ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আকিল জামান ইনু

নারীর ক্ষমতায়ন ও রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৩ নভেম্বর ২০১৭

নারীর ক্ষমতায়ন ও রাজনীতিতে প্রতিনিধিত্ব

নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে জল ঘোলা হয়েছে বিস্তর। রাজনীতি যখন রাষ্ট্রের পরিচালনা শক্তি তখন নারীর ক্ষমতায়নে রাজনীতিতে নারীর সমানুপাতিক অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। নারীর ভোটাধিকার অর্জন নিশ্চিতভাবেই সভ্যতার ইতিহাসে একটি মাইলফলক। তারপর ভলগা থেকে গঙ্গায় জল গড়িয়েছে অনেক কিন্তু পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হয়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। এ প্রশ্নটি আরও জোরেশারে আলোচনায় এসেছে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ১৯তম কংগ্রেসকে সামনে রেখে। বিশ্বের সর্বাধিক জনবহুল দেশ চীন। সামাজিক সাম্য আর নারী-পুরুষের সমানাধিকারের সেøাগান দিয়ে সেখানে ক্ষমতায় কমিউনিস্ট পার্টি। সঙ্গত কারণেই সেদিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিল সারা বিশ্ব। সেখান থেকেই উঠে এসেছে নারী প্রতিনিধিদের উপস্থিতির বিষয়ে এক হতাশাজনক চিত্র। বেজিংয়ে অনুষ্ঠিত ১৯তম কমিউনস্ট পার্টি কংগ্রেসে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং যখন উদ্বোধনী বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখন উপস্থিত ২ হাজার ২৮০ জন ডেলিগেটের মধ্যে নারী প্রতিনিধির সংখ্যা ছিল এক চতুর্থাংশেরও কম। সেখান থেকেই অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন লিঙ্গ সাম্য নিশ্চিতকরণের বিষয়টিকে কমিউনিস্ট পার্টির আরও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা উচিত কিনা। নিউইয়র্ক টাইমস তো পার্টিতে নারীদের জন্য দরজা বন্ধ হবার উপক্রম বলে প্রশ্ন তুলেছে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কি নারী নেতৃত্ব নিয়ে সমস্যায় ভুগছেন? পরিসংখ্যান কিন্তু সে রকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে। চাইনীজ কামিউনিস্ট পার্টির ৮৯.৪ মিলিয়ন সদস্যের মধ্যে নারী সদস্য ২৩ মিলিয়নেরও কম। শতকরা হিসাবে দাঁড়ায় ২৬%। সংসদে নারী প্রতিনিধি মাত্র ২৪%। রাজনীতির যত চূড়ার দিকে তাকানো যায় নারীর উপস্থিতি ততটাই কমে আসে। ২০১২ তে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসে সেন্ট্রাল কমিটিতে ঠাঁই পেয়েছিলেন মাত্র ৩৩ জন নারী যা মোট সংখ্যার ৯% মাত্র। উল্লেখ্য, এই সেন্ট্রাল কমিটিই নির্বাচন করে প্রভাবশালী পলিটব্যুরো। তখন ২৫ জন পলিটব্যুরো সদস্যের ২ জন ছিলেন নারী । উচ্চপর্যায়ে নারীর উপস্থিতির দৈন্য বোঝাতে চিত্রটি যথেষ্ট। এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই চীনে নারীদের নেতৃত্বে আসার পথটি ক্রমেই কঠিন হয়ে উঠছে। যদিও সরকার বরাবর লিঙ্গ সাম্যের কথা বলছে এবং উচ্চশিক্ষায় পুরুষের চাইতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি। নারীদের এই পিছিয়ে পরার কারণ অনুসন্ধানে দেখা যায, সাধারণ নারীরা কর্মক্ষেত্রে যোদগানের পর বা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পার্টির সদস্যপদ লাভ করেন। নি¤œস্তরে অর্থাৎ কাউন্টি এবং টাউনশিপ পর্যায়ে নেতৃত্বে আসা নারীদের জন্য বেশ কঠিন। অধ্যাপক লিনেইট এইচ হং এর মতে, ‘চীনে প্রচলিত ধারণা এই যে, নারীদের স্থান রান্নাঘরে আর তাদের কোন উচ্চাকাক্সক্ষা থাকতে নেই।’ নারীরা গৃহে থাকবেন স্বামী, সন্তানের যতœ নেবেন সেটাই কাম্য। মাও দেজ দং যাই বলে থাকুন রাজনীতিতে সম্মানজনক অবস্থান অর্জনের জন্য নারীদের পাড়ি দিতে হতে দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ। জাতীয় নেতৃত্বে নারীদের পিছিয়ে থাকার আরও কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় পর্যায়ে আসার পূর্বে তাদের ঠাঁই করে নিতে হয় প্রাদেশিক সরকার বা দলীয় পদে। বিষয়টি সময় সাপেক্ষ। সে কারণে নেতৃত্বের মাঝামাঝি পর্যায়ে কিছু নারীর দেখা মিললেও শীর্ষ পর্যায়ে তাদের দেখা যায় খুব কম। অপরদিকে অবসর গ্রহণের বয়স সীমাও নারীদের বিপক্ষে। পুরুষদের জন্য যেখানে অবসর গ্রহণের বয়স ৬০ সেখানে সরকারী চাকুরে ও দলীয় পদধারী নারীদের জন্য তা ৫৫। অপরদিকে সাধারণ নারী কর্মীদের জন্য অবসরের বয়স ৫০। লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সের অধ্যাপক জুড হাওয়েল বলেন, ‘চীনে রাজনীতিতে নারী এগিয়ে আসার প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সরকারের উদ্যোগের যেমন অভাব আছে তেমনি আসন সংরক্ষণও তেমন কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ‘পুরুষ প্রভাবিত আমলাতন্ত্রও এ ব্যাপারে একটি বড় বাধা। এ মুহূর্তে কোন প্রভিন্সে পর্যন্ত, নেতৃত্বের শীর্ষে নারী নেই অথচ শীর্ষ পর্যায়ে আসার পূর্বশর্ত এটি। সব মিলিয়ে আগামীতে শীর্ষ নেতৃত্বে আসার পথ নারীদের জন্য প্রায় রুদ্ধ এ কথা বলাই যায়। সারা বিশ্বের চিত্রটি যে চীনের চেয়ে ব্যতিক্রম এ কথা বলারও কোন উপায় নেই। রাষ্ট্র পরিচালনার নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতির চিত্র সর্বত্রই প্রায় এক। যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স নারীদের উপস্থিতি ৩২% বা সর্বোচ্চ। ভারতীয় লোকসভায় নারী প্রতিনিধি ১১% আর জাপানের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে এই সংখ্যা ৯%। কিউবার ক্ষেত্রে চিত্রটি ব্যতিক্রম তাদের এ্যাসেম্বেলা নাসিওনালে নারী প্রতিনিধি ৪৯%। তবে চীনে যেখানে কমিউনিস্ট পার্টির নারী সদস্য মোট সংখ্যার ২৬% সেখানে কিউবা বা ভিয়েতনামে এই সংখ্যা ৩৩%। আবার বহুদলীয় গণতান্ত্রিক দেশগুলোর চিত্রও খুব একটা ব্যতিক্রম নয়। জার্মানিতে এ্যাঞ্জেলা মার্কেলের দল সিডিইউতে নারী সদস্য ২৬%, যুক্তরাজ্যে থেরেসা মে’র কনজারভেটিভ পার্টিতে এই সংখ্যা প্রায় ৩০%। এদিকে ইউনিভার্সিটি অব সাও কার্লোসের এক জরিপ জানাচ্ছে। ব্রাজিলের সাও পাওলোতে সবদল মিলিয়ে নারী সদস্য ৩৩%। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই কেবল নিজ দেশে নয় বিশ্ব রাজনৈতিক মঞ্চেও নারী তার যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে বহুবার। মার্গারেট থেচার, ইন্দিরা গান্ধী কিংবা হালের এ্যাঞ্জেলা মার্কেল তো রীতিমতো উদাহরণ। কিন্তু এটিও সত্যি যে, এর ফলে যে সার্বিক চিত্রটির উন্নতি ঘটেছে তা নয়। এমনকি তাদের দেশেও রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ বা প্রতনিধিত্বের চিত্রটি আশাব্যঞ্জক নয়। এ কথা মানতেই হবে নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম প্রধান শর্তই হচ্ছে রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে অধিকহারে নারীর অংশগ্রহণ। সে আলোকে বলা যায় চীনের কমিউনিস্ট পার্টিতে নারী প্রতিনিধির স্বল্প উপস্থিতি কেবল চীনের সঙ্কট নয় এটি এখন বিশ্বের প্রায় প্রতিটি রাষ্ট্রের।
×