ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দেশব্যাপী মাদকবিরোধী ক্র্যাকডাউন শুরু, গডফাদার গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ৪ নভেম্বর ২০১৭

দেশব্যাপী মাদকবিরোধী ক্র্যাকডাউন শুরু, গডফাদার গ্রেফতার

আজাদ সুলায়মান ॥ জন্ম তার পঁচিশে জানুয়ারি। নামটাও পঁচিশ। আবার ব্যবসা শুরু করেছেন পঁচিশে জানুয়ারি; যখন তার বয়স পঁচিশ। এভাবেই নিজেকে বিখ্যাত করার খায়েশ নিয়ে তিনি পা রাখেন অন্ধকার জগতে। মোহম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পেই তার জন্ম, বেড়ে ওঠা আর বিপথগামী হওয়া। মাত্র চার বছরেই পেয়ে গেছেন রাজধানীর অন্যতম শীর্ষ ‘মাদক স¤্রাট’ খেতাব। শুক্রবার তাকে যখন আটক করা হয় তখনও তার হুঙ্কার থামেনি। এমন ভাব দেখাচ্ছিলেন যেন এসব আর কি? জীবনে কতবার ধরা পড়লাম, জেলে গেলাম, বের হয়ে এলাম। এসব তো মাছ-ভাত! পঁচিশের এমন ঔদ্ধত্য দেখে হতবাক যৌথবাহিনীর কর্তারা। ঘটনাস্থলে থাকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক ড. জামাল উদ্দিন আহমদ জনকণ্ঠকে বলেন, আজ (শুক্রবার) থেকে রাজধানীসহ দেশব্যাপী শুরু হলো মাদকের গডফাদার ধরার যৌথ অভিযান। এতে অংশ নিয়েছে মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি, এপিবিএন ও আনসার। প্রথম দিনেই ঢাকা ও চট্টগ্রামে ধরা পড়েছে ৮। তাদের মধ্যে একজন গডফাদার। অভিযানের শুরুটা শুক্রবার সকাল নয়টায়। এসব বাহিনীর প্রায় তিন শ’ সদস্য মোহম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্প চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। মহাপরিচালক জামালের নেতৃত্বে যৌথবাহিনী একদিক থেকে ভেতরে প্রবেশ করে। তার হাতে গডফাদারদের তালিকা। সঙ্গে ছিল মোহম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পের নক্সা ও পঁচিশের তিন বাসার অবস্থান। পঁচিশের প্রথম বাসায় গিয়ে তার সন্ধান মেলেনি। দ্বিতীয় বাসাতেও দেখা না পেয়ে হতাশ মহাপরিচালক। তবে দ্বিতীয় বাসাতে পাওয়া যায় পঁচিশের এক খালুকে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তাৎক্ষণিক তিনি সহযোগিতার আশ্বাস দেন। জানালেন পঁচিশ ঘরেই আছে। তৃতীয় ঘরেই পাওয়া যাবে। ওই খালুকে নিয়ে পঁচিশের তৃতীয় ঘরের চারদিক ঘেরাও। দরজায় আস্তে টোকা দেন খালু। ভেতর থেকে আওয়াজÑ কে? আমি তোর খালু। দরজা খোল। মুহূর্তেই দরজা খুলে দেয় পঁচিশ। খপ করে বাজপাখির মতো ছোবল মেরে ধরে ফেলা হয় তাকে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই পঁচিশ যৌথবাহিনীর কব্জায়। সঙ্গে সঙ্গে চালানো হয় তার ঘরে তল্লাশি। ঘরেই মেলে কিছু ইয়াবা ও বিক্রির টাকা। আটকের পর তাকে নিয়ে ক্যাম্পের অন্যান্য কয়েকটি ঘরেও চালানো হয় অভিযান। পঁচিশকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই মাদক সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য পায় মাদক বিভাগ। মাদকের মুখপাত্র কামরুল ইসলামের ভাষ্যমতে পঁচিশ জানায়, গুলিস্তান ফায়ার সার্ভিসের পেছনের একটি বাড়িতে ফেনসিডিলের বড় আড়ত আছে। সেখানে গেলে পাওয়া যাবে আরও অনেক কিছু। এ সময় মাদকের উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা, সহকারী পরিচালক খোরশেদ আলম ও গুলশানের পরিচালক মোজাম্মেল হোসেন বাহিনীসহ ছুটে যান গুলিস্তান। ফায়ার সার্ভিসের পেছনের একটি আস্তানায় চলে তল্লাশি। এখানে পাওয়া যায় ৭ শ’ বোতল ফেনসিডিল ও দুই মাদক ব্যবসায়ীকে। সন্ধ্যায় এ রিপোর্ট লেখার সময় যৌথবাহিনীর আরেকটি টিম অভিযান চালাচ্ছিল গুলশানের একটি অভিজাত বাড়িতে। চট্টগ্রামের পরিদর্শক সামসুল কবিরের নেতৃত্বেও অভিযান চালিয়ে সাড়ে ১৪ হাজার ইয়াবাসহ ৫ মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়। পঁচিশ সম্পর্কে কামরুল ইসলাম জানালেন, মোহম্মদপুর