ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

যৌন হয়রানি রোধ ॥ সুনির্দিষ্ট আইন নেই, বিচার হয় না

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ৩ নভেম্বর ২০১৭

যৌন হয়রানি রোধ ॥ সুনির্দিষ্ট আইন নেই, বিচার হয় না

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ২০১৫ সালের পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বর্ষবরণে উপস্থিত কয়েকজন নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। এ ঘটনার মামলায় আট আসামিকে শনাক্ত করেছিল পুলিশ। পরে শনাক্তকৃত আট আসামির মধ্যে একজন আটক হলে তাকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে মামলাটি পুনঃতদন্তের আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে বাকি ৭ আসামির জন্য এক লাখ টাকা করে পুরস্কার ঘোষণার প্রেক্ষিতে, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার করার পরও আসামিদের নাম-ঠিকানা ও সন্ধান এখনও পাওয়া যায়নি। তাই এখনও এ মামলার বিচারকার্য শুরু হয়নি। পহেলা বৈশাখের এ ঘটনাটিই নয় গণপরিসরে নারীদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধে বাংলাদেশে কোন সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় কোন ঘটনার বিচার সুষ্ঠুভাবে হয় না। তবে বিদ্যমান আইনে কিছু বিধান থাকলেও নেই তার প্রয়োগ। দীর্ঘ সময় পার হলেও এসব যৌন হয়রানির মামলাগুলোর বিচার ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। অভাব আছে সচেতনতারও। ফলে গণপরিসরে নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হলে আইনীভাবে তার প্রতিকার খুবই কম পান তারা। একশনএইড বাংলাদেশের ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিসমূহ পর্যালোচনা’ বিষয়ক এক গবেষণায় সম্প্রতি এমন তথ্য উঠে এসেছে। যেখানে বলা হয়েছে, নারীর প্রতি যৌন সহিংসতা প্রতিরোধ ও প্রতিকারের জন্য সংশ্লিষ্ট সংস্থার সদস্যরা তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন নয় এবং অনেক ক্ষেত্রে সঠিক দায়িত্ব পালন করে না। প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যার পাশাপাশি রাজনৈতিক, সামাজিক ও পুরুষতান্ত্রিকতার মতো সমস্যাগুলো যৌন হয়রানি ও সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে। গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (২০০৩ এ সংশোধিত)-এ যৌন হয়রানিকে অপরাধ হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। ২০০৩ সালের সংশোধনীটিতে অস্পর্শিত যৌন হয়রানির কিংবা মৌখিক যৌন হয়রানি প্রতিকারের কোন বিধান রাখা হয়নি। এছাড়া ওই সংশোধনীর পর কার্যত দেশে যৌন হয়রানির সমস্যা সমাধানে সরাসরি কোন আইনও করা হয়নি। অন্যদিকে দ-বিধির ৫০৯ ধারায় কথা বা আচরণের মাধ্যমে যৌন হয়রানির সাজার বিধান দেয়া হয়েছে। ১৮৬০ সালে প্রণিত এই আইনে গত ১৫৭ বছরে মাত্র একটি মামলা হওয়ার কথা জানা যায়। অথচ এমন যৌন হয়রানির ঘটনা হরহামেশা ঘটছে এবং এর মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। আবার দ-বিধি ১৮৬০-এর ধারা-৫৯০ কে মোবাইল কোর্ট আইন ২০০৯ এর শিডিউলে যোগ করা হয়েছে। এই বিচারিক পদ্ধতিতে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য কোন আইনজীবী নিয়োগের এবং নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার কোন সুযোগ নেই। যা অভিযুক্ত ব্যক্তির অধিকার লঙ্ঘন করে। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬; চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স ১৯৭৮ এবং খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫ আইনে নিজস্ব মেট্রোপলিটন অধিভুক্ত এলাকার বাইরে কাজের কোন এখতিয়ার নেই। তাই এটি যৌন হয়রানিকে শুধু স্থানীয় ও শহরে ঘটমান বিষয় হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রসঙ্গে একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘সংবিধানের ২৮, ২৯, ৩২, ৩৬ ধারায় নারীর চিন্তা, কাজ, চলাফেরায় স্বাধীনতার কথা বলা হয়েছে। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের আইনগুলো সেই সুরক্ষা দেয়নি। জনউন্মুক্ত জায়গায় নারীরা সব সময় যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। আবার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নারীরা সহযোগিতা পান না। ফলে ভয়ে এখন নারীরা বাইরে যেতে চায় না। এটি আমাদের পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থার খারাপ পরিস্থিতি।’ আইনী প্রক্রিয়ার হয়রানিমূলক বৈশিষ্ট্যের কারণে সুবিচার আজ প্রশ্নবিদ্ধ। এ কারণে বেশিরভাগ নারীই আইনী সহযোগিতা নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না। গবেষণায় দেখা গেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা যৌন সহিংসতার বিষয়ে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন নন। সংস্থার মধ্যে জবাবদিহিতা উপেক্ষা করার প্রবণতা রয়েছে। দোষীদের গ্রেফতার ও তদন্তের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের প্রভাবে গ্রেফতারের প্রতি অনীহা দেখা যায়। আবার পুলিশের দায়বদ্ধতার অভাবে তদন্ত প্রক্রিয়ায় অনেক সময় লাগে। এছাড়া পাবলিক প্রসিকিউটর, আইনজীবী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা জনউন্মুক্ত স্থানগুলোতে সংঘটিত যৌন হয়রানি এবং অন্যান্য সহিংসতা থেকে নারীদের সুরক্ষা সম্পর্কে সংবেদনশীল নয়। বেশিরভাগ সরকারী হাসপাতাল ধর্ষণের চিকিৎসা ও পরীক্ষার জন্য যথোপযুক্ত নয়। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ এর ধারা ৩২ অনুসারে, সঠিক সময়ে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে ধর্ষিত ব্যক্তির স্বাস্থ্য পরীক্ষা সম্পন্ন করার জন্য পুলিশ ও ডাক্তাররা সম্পূর্ণরূপে সচেতন নন। জাতীয় আইন কমিশনের কর্মকর্তা ফারজানা হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের নারীদের সহিষ্ণুতার মাত্রা অনেক। যুগোপযোগী আইন না থাকায় নারীরা খারাপ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন। এখন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে জনপরিসরে সহিংসতা ঠেকাতে সুনির্দিষ্ট আইনের দরকার। দরকার সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞার। তিনি আরও বলেন, ‘আইন প্রয়োগের বিষয়টি আমাদের দেশে এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। এজন্য সরকারের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে। বিচারকরাও নীতিমালা ও নির্দেশনা তৈরি করতে পারেন। পুলিশকে হয়রানির জন্য নয়, আমাদের সহায়তার জন্য থাকতে হবে। হয়রানি বন্ধে একটা সমন্বিত আইন থাকা উচিত। যেখানে সব ধরনের হয়রানির সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকবে। এমনকি জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে এসব বিষয় তুলে ধারা উচিত।’ এ গবেষণা প্রতিবেদনে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরে একশনএইড বাংলাদেশ। যেখানে বলা হয়েছে, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ আইনে ব্যক্তিগত ও সর্বজনীন উভয় স্তরে যৌন হয়রানিকে একটি অপরাধ হিসেবে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা উচিত। যাতে নারীরা তাদের ওপর সংঘটিত অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে। এছাড়া উচ্চ আদালত থেকে প্রাপ্ত নির্দেশাবলীর মধ্যে উল্লেখিত ‘যৌন হয়রানি’র সংজ্ঞা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সরকারের উচিত ক্ষতিগ্রস্ত এবং সাক্ষীদের রক্ষা করার জন্য আইন প্রণয়ন করা, যেন মামলাগুলোর কার্যক্রম নির্বিঘ্নে চলতে পারে। সেই সঙ্গে পুলিশের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে, যেন তাতে বিচারিক কার্যক্রম দ্রুতগতিতে চলে। তদন্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার জন্য কঠিন পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কর্তব্যরত অবস্থায় পুলিশকে বাইরের হস্তক্ষেপ, প্রভাব বা চাপ থেকে মুক্ত করার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নিতে হবে। নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার প্রতি পুলিশকে প্রতিক্রিয়াশীল এবং সংবেদনশীল করতে রাজনৈতিক ইচ্ছার প্রয়োজন। ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির চিকিৎসা ও পরীক্ষার জন্য হাসপাতালগুলোকে উপযোগী করে তুলতে হবে। ন্যায়বিচার পাওয়ার লক্ষ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি এবং সাক্ষীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
×