ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

করিমের তৃতীয় স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ, দ্বিতীয় স্ত্রীকেও খোঁজা হচ্ছে

ধনসম্পত্তি নিয়ে দাম্পত্য কলহে কাকরাইলে জোড়া খুন!

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৩ নভেম্বর ২০১৭

ধনসম্পত্তি নিয়ে দাম্পত্য কলহে কাকরাইলে জোড়া খুন!

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ রাজধানীর কাকরাইলে প্রথম স্ত্রী শামসুন্নাহার ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওন মা-ছেলে জোড়া খুনের ঘটনায় আব্দুল করিমের তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তাকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। পুলিশ তার দ্বিতীয় স্ত্রীকেও খুঁজছে। মা-ছেলে জোড়া খুনের ঘটনায় নিহতের স্বামী করিম, বাড়ির দারোয়ান নোমান, গৃহপরিচালিকা রাশিদা ও তৃতীয় স্ত্রী মুক্তাসহ এই চারজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। ধনাঢ্য আবদুল করিমের ধন সম্পত্তিকে কেন্দ্র করে দাম্পত্য কলহের জের ধরে প্রথম স্ত্রী ও তার পুত্র খুন হয়ে থাকতে পারে বলে মনে করছে পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তারা। খুন হওয়া শাসসুন্নাহার ও তার ছেলে শাওনের সুরতহাল রিপোর্ট তৈরি ও ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। শামসুন্নাহারের থুতনি, বুক ও পেটে ছুরিকাঘাতের জখম আর শাওনের গলাকাটা ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে মা-ছেলে জোড়া খুনের ঘটনায় খুনী কাউকে গ্রেফতার করতে পেরেছে এমন নিশ্চয়তা দিতে পারেননি পুলিশ। মা-ছেলে জোড়া খুনের ঘটনার খুনীরা পূর্ব পরিচিত, পূর্ব পরিকল্পিত, ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়েছে, খুনে ভাড়াটিয়া খুনী ব্যবহৃত হয়ে থাকতে পারে বলে তদন্তের সঙ্গে পুলিশের দাবি। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্রে এ খবর জানা গেছে। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ সূত্র জানান, রাজধানীর নয়া পল্টনের একটি বাসা থেকে বৃহস্পতিবার শারমিন আক্তার মুক্তা নামে এক নারীকে আটক করেছে পুলিশ। তাকে আটকের পর পুলিশ জানায়, তিনি করিমের তৃতীয় স্ত্রী। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর চার বছর আগে তিনি মুক্তাকে বিয়ে করেন আবদুল করিম। হত্যাকা-ের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মুক্তাকে আটক করা হয়েছে বলে পুলিশের দাবি। বুধবার সন্ধ্যায় কাকরাইলে রাজমনি প্রেক্ষাগৃহের পশ্চিম দিকে রাজমনি কার সেন্টার ও বায়রা ডাটাবেইজ প্রতিষ্ঠানের মাঝের গলিতে আব্দুল করিমের বহুতল ভবনের পাঁচ তলার ফ্ল্যাটে খুন হন তার স্ত্রী শামসুন্নাহার ও ছেলে সাজ্জাদুল করিম শাওন। একটি ফ্ল্যাটের মধ্যে মা ও সিঁড়িতে ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। দু’জনকেই উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে পুলিশ। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাড়ির মালিক আব্দুল করিম একসময় সিনেমার ব্যবসা করতেন। এখন তিনি বীজ, