ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. চিত্তরঞ্জন দাশ

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৩ নভেম্বর ২০১৭

বাল্টিক সাগর থেকে রকি মাউন্টেন

পূর্ব প্রকাশের পর) দেখা হলো কান্ট্রি অব ক্যানানেসকি, আলব্রাটা যে যার গাড়িতে আসন গ্রহণ করার পূর্বে ক্যানমোর নরডিক সেন্টারে উত্তম ব্যবস্থাপনায় প্রক্ষালন প্রক্রিয়া শেষ করার আহ্বান জানানো হলো অতিদ্রুত। কেননা দিনের আলো থাকতে থাকতেই আমাদের পৌঁছাতে হবে রিবোন ক্রিক বন্য আন্তর্জাতিক হোটেলে। বন্য এই কারণে বললাম যে, নির্জন গহীন বনের মধ্যে এমন একটি হোটেল বানানো যায় এবং সেখানে মানুষজন রাত্রি যাপন করে ভাবতেই গা শিউরে উঠে। গা ছমছম করার আরও যে কারণ সেটা হলো ভল্লুক। এই জঙ্গল তাদেরই। তাদের আস্তানায় আমরা এসে আস্তানা গেড়েছি, আমরা অনুপ্রবেশকারী। তাই আমাদের একটু সমীহ করে চলা উচিত। পুনরায় যাত্রা শুরুর পালা আমরা যথারীতি সুব্রত দাদার বাহনে চড়ে বসলাম। ইচ্ছা হচ্ছিল জীবন দাদার গাড়িতে উঠে পড়ি। কিন্তু সেটা এই মাঝপথে এসে ঠিক শোভন দেখায় না। চল্লিশ বছর ধরে কত কথাই না জমে আছে। আমরা উন্মুখ সেসব কথার ফুলঝুরি ঝরাতে। এবারের যাত্রা পথের গতি প্রকৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। হঠাৎ উথান হঠাৎ পতন। ডানে-বাঁয়ে গভীর খাদ, জলাশয় তার উপর খাড়া উঁচু পাহাড় চালকের সদা সতর্ক দৃষ্টি ও গতি নিয়ন্ত্রণ অতীব প্রয়োজন। সকলকে সদা সতর্ক দৃষ্টি রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে কখন না ভল্লুক ভাই এর সাক্ষাত মিলে যায়। মাঝে মধ্যে রাস্তার দুই পাশে সাইন বোর্ডে লেখা আছে ভল্লুকের দেশ। সকলেরই দৃষ্টি রাস্তার দুই পাশের বন এবং রাস্তা সংলগ্ন খালি জায়গা টুকুর ওপর। কেননা ওরা এই খালি জায়গায় এসে সাধারণত ঘাস লতাপাতা ভক্ষণরত থাকতে দেখা যায়। সেটাই আমাদের সহযাত্রীদের কাছ থেকে জানতে পেরেছি। না অপেক্ষার প্রহর আর বেশিক্ষণ গুনতে হলো না। সামনেই দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে সারিবদ্ধভারে গাড়ি দাঁড় করিয়ে যাত্রীরা গাড়ি থেকে নেমে যে যার যার মতো ছবি তুলতে ব্যস্ত। সুব্রত দাদা বললেন, ‘নিশ্চয় কোন ওয়ার্ল্ড লাইফ তাই এত ভিড়।’ দ্রুত ঘটনা স্থলে হাজির হয়ে দেখতে পেলাম গ্রিজলি ভল্লুক। কোন দিকে ভ্রƒক্ষেপ না করে আপন মনে উদার পূর্তিতে ব্যস্ত। সাদা ও কালো রঙের মিশ্রণে গড়া এই জাতের ভল্লুকরা সাধারণত বেশ হিংস্র প্রকৃতির। খুব বেশি কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই। সে চেষ্টা না করে একটার পর একটা ফটো সেশন সমাপ্ত করে আবার যাত্রা শুরুর পালা। ইতোমধ্যে সুব্রত দাদা তার শিকারি জীবনের নানা অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছেন। বলছেন এই সব পাহাড়ে প্রচুর মাউন্টেন শিপের দেখা মেলে। তবে তারা কখনও সমতলে আসে না বলতে বলতেই সামনে চোখে পড়ল একদল মাউন্টেন শিপ রাস্তা পার হচ্ছে। গ্রুপ থেকে ছিটকে একটা মেয়ে শিপ থমকে দাঁড়াল রাস্তার মাঝে। সে আর নড়তেই চায় না। দলের বাকি সদস্যরা তখন বেশ দূরে। ওকে সম্মান দেখিয়ে আমরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় কোন দিকে দৌড়াবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। এক সময় দলকে অনুসরণ করে মারল দৌড়, আমরাও ছাড়া পেয়ে গেলাম। ভাবতে লাগলাম প্রকৃতির এই সন্তানরা কত নিরাপদে নিবিঘেœ নির্ভয়ে চলে ফিরে বেড়াচ্ছে। আর আমরা আমাদের দেশের একমাত্র বন্য পশু সম্পদ সুন্দরবনের হরিণ তাকে কত যতœ করে জবাই করে গুলি করে রসনা তৃপ্তি করে চলেছি। একবার ভাবছি না আমাদের প্রয়োজনে এদের বাঁচিয়ে রাখা দরকার। এক এক করে সবাই বাক্স পেটরা নিয়ে হোটেলের আঙ্গিনায় প্রবেশ করছে। আমরা ঢুকতেই শুরু হয়ে