ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

জুবায়ের বারি

অগ্ন্যুৎপাতের আগাম তথ্য!

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৩ নভেম্বর ২০১৭

অগ্ন্যুৎপাতের আগাম তথ্য!

আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত দূর থেকে দেখতে অনেকের ভালই লাগে। তবে অগ্ন্যুৎপাতের ভয়াবহতা অনুভব করেন সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা। জার্মান বিজ্ঞানীরা অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কে আগাম জানার চেষ্টা করছেন। আমাদের বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। এর ফলে টনকে টন ছাই এবং লাভা ভূ-পৃষ্ঠে ছড়িয়ে পড়ে। দূর থেকে অগ্ন্যুৎপাত দেখতে অনেকের ভালই লাগে। কিন্তু যারা সেটির কাছে থাকেন, তাদের জন্য এটা ক্ষয়ক্ষতি, ধ্বংস এবং ভাঙ্গনের প্রতীক। আমাদের বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত। অগ্ন্যুৎপাত ঘটার কারণ অনুসন্ধানের চেষ্টা করছেন জার্মানির পটসডামে অবস্থিত জিওসায়েন্সেস গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। ভূ-পদার্থবিদ বিয়র্গার গটফ্রিড ল্যুয়র পৃথিবীর ১৫০০ সক্রিয় আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং কম্পন সম্পর্কিত কার্যকলাপ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি বলেন, ‘একটি আগ্নেয়গিরি সাধারণত কয়েক শ’ বছর ধরে ঘুমন্ত অবস্থায় থাকে। এরপর হঠাৎ করে সক্রিয় হয়। তবে এই সক্রিয় হওয়ার কিছু পূর্ব লক্ষণ রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ মাউন্ট সেন্ট হেলেনস বা পিনাটুবোর কথা বলা যেতে পারে। অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কে কিছু ক্ষেত্রে আগে থেকে অনুমান করা সম্ভব। তবে কাজটি বেশ কঠিন।’ দু’রকম অগ্ন্যুৎপাত অগ্ন্যুৎপাতের ধরন মূলত দু’রকম। একটি ক্ষেত্রে গ্যাসের বিস্ফোরণ ঘটে এবং ম্যাগমা ও পাথর বেরিয়ে আসে। অন্যথায় গ্যাস সৃষ্ট কোন বিস্ফোরণ ছাড়াই লাভা বেরিয়ে আসে। তবে প্রতিটি অগ্ন্যুৎপাত থেকে বেরিয়ে আসা ম্যাগমা, লাভা এবং ছাইয়ের কিছু আলাদা বিশেষত্ব রয়েছে। এ সব অবশ্য ভূগর্ভে থাকা বিভিন্ন পদার্থ সম্পর্কে গবেষণায় গবেষকদের সহায়তা করে। পটসডামের গবেষণাগারে লাভার মধ্যে থাকা বিভিন্ন বস্তু আলাদা করেন গবেষকরা। অগ্ন্যুৎপাতের সময়কার গতি এবং তাপমাত্রা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় বিভিন্ন পার্টিকেলের আকার এবং আয়তন দেখে। এ সব তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আগ্নেয়গিরিটা আবারও কবে অগ্ন্যুৎপাত ঘটাবে তা ধারণা করা যায়। জিএফজেড পটসডামের গবেষক রাল্ফ নাউমান এই বিষয়ে বলেন, ‘এটা অপরাধতত্ত্বের মতো নয় যে অনেক সময় একশ’ ভাগ সঠিক ফলাফল জানা সম্ভব। অগ্ন্যুৎপাতের সম্ভাব্যতা বিবেচনার জন্য শুধু একটি নমুনা নয়, বরং ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি নমুনা নিয়ে গবেষণা করা হয়। অর্থাৎ ভূ-পৃষ্ঠ থেকে নেয়া লাভার নমুনার পাশাপাশি ভূগর্ভ থেকে পাওয়া নমুনাও পরীক্ষা করা হয়।’ মূল চালিকাশক্তি এখনও কিছু ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা থাকলেও অগ্ন্যুৎপাতের ক্ষমতা সম্পর্কে গবেষণার ক্ষেত্রে গবেষকরা বেশ এগিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘অগ্ন্যুৎপাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে তরল পদার্থ এবং পানি। আর এই তরল এবং পানিই অগ্ন্যুৎপাতকে বিস্ফোরণে পরিণত করে।’ তবে অগ্ন্যুৎপাতের সব রহস্য কিন্তু এখনও সমাধান হয়নি। বিশেষ করে বিজ্ঞানীরা ঠিক কবে নাগাদ অগ্ন্যুৎপাত সম্পর্কে একেবারে সঠিক তথ্য জানাতে পারবেন এবং আগেভাগেই সে সবের ক্ষতির মাত্রা নিরূপণে সক্ষম হবেন, সেটা কেউ জানে না। সুপ্ত আগ্নেয়গিরি যখন জাগ্রত হয় ‘কাম্পি ফ্লেগ্রেই’ যে একটি আগ্নেয়গিরি এলাকা, এখানকার গন্ধক মাটি তার প্রমাণ। কিন্তু মাটির নিচে কি কোনো বড় বিস্ফোরণ দানা বাঁধছে? ইতালির নেপলস শহরের কাছে অবস্থিত ‘সলফাতারা’ বস্তুত একটি সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মুখ, যা ফ্লেগ্রেই আগ্নেয়গিরি এলাকার অংশ। এখানে মাটির নিচে যে সুবিশাল আগ্নেয়গিরিটি আছে, তার গভীর থেকে গন্ধকবাহী বাষ্প ওপরে উঠে আসেÑ দেখা যায়, আবার গন্ধতে বোঝাও যায়। বিজ্ঞানীরা এবার জানতে চান, ‘সুপার ভলক্যানো’-টির ভেতরে কী ঘটছে। আগ্নেয়গিরি এলাকায় যে ভূকম্পন আরও ঘন ঘন ঘটছে, বিজ্ঞানীরা সেদিকে খেয়াল রাখেন। এ ছাড়া স্যাটেলাইটের মাধ্যমে আগ্নেয়গিরির সুবিশাল গহ্বরটির উপরিভাগে কী ঘটছে, সেদিকেও নজর রাখেন: গত দশ বছরে এখানকার জমি অন্তত আরও আধ মিটার উঁচু হয়ে গেছে। বিপদ সঙ্কেত জোভানি কিওদিনির মতো আগ্নেয়গিরি বিশেষজ্ঞরা এই বিপদ সঙ্কেত লক্ষ্য করেছেন ও তার তাৎপর্য বোঝার চেষ্টা করছেন। জোভানি বলেন, ‘এটা যে একটানা ঘটেছে, এমন নয়, বরং যেন দ্রুততর হয়েছেÑ গত বছর তার আগের বছরের চেয়ে বেশি। কাজেই আমরা এই আগ্নেয়গিরিতে ভবিষ্যতে কী ঘটবে, তা নিয়ে একটু চিন্তিত।’ আগামীতে এই আগ্নেয়গিরিতে কোন বিস্ফোরণ ঘটবে কিনা, বিজ্ঞানীরা তা জানার চেষ্টা করছেন। সেজন্য তারা পাথরের ফাটল থেকে যে বাষ্প বেরোচ্ছে, তা বিশ্লেষণ করে দেখছেন। এই ফাটলগুলোকে বলে ‘ফিউমারোল’। লক্ষণীয় বিষয় হলো, গত ১৫ বছরে ফিউমারোলগুলো থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে চারগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জোভানি বলেন, ‘ফিউমারোলগুলো থেকে নির্গত বাষ্পে যে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে, তা নিয়ে আমরা চিন্তিত। কারণ, এর সঙ্গে তাপমাত্রার যোগ আছে। আগ্নেয়গিরির অভ্যন্তরে তাপমাত্রা যতো বাড়বে, মনোক্সাইড নির্গমনও ততো বাড়বে। কাজেই মনোক্সাইড নির্গমন বৃদ্ধিকে আমরা আগ্নেয়গিরির তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রমাণ বলে গণ্য করছি।’ কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধিই কেবল একমাত্র লক্ষণ নয়: ফিউমারোল থেকে নির্গত বাষ্পের পরিমাণ ও তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জোভানি কিওদিনির কাছে এসব পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে ম্যাগমাÑভূ-ত্বকের নীচে সেই তরল বা আধা-তরল পদার্থ, যা পরে লাভা হিসেবে বেরিয়ে আসে। জোভানি বলেন, ‘‘ম্যাগমার গ্যাস থেকে এই প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে বলে আমাদের ধারণা। মাঝে মাঝে ম্যাগমা বিপুল পরিমাণ তরল পদার্থ ছাড়ে; সেই তরল পদার্থ ‘কালডেরা’ বা ম্যাগমা কক্ষের উপরিভাগে পৌঁছলে, ফিউমারোল দিয়ে তা বেরিয়ে আসে।’ ‘হাইড্রোথার্মাল’ প্রণালী ‘হাইড্রোথার্মাল’ প্রণালী বলতে বোঝায় পাথর ও পানির একটি স্তর। ফ্লেগ্রেই এলাকার উপরিভাগ এই স্তর দিয়ে তৈরি। ম্যাগমা ওপরে উঠতে শুরু করলে চাপ কমে যায়। ম্যাগমার গ্যাসগুলো বেরিয়ে এসে উপরের স্তরে জমা হয়। আগ্নেয়গিরিতে বিস্ফোরণ ঘটবে কিনা, তা ম্যাগমায় মিশে থাকা এই গ্যাসগুলোর উপরেও নির্ভর করে। জোভানি বলেন, ‘গ্যাস নির্গমনের প্রক্রিয়াটা সহজেই বোঝা যায়: আমরা যখন সোডার বোতল খুলি তখন চাপ কমে গিয়ে অনেকটা গ্যাস বেরিয়ে আসে। আগ্নেয়গিরির ক্ষেত্রে সোডাওয়াটারের বদলে থাকে ম্যাগমা, যা থেকে গ্যাস বেরিয়ে আসে।’ জোভানি কিওদিনি কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে হিসেব করার চেষ্টা করছেন, ম্যাগমা থেকে নির্গত গ্যাস ওপরের হাইড্রোথার্মাল স্তরের উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে। কিওদিনির মডেলে ‘ফ্লেগ্রেই প্রান্তর’-এর নীচে যে পরিমাণ ম্যাগমা ওপরে উঠে আসছে, তা একটি চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে ও থেকে থেকে বিপুল পরিণাম জলজ বাষ্প ওপরে পাথরের স্তরে পাঠিয়ে দিচ্ছে। পাথরের স্তরের তাপমাত্রা ক্রমেই বাড়ছে ও তা আরও ঝুঁঝরো ও স্থিতিহীন হয়ে পড়ছে। কম্পিউটার শিমুলেশনে শেষ অবধি পাথরের স্তর আর চাপ সামলাতে পারবে নাÑ ফলে আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ ঘটবে। বিজ্ঞানীরা অন্যান্য আগ্নেয়গিরির সঙ্গে তুলনা করেছেন: অনুরূপ আগ্নেয়গিরির ক্ষেত্রে জমি উঁচু হতে শুরু করা থেকে ম্যাগমার গ্যাস নির্গত হওয়া পর্যন্ত। অর্থাৎ আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ অবধি, ১৫ বছর সময় লেগে যায়। জোভানি বলেন, ‘এখানে এটা একটা বিপর্যয় ঘটাতে পারে, কেননা অতীতের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণগুলোর মধ্যে একাধিক ইউরোপ অথবা এই ভূ-মধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ঘটেছে। কাজেই আমাদের মতো বহু মানুষ, যারা আগ্নেয়গিরি নিয়ে কাজ করছেন, তাদের প্রচেষ্টা হল, আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের লক্ষণ কিভাবে আরও ভালোভাবে বোঝা যায়।’ কেউ বলতে পারবে না, ‘ফ্লেগ্রেই প্রান্তর’-এ পরবর্তী বিস্ফোরণ কবে ঘটবে। তবে বিজ্ঞানীরা ইতোমধ্যেই অশনি সঙ্কেত দেখছেন। সূত্র : বিবিসি, ডয়েচ ভেলে
×