সাজু আহমেদ ॥ বাংলাদেশের প্রথিতযশা রূপসজ্জা শিল্পী বঙ্গজিৎ দত্তের ১৭তম প্রয়াণ দিবস ছিল ১নবেম্বর। এ উপলক্ষে শিল্পী বঙ্গজিৎ দত্ত স্মরণে চারদিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে ‘বঙ্গজিৎ দত্ত প্রয়াণ দিবস উদযাপন পর্ষদ’। গত ২৯-৩১ অক্টোবর থিয়েটার ডিজাইনার্স ইনস্টিটিউটের সহযোগিতায় ৩ দিনব্যাপী হাতে-কলমে রূপসজ্জা কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এই কর্মশালায় প্রয়াত বঙ্গজিৎ দত্তের সুযোগ্য সন্তান রূপসজ্জা শিল্পী শুভাশীষ দত্ত তন্ময় বাবার শেখানো জ্ঞানই তিনি পৌঁছে দেন এ প্রজন্মের তরুণ নাট্যকর্মীদের মাঝে। ১ নবেম্বর বুধবার সন্ধ্যায় চার দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সমাপনী দিনে শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার হলে ছিল নানা আয়োজন। এ আয়োজনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী, মঞ্চ সারথী আতাউর রহমান, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল আকতারুজ্জামা, বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আহমেদ গিয়াস, নাট্যজন গোলাম সারোয়ার, নাট্যজন দেবপ্রসাদ দেবনাথ। ছিল রূপসজ্জা কর্মশালার সনদপত্র বিতরণ, স্মৃতিচারণ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানমালায় থাকবে মাইম আর্ট, গানের দল সর্বনাম, উত্তম চক্রবর্তীর বাশি, নৃত্যানুষ্ঠান।
বঙ্গজিৎ দত্ত ছিলেন এ দেশের রূপসজ্জা জগতের অন্যতম অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্র। যার অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশের রূপসজ্জা শিল্পে উন্মোচিত হয়েছে নবদিগন্ত। বঙ্গজিৎ দত্তকে বলা হয় বাংলাদেশের রূপসজ্জা শিল্পীদের গুরু। আমাদের অন্য শিল্পের ন্যায় থিয়েটার অঙ্গন বিনোদনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। দীর্ঘ সময় এই অঙ্গনে অতন্দ্র মমতায় দায়িত্ব পালন করে গেছেন বাংলাদেশের গুণী রূপসজ্জাকর বঙ্গজিৎ দত্ত। যার অক্লান্ত পরিশ্রমে বাংলাদেশের রূপসজ্জা শিল্পে উন্মোচিত হয়েছে নবদিগন্ত। বঙ্গজিৎ দত্তকে বলা হয় বাংলাদেশের রূপসজ্জাকরদের গুরু। তার জন্ম ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪ ঢাকার ঠাটারী বাজার এলাকায়। ছোটবেলা থেকেই সাংস্কৃতিক আবহে বড় হয়েছেন শিল্পের এ নিরন্তর সমঝদার। বঙ্গজিতের বাবা সুরেশ দত্ত ছিলেন একসময়কার জাঁদরেল অভিনেতা, নিদের্শক, সংগঠক এবং একজন রূপসজ্জা শিল্পী। তার ছোট বোন গীতা দত্ত ছিলেন তৎকালীন একমাত্র মহিলা অভিনেত্রী যিনি দাপটের সঙ্গেই নিয়মিত অভিনয় করেছিলেন। ছোটবেলায় স্কুলে কবিতা আবৃত্তি ও নাটকে অভিনয় করতেন বঙ্গজিৎ। নবাবপুর প্রিয়নাথ হাইস্কুল থেকে মাধ্যমিক, কলকাতার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক এবং ইংরেজীতে স্নাতক ও স্নাতোকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর রূপসজ্জায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পাশাপাশি কলকাতায় একটি হোমিওপ্যাথি কলেজ থেকে হোমিওপ্যাথিতে ডিগ্রি নেন। এতদসত্ত্বেও এই সংশ্লিষ্ট পেশায় না গিয়ে এন্টি-করাপশন ডিপার্টমেন্টে চাকরিতে নিযুক্ত হন। কিন্তু আপদমস্তক সংস্কৃতিপ্রাণ এ মানুষটির কাছে সেই পেশাটি ভাল না লাগায় চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে শিক্ষকতা পেশায় আসেন। তিনি রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যালয়, পোগজ স্কুল এবং ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউটের শিক্ষক হিসেবে ১৯৫৫ থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রাক্কাল পর্যন্ত নিযুক্ত ছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় শাঁখারীবাজারের বাড়িটা বেদখল হয়ে যায়। পরিবারের সবাইকে পাঠিয়ে দেয়া হয় ভারতে। বিপর্যস্ত হয়ে তখনই মৃত্যুবরণ করেন বঙ্গজিতের বাবা সুরেশ দত্ত। সেই কঠিনতম অবস্থায় পরিবারে হাল ধরতে হয় বঙ্গজিৎকে। পাকিস্তান এন্টি-করাপশন ডিপার্টমেন্টে কর্মরত থাকাকালীন তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের তথ্য আদান প্রদান করতেন। স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর যুদ্ধবিধ্বস্ত নবজাত এ ভূখ-ে থেমে থাকেনি নাট্যচর্চা। তরুণ নাট্যকর্মীরা তখন দেশ গঠনের হাতিয়ার হিসেবে বেছে নেয় নাটকে। সে দলে সঙ্গী হন বঙ্গজিৎ। রামকৃষ্ণ মিশন স্কুল ও নবকুমার ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতার পাশাপাশিও তিনি নাটকের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। নাটক লিখছেন, অভিনয় করছেন, সংগঠনের সক্রিয় কর্মী থেকে নিয়মিত রূপসজ্জার কাজ, সবই করতেন একাধারে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষভাবে যুক্ত এ মানুষটি দেশ ও দেশের সংস্কৃতিকে পরম মমতায় বুকে আঁকড়ে ধরেছিলেন। তার বিদগ্ধ অভিজ্ঞতা, অনবদ্য শিল্পপ্রেম, কঠোর মেধা-শ্রম এবং শিল্পের প্রতি অমৃত আন্তরিকতা সংস্কৃতিচর্চাকে করেছে গতিময়। বিশেষ করে রূপসজ্জা শিল্পকে নিয়ে গেছে ভিন্ন এক উচ্চতায়। পেশা হিসেবে রূপসজ্জাকে পুরোপুরিভাবে বেছে নেয় তিনি। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের থিয়েটারের গোড়াপত্তনে একজন এমন উচ্চশিক্ষিত দক্ষ রূপসাজক পাওয়াটা ছিল জাতীর জন্য সত্যি সৌভাগ্যের। পাশাপাশি তিনি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসাও চালিয়ে যান তবে তা ছিল মূলত জনসেবা বা দাতব্য সেবা হিসেবে। ইতিহাসের এ বাহক নাটকের মানুষের কাছে বঙ্গজিৎদা, বঙ্গদা বা শুধু দাদা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তিনি ছিলেন সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। সদালাপি, মিষ্টভাষী এবং রসিক বটে। ছোট বড় সকলের সঙ্গেই ছিলো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। স্বাধীনতা-পরবর্তী এমন কোন অভিনেতা-অভিনেত্রী ছিলেন না যে তার হাতের স্পর্শ না পেয়ে অভিনেতা-অভিনেত্রী হয়ে উঠেছেন। নাটকের এ নির্মল মানুষটির হাতের স্পর্শ পেয়েই যেন সত্যিকার অর্থে চরিত্রটি জীবন্ত হয়ে উঠত এবং শিল্পী তার অভিনয় শৈলী দিয়ে চরিত্রটি যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন। সংশ্লিষ্টরা সত্যি তাই মনে করতেন। আর সে কারণেই সব নাট্যাঙ্গনের মানুষের কাছে তিনি বিনম্র শ্রদ্ধা-ভালবাসা মানুষ। নামের মতোই তিনি যেন জয় করে নিয়েছেন এ বঙ্গের শিল্পী সমাজের হৃদয়। পেয়েছেন নাট্যচক্র সম্মাননা, লোকনাট্য দলের সম্মাননা, বহুরূপী সম্মাননা, চতুরঙ্গ সম্মাননা, নাগরিক-নাট্য-সম্প্রদায় সম্মাননা, ঢাকা ড্রামা সম্মাননা, বাচসাস পুরস্কারসহ অসংখ্য পুরস্কার-স্বীকৃতি। আমৃত্যু তিনি থিয়েটারের সঙ্গে থেকে রূপসজ্জাকার হিসেবে বাঁচতে চেয়েছিলেন। আর তাই তো মৃত্যুর এক ঘণ্টা পূর্বেও তার প্রিয় রূপসজ্জা পেশার সঙ্গে ছিলেন এবং তার আত্মার আত্মীয় নাটকের মানুষদের সঙ্গে কাটিয়ে গেছেন। ২০০০ সলের ১ নবেম্বর রাত ১১টা ১৫ মিনিটে তার জীবন নাটকের যবনিকাপাত ঘটে। পৃথিবীর এ রঙ্গশালা থেকে তিনি বিদায় নেন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম লালন করবে শিল্প-সংস্কৃতি। কিন্তু কালের সাক্ষী বঙ্গজিৎ দত্তকে মনে করতেই হবে রূপসজ্জা কিংবা থিয়েটারের ফিরিস্তি হাতরালে। খ্যাতনাম এই রূপকারিগরের প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে বিনম্র শ্রদ্ধা।