গেল কেয়ার টেকার ভদ্রমহিলার আগমনি সতর্কবাণী। যার মধ্যে বেশিরভাগ সময় ধরে কিভাবে ভল্লুকের আক্রমণ থেকে নিজেকে নিরাপদে রাখা যায় তারই সাবধানী বার্তা। এই জঙ্গেলের মধ্যে সর্বত্র ভল্লুকের পদচারণা, তারা মানুষের খাবারের প্রতি বেশি আকৃষ্ট। ভল্লুকরা মানুষের চেয়ে দুই হাজারগুণ বেশি ঘ্রাণ শক্তির অধিকারী। খাবারের ঘ্রাণ পেলেই তারা ছুটে আসে। মহিলাটি অবশ্য করণীয় বিষয়াদির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন যেন রাত্রি বেলা একা কেউ বাইরে না যাই, দরজা খোলা রাখা যাবে না। এবং কোন প্রকারের খাবারের অবশিষ্টাংশ বা গারবেজ হেটেলের মধ্যে বিনে রাথতে হবে। বাইরে বিয়ার দেখলে সবাই যেন হোটেলের ভেতর ঢুকে পড়ি। রসিকতা করে বললাম যদি মহারাজ ভেতরে ঢুকে পড়েন তবে আমরা সকলে বাইরে চলে যাব এই তো? কথাটা শুনেই সকলে হাসিতে ফেটে পড়লেন। এই প্রাণীটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করা মোটেও সহজ নয়। কালো ভল্লুক কখন কি ধরনের আচরণ যে করে তার কোন ঠিক-ঠিকানা নেই। মানুষকে সাধারণত এরা আক্রমণ করে না। তবে হঠাৎ সামনে পড়ে গেলে, সারপ্রাজড হলে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। ভয় পেলে গাছে চড়তে এদের জুড়ি নেই। অন্যদিকে গ্রিজলি ও ব্রাউন বিয়ার বেশি হিংস্র। বিশেষ করে মা বিয়ারের সঙ্গে যখন বাচ্চা থাকে তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এই প্রসঙ্গে একটা বাস্তব ঘটনা না বলে পারছি না যদিও ঘটনাটি বন্ধুবর স্বপন চৌধুরীর নিজস্ব কাহিনী। তিনি ইয়কন নদীতে যখন স্যামন রান হয় অর্থাৎ সাগর থেকে দলে দলে হাজার হাজার স্যামন উজানে উঠতে থাকে তখন তিনি মৎস্য শিকারে গিয়েছিলেন। স্যামন ধরেছিলেন বেশ কয়েকটা। গাড়িতে মাছগুলো রেখে একটু দূরে যেতেই ভল্লুক এসে মাছ খাওয়া শুরু করে দেয়। সমূহবিপদ বুঝতে পেরে তিনি নিজেই পুলিশ ডাকতে বাধ্য হন। পুলিশ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়। কিন্তু কোন খাবার যে অরক্ষিত অবস্থায় রেখে যাওয়া যায় না। এই আইন ভঙ্গ করার দায়ে তাকে জরিমানা করতে পুলিশ বদ্ধপরিকর। কোনক্রমে আইনটি না জানা থাকার কারণ দেখিয়ে সে যাত্রা রেহাই পান। ওই হোটেলটিতে থাকা অবস্থায় সে রাত্রে আর উনার দর্শন মেলেনি তবে সকাল বেলা টিম লিডার শংকর বাবুর গাড়িতে হোস্ট ভল্লুক ভাইদের পদচিহ্ন দেখে বুঝতে বাকি রইল না যে, অতিথিদের খাবারে ভাগ বসাতে তাদের আগমন ঘটেছিল। শংকর বাবুর গাড়িতেই অধিকাংশ খাবার পরিবহন করা হয়েছিল। যে খাবারের ঘ্রাণ তাদের আকৃষ্ট করে। জীবন দাদার আমন্ত্রণে বসে পড়লাম তাস খেলতে। খেলা চলল বেশ খানিকক্ষণ। এদিকে শংকর দাদার হাকডাকে খেলা চালানো দুষ্কর হয়ে পড়ল। বাহিরে ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বালানো হয়েছে। সকলকে সেখানে হাজির হতে হবে। আনন্দ উৎসবে যোগ দিতে হবে। বাহিরে অন্ধকার রাত্রি, বনের মধ্যে অন্ধকারের ঘনত্ব একটু বেশি, হাল্কা শীতের আবেশ, তারউপর ভল্লুক ভাই এর উপদ্রপ মোটেও উপক্ষেণীয় নয়। দুরু দুরু বুকে সকলের সঙ্গে হাজির হলাম ফায়ার প্লেসে, বসে পড়লাম ফায়ার প্লেসের চারদিকে বৃত্তাকার বেঞ্চের একটিতে। ছোট বড় দলের সকল সদস্যই সেখানে উপস্থিত। বাহিরের পর্ব শেষ, পুনরায় ভেতরে আর এক রাউন্ড তাসের আড্ডা জমে উঠল। এবারের খেলায় পার্টনার পরিবর্তন হয়ে স্বয়ং জীবন দাদাই আমার পার্টনার হলেন। কিন্তু খেলার ইতি অল্প সময়ের মধ্যেই টানতে হলো। রাত্রি দ্বিপ্রহর পেরিয়ে গেছে অনেক আগেই। বাকিটা সময় অবহেলায় না ফেলে যদি কিছুটা সময় নিদ্রাদেবিকে শান্তি দিতে পারি, সেই আশা বুকে নিয়ে যখন দ্বিতল চৌকির নিচতলায় আশ্রয় নিলাম, তখনও নাসিকার গর্জন কর্ণকুহরে প্রবেশ করায় নিদ্রাবিহীন সে রাত্রি এমনি করেই কেটে গেল। চলবে
×