভি, খুচরা পর্যায়ে সরবরাহ ও বিক্রির ওপর শুল্ক ও কর ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের আয়কর খাতে শূন্য ব্যবস্থা প্রচলনের অনুরোধ করা হয়। এছাড়াও ১০ বছরের কর রেয়াত, শতকরা ৫ ভাগ নগদ ইনসেনটিভ, বিশ্বমেলাসমূহে শতভাগ সমর্থন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপনের দাবি করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক দিক হলো, সেবারের বাজেটে এসব সুপারিশের কোন প্রতিফলন ঘটেনি। ফলে ডিজিটাল যন্ত্র স্বদেশে উৎপাদন করার সুবিধাজনক অবস্থাটি তখন হয়নি। বিষয়টি এরপর সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে তুলে ধরা সম্ভব হয় ১৬ সালের ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। বেসিস এর পক্ষ থেকে আমি যে বিষয়গুলোকে প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনতে সক্ষম হই সেটির শীর্ষস্থানে ছিলো আমদানিকে নিরুৎসাহিত করে দেশের উৎপাদনকে সহায়তা করা। এসব প্রস্তাবনা নিয়ে ২০১৭ সালে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ ও বেসিসসহ দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বাণিজ্য সংগঠনগুলো তাদের ১৭-১৮ সালের বাজেট প্রস্তাবনায় দেশীয় উৎপাদনকে সুরক্ষা দেবার দাবি তুলেছে। আমাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল আমদানি করা পণ্যের দাম ছিল যন্ত্রাংশের চাইতে বেশি। মোবাইলের যন্ত্রাংশ আমদানিতে শতকরা ৩৭ ভাগ শুল্ক থাকলেও পুরো মোবাইল সেটের ওপর শুল্ক ছিল শতকরা মাত্র ৫ ভাগ। এর ফলে দেশে মোবাইল সংযোজন করাও সম্ভব ছিল না। এবার ১৭-১৮ সালের বাজেটে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেয়া হয়। কর কাঠামো ব্যাপক পরিবর্তনের ফলে এখন দেশে ডিজিটাল যন্ত্র উৎপাদন করা একটি লাভজনক বিষয়। তবে সুখের বিষয় হচ্ছে এবারের বাজেটের জন্য বাংলাদেশ বসে থাকেনি। এরই মাঝে দেশের অন্যতম প্রধান ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদক ওয়ালটন ৯ সেপ্টেম্বর ১৬ থেকে দেশী ওয়ালটন ব্র্যান্ডের ল্যাপটপ বাজারে ছেড়েছে। ল্যাপটপটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে ২২ সেপ্টেম্বর ১৬। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এর উদ্বোধন করেন। একই প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে ল্যাপটপ উৎপাদনের কারখানা তৈরি করছে। আগামী ডিসেম্বরে এটি চালু হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরই মাঝে ওয়ালটন তাদের স্মার্ট ফোন উৎপাদন শুরু করেছে। উই মোবাইল কোম্পানি নবেম্বরে তাদের কারখানা চালু করছে। সিম্ফনি তাদের কারখানা চালু করতে যাচ্ছে। এমনকি বিশ্বখ্যাত কিছু ব্র্যান্ডও দেশে কারখানা স্থাপনের কথা ভাবছে। ওয়ালটন পুরো বিষয়টিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। তারা এখন ট্যাব-কীবোর্ড, মাউস, পেনড্রাইভ, ডেস্কটপ পিসি বাজারজাত করছে। এমনকি তারা স্মার্ট টিভি এবং আইওটি ফ্রিজ বাজারজাত করছে। এবারের বাজেটে তথ্যপ্রযুক্তি পণ্যকে রফতানি ক্ষেত্রে সহায়তা দেবার যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেবার ফলে কেবল যে দেশীয় কল কারখানার জন্য সহায়ক হয়েছে সেটাই নয়, বরং আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত প্রতিষ্ঠানগুলোও এখানে উৎপাদন করে বাইরে রফতানি করার ক্ষেত্রে উৎসাহ পাবে। এর ফলে দেশটি আমদানিকারক থেকে উৎপাদক ও রফতানিকারকের দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে। আমি মনে করি, এরই ধারাবাহিকতায় আমরা শিল্পযুগের তিনটি স্তর মিস করেও চতুর্থ স্তরে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় রাখতে পারব। (সমাপ্ত)
×