ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যেন আমরা এই মানুষেরা, গাছকে ভালবাসি দ্বিজেন শর্মা স্মরণ ছায়ানটে

প্রকাশিত: ০৪:২৯, ৪ নভেম্বর ২০১৭

যেন আমরা এই মানুষেরা, গাছকে ভালবাসি দ্বিজেন শর্মা স্মরণ ছায়ানটে

মোরসালিন মিজান দ্বিজেন শর্মার মতো মানুষের মৃত্যু যে সে ক্ষতি নয়। নিবেদিতপ্রাণ নিসর্গপ্রেমীর বয়স হয়েছিল। তবুও এই চলে যাওয়া বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে। সবাই উপলব্ধি করবেন না। করার কথা নয়। যারা করবেন তাদের বেদনা বাড়বে। বেড়ে চলেছে। নানা ভাব ও ভাষায় প্রিয় পথপ্রদর্শককে গুরুকে স্মরণ করছেন তারা। বর্ণনা ও বন্দনা করছেন। দ্বিজেন শর্মাকে নিয়ে গাছ প্রকৃতি পরিবেশের সঙ্গে সরাসরি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর যে বলা, এতদিনে মোটামুটি শোনা হয়েছে। আর তার পর শুক্রবার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন সংগ্রামের বাতিঘর ছায়ানট ও রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ। সঙ্গত কারণেই ভিন্ন মাত্রা পায় আয়োজনটি। গানের মানুষেরা সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখায় নিত্য কাজ করা বন্ধু স্বজনরা এদিন দ্বিজেন শর্মার স্মৃতিচারণ করেন। কারণ খুঁজতে গিয়ে জানা যায়, প্রবীণ বৃক্ষ সখা একইসঙ্গে ছিলেন বাঙালী সংস্কৃতির একনিষ্ঠ সেবক। জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন। ঘনিষ্ট হয়ে ছিলেন ছায়ানটের সঙ্গে। সেই সূত্রেই দ্বিজেন শর্মাকে স্মরণ। তার জীবন বৃক্ষপ্রেম স্বপ্ন তুলে ধরার প্রয়াস নেন আয়োজকরা। কখনও কথায়, কখনও বা গানে। সব মিলিয়ে ব্যতিক্রমী এবং পূর্ণাঙ্গ একটি আয়োজন। অনুষ্ঠানের সূচনা হয় দলীয় সঙ্গীতে। রবীন্দ্রনাথে বুদ হয়ে ছিলেন দ্বিজেন শর্মা। কবিগুরুর গানেই তাকে প্রণতি জানান শিল্পীরা। লাইসা আহমদ লিসাসহ কয়েকজন শিল্পী মঞ্চে এসে দাঁড়ান। হারামোনিয়াম পাশে নিয়ে বসেছিলেন মিতা হক। সকলে মিলে গান, ‘আয় আয় আয় আমাদের অঙ্গনে অতিথি বালক তরুদলÑ/মানবের স্নেহসঙ্গ নে, চল্আমাদের ঘরে চল্...। সুন্দর সম্মেলক পরিবেশনার পর দ্বিজেন শর্মার জীবনের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন সাহিত্যিক আবুল হাসনাত। সুলিখিত নিবন্ধে তিনি বলেন, দ্বিজেন শর্মা ছিলেন বিশিষ্ট উদ্ভিদ বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদ। ৬৫ বছর ধরে প্রকৃতির রমনীয়তা সম্পর্কে এ দেশের অসচেতন মানুষকে সচেতন করতে কাজ করেছেন। তার কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, বৃক্ষরোপণও একটি বিজ্ঞান। এর নন্দনতত্ত আছে। দেশে-বিদেশে সবখানে তিনি এই চর্চার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। বিদেশে যখন গিয়েছেন, বাগানের বিন্যাস মুগ্ধ হয়ে দেখেছেন। বাগানের চর্চায় তার কোন বিরতি ছিল না। দ্বিজেন শর্মার অন্য যে দিকগুলো কম আলোচিত হয় সেগুলোও ওঠে আসে কথনে। তিনি বলেন, সমাজ সাহিত্য শিল্প ও স্থাপত্য বিষয়ে তার আগ্রহ লেখালেখি আমাদের অভিজ্ঞতার দিগন্তকে বিস্তৃত করে। বাঙালীর সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও প্রাণ প্রতিষ্ঠার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ছিলেন তিনি। সমাজে বিজ্ঞান চেতনা সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে যুক্তিবাদিতা সঞ্চার করতে নিরলস সাধনা করে গেছেন। নাতিদীর্ঘ কথন শেষে গানে গানে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন লাইসা আহমদ লিসা। একক কণ্ঠে গীত হয়Ñ ‘চরণরেখা তব যে পথে দিলে লেখি/চিহ্ন আজি তারি আপনি ঘুচালে কি/ছিল তো শেফালিকা তোমারি-লিপি-লিখা,/তারে যে তৃণতলে আজিকে লীন দেখি...। অনুষ্ঠানে স্লাইড শোর মাধ্যমে ‘দ্বিজেন শর্মার উদ্যান ভাবনা’ ব্যাখ্যা করেন তুগলক আজাদ। ভাবনাগুলোকে সযতেœ সাজিয়ে নিয়েছিলেন এই স্থপতি। ছবি ভিডিও ক্লিপ ব্যবহার করে চমৎকার প্রেজেন্টেশন। এতে নিজ হাতে গাছ লাগানোর দৃশ্য, গাছ নিয়ে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করতে দেখা যায় দ্বিজেন শর্মাকে। অনুষ্ঠানে আরও আলোচনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গবর্নর অর্থনীতিবিদ আতিউর রহমান। তিনি বলেন, উদ্ভিদ ও বস্তুর পারস্পরিক সান্নিধ্যে থাকার যে প্রয়োজন রয়েছে, তা দ্বিজেন শর্মা বলার চেষ্টা করেছেন। করেও দেখিয়েছেন নিজে। আলোচনার এ পর্যায়ে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শাহীন সামাদ ও চন্দনা মজুমদার। দুই শিল্পী গানে গানে দ্বিজেন শর্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পরে সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হয় সহসা ডালপালা তোর উতলা-যে ও চাঁপা, ও করবী!/কারে তুই দেখতে পেলি আকাশে-মাঝে জানি না যে...। এদিনের পুরো অনুষ্ঠান মঞ্চের পাশে বসে উপভোগ করেন ছায়ানটের সভাপতি সন্জীদা খাতুন। বিশুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চা ও জাগরণে বড় ভূমিকা রেখে চলা প্রবীণ শিল্পী নবীনের মতোই কান পেতে শুনেন শিষ্য সুহৃদদের কথা গান। তার পর নিজের সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে বলেন, আয়োজনটি বড় ভাল লাগল। দ্বিজেন শর্মার সঙ্গে দীর্ঘ পথচলা। সেই পথচলার বিস্তারিত না বললেও, ছোট্ট যেটুকু বলা, তাতেই আবেগটা অনুমান করা যায়। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, একদিন দেখি দ্বিজেন শর্মা একটা ইউক্যালিপটাস গাছে পীঠটা ঠেকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। আমি বিস্মিত হয়ে সেই দৃশ্য দেখেছিলাম যে, কেমন করে তিনি প্রকৃতিকে ভালবাসেন। গাছকে ভালবাসেন। স্পর্শটা উনি নিচ্ছেন কীভাবে। আমার মনে হলো, আমাদের দ্বিজেন শর্মা গাছকে প্রকৃতিকে ভালবেসেছিলেন। তারই সঙ্গে ভালবেসেছিলেন মানুষকে। তাই বার বার উপদেশ দিয়ে গেছেন যেন আমরা, এই মানুষেরা, গাছকে ভালবাসি। সুন্দরভাবে বিন্যাস করি। এবং আমরা যেন প্রকৃতিপ্রেমী হতে পারি। প্রয়াত উদ্ভিদবিদের প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করে শেষ করে স্মৃতিচারণ শেষ করেন তিনি। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে শেষ হয় অনুষ্ঠান। অনিন্দ্য সুন্দর আয়োজনের আরেকটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল এর দর্শক শ্রোতা। গোটা মিলনায়তন শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ছিল কানায় কানায় পূর্ণ। বিভিন্ন বয়সী ছেলেমেয়েরা মন দিয়ে গাছের কথা, গাছকে যিনি ভালবাসতেন তার কথা শুনে। এমন দৃশ্য কম দেখা যায় বৈকি!
×