ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

গৌরবের সাতই মার্চ

প্রকাশিত: ০৪:০৩, ৪ নভেম্বর ২০১৭

গৌরবের সাতই মার্চ

বাঙালী জাতির জন্য অবশ্যই গৌরব আজ। সৌরভে মাতোয়ারা তার প্রাণ প্রবাহের উৎসমূল। সারা বিশ্বের দরবারে আজ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে বাঙালীর শ্রেষ্ঠ কবিতাখানি। একাত্তরে একটি ডাকে জেগেছিল বাঙালী জাতি। আর সেই ডাক এসেছিল রেসকোর্স ময়দান থেকে একাত্তরের সাতই মার্চ তারিখে। সোনার বাংলা, রূপসী বাংলার স্বাধীনসত্তা হিসেবে জেগে ওঠার সেই অমোঘ মুহূর্ত আজ গৌরবে সৌরভে স্বীকৃত বিশ্ব মানবের জাগরণে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাতই মার্চের ভাষণকে ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো। যে ভাষণে বলা হয়েছিল, বাঙালীকে আর দাবায়ে রাখা যাবে না আর উচ্চকণ্ঠে নিনাদিত হয়েছিল ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এই উচ্চারণ আজ বিশ্ব মানবের সম্পদে পরিণত হলো। পেল স্থায়ী আসন। জাতি হিসেবে বাঙালীর মর্যাদার আসন আরও উন্নত হলো। লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত, নির্যাতিত বাঙালীর জেগে ওঠার সেই অমিত সাহসের এই ভাষণ শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থানে ঠাঁই পাওয়ার মধ্যেই দিয়ে ধ্বনিত হলো মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার মাহেন্দ্রক্ষণগুলো। সাড়ে সাত কোটি মানুষের আরেকটি নামে পরিণত হয়েছিলেন ভাষণদাতা বঙ্গবন্ধু। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ভাগ্য বিধাতা হয়ে তিনি একটি জাতিকে জাগরণের মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের মাধ্যমে। সাতই মার্চে এসে তিনি সমস্ত শক্তি, সাহায্য, শৌর্য-বীর্যকে সমন্বিত করে যে ডাক দিয়েছিলেন, ঘুমন্ত জাতি সেই ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া দিয়েছিল। শত্রু হননের, তিমির হননের গান গেয়ে বাঙালী রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল অস্ত্র হাতে। বিশ্ববাসী অবাক তাকিয়েছিল। যেন সাবাস বাংলাদেশ এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়। সেই কালোত্তীর্ণ ভাষণ বিশ্বের সম্পদে পরিণত হয়েছে আজ। এ এক আনন্দের সময়। এ এক গৌরবের সময়। এই এক পরম লগন এসেছে বাংলার মানুষের জন্য, যে মানুষ তার স্বাধীনতার জন্য অকাতরে প্রাণ দিয়েছিল সাতই মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে। শত্রুকে করেছিল পর্যুদস্ত, পরাস্ত। পৃথিবীর মানচিত্রে পত পত করে উড়েছিল নতুন এক স্বাধীন দেশের লাল সবুজ খচিত পতাকা। ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি আর তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পেয়েছিল বাঙালী স্বাধীন ভূমি। এমন রক্ত, প্রাণদান আর ঘটেনি বিশ্বের কোথাও স্বাধীনতার জন্য। বাঙালী জাতির এ এক অনন্য দিন। উজ্জ্বল আবরণে আচ্ছাদিত গৌরবান্বিত সময়। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের এক অনন্য দলিল হিসেবেই ছিল স্বীকৃত। আর এখন তা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের লড়াইয়ের ক্ষেত্রেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে ইউনেস্কোর আন্তর্জাতিক পরামর্শক কমিটি ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড’ কর্মসূচীর আওতায় বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশে পরিণত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক এই ভাষণ। ভাষণে ইউনেস্কোর ঐতিহাসিক দলিলের স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য দুই বছর ধরে বাংলাদেশ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য ও নথি সরবরাহ করেছে। ইউনেস্কোর ফ্রান্সে নিযুক্ত স্থায়ী প্রতিনিধি ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টির পক্ষে স্বীকৃতির সপক্ষে এই কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যে ১২ পৃষ্ঠার আবেদনটি করা হয়েছিল তাতে এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বৈশ্বিক গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছিল। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের সেরা বক্তৃতাগুলো নিয়ে যে গ্রন্থ সংকলন করেন তাতে সাতই মার্চের ভাষণকে গত আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসে যুদ্ধকালে দেয়া বিশ্বের অন্যতম অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তৃতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এই বক্তৃতার কোন লিখিত পা-ুলিপি ছিল না। কিন্তু এই বক্তৃতার পথ ধরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এসেছে। বাস্তবতা এই যে এই ভাষণের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু সমগ্র জাতির আশা-আকাক্সক্ষার, ওই সময়কার অবস্থা ও ভবিষ্যতের করণীয় বলে দিয়েছিলেন। যার পথ ধরে বাঙালী পেয়েছে তার আরাধ্য স্বাধীনতা। ৭ মার্চের ভাষণ আজও বেজে ওঠে বাংলাদেশের হাটে-মাঠে ঘাটেসহ সর্বত্র। এখনও শিহরিত হতে হয় এই ভাষণ শুনে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে এই ভাষণ বাঙালীকে যেমন সাহস যুগিয়ে যাবে, তেমনি ‘উচ্চ করি শির’ বিশ্ব মানবের মাঝে ঠাঁই দেবে।
×