বিহারী ক্যাম্প রাজধানীর বৃহৎ মাদক আড়ৎ। এখানে এমন কোন মাদক নেই যা মেলে না; মদ, গাঁজা, চরস, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ সবই। এর গডফাদার হিসেবে পঁচিশ এতদিন ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল। এই ক্যাম্প এত বড় যে এখানে শুধু একা মাদকের টিম দিয়ে অভিযান চালানোটা সম্ভবপর নয়। এর আগে যখনই এখানে অভিযান চালানো হয়েছে ভেতর থেকে এই পঁচিশ প্রতিরোধের জন্য হামলা চালিয়েছে। এতে অনেক টিমের অনেকেই আহত হয়েছে। গ্রেফতারকৃত পঁচিশ এর আগেও বেশ কবার ধরা পড়েছে। কিন্তু জামিনে বের হয়ে আবার মাদক সা¤্রাজ্যের হাল ধরেছে। এবার মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তৈরিকৃত সারাদেশের মাদকের গডফাদারদের তালিকার শীর্ষে ছিল তার নাম। এখন তাকে জিজ্ঞাসাবাদে বের হয়ে আসবে কারা তার সহযোগী এবং কোথা-কিভাবে মাদক এনে এখানে ব্যবসা করছে। মাদকের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ জানান, একযোগে সারাদেশে শুরু হয়েছে মাদক বিরোধী অভিযান। ১১ শ’ মাদক আস্তানায় ১৮৪ গডফাদার ও ২ হাজার চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর একটি তালিকা হাতে নিয়েই মাঠে নেমেছে এ বাহিনী। মাদকের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন জানিয়েছেন, এটাই হচ্ছে একযোগে চালানো প্রথমবারের মতো যৌথ অভিযান। আশা করা হচ্ছে, দেশের শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা ধরা পড়বে। তাদেরকে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে মোট ১১শ’ মাদক আস্তানা রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি রয়েছে সীমান্তবর্তী কক্সবাজার, টেকনাফ, সাতক্ষীরা, বেনাপোল, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, হালুয়াঘাট, ব্রাক্ষণবাড়িয়া, আখাউড়া ও কুমিল্লা সীমান্তে। মাদকদ্রব্যের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য সৃষ্টিকারী হচ্ছে ইয়াবা। তারপরই ফেনসিডিল ও গাঁজার অবস্থান। এ অভিযান সম্পর্কে মাদকের নগর উপ-পরিচালক মুকুল জ্যোতি চাকমা জানান, বর্তমান মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমেদ দায়িত্ব নেবার পর পরই সারাদেশের মাদকসেবী ও ব্যবসায়ী সম্পর্কে তৃণমূল পর্যায়ে নানা ধরনের পরিসংখ্যান তৈরি করেন। মাঠ পর্যায়ে মাদকের আগ্রাসন দেখে তিনি রীতিমতো উদ্বিগ্ন হয়ে একটি তালিকাও প্রস্তুত করেন। ওই তালিকা হাতে নিয়েই তিনি দেশব্যাপী একযোগে অভিযান চালানোর জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন একযোগে যৌথ অভিযান চালানোর। প্রথম দিনেই রাজধানীর মোহম্মদপুর বিহারী ক্যাম্পের শীর্ষ গডফাদার পঁচিশ, গুলিস্তানের দুই মাদক ব্যবসায়ী ও চট্টগ্রামে ৫ মাদক ব্যবসায়ীকে সাড়ে ১৪ হাজার পিস্ ইয়াবাসহ আটক করা হয়। চট্টগ্রাম কোতোয়ালির মাদক পরিদর্শক সামসুল কবিরের নেতৃত্বে একটি টিম সাগরিকা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে। মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন বলেন, দেশব্যাপী একযোগে এ ধরনের ক্র্যাকডাউন অনেক আগেই চালানো উচিত ছিল। শুধু রাজধানীতেই মাদকবিরোধী কর্মকা- জোরদার করা হলে চলবে না। মনে রাখতে হবে রাজধানীতে কোন ধরনের মাদক উৎপন্ন বা তৈরি করা হয় না। এগুলো আসে মিয়ানমার ও ভারত থেকে। কাজেই এসব রোখার কৌশলটাও হবে উৎপত্তিস্থলকে সামনে রেখে। সীমান্ত এলাকায় মাদকবিরোধী কর্মকা- জোরদারের পাশাপাশি চিহ্নিত ব্যবসায়ীদের আটক করে দীর্ঘমেয়াদী কারাগারে বন্দী রাখা হলে পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি নিশ্চিত। হালনাগাদ করা তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে সারা দেশে দেড় শতাধিক ভয়ঙ্কর মাদকের গডফাদার রয়েছে।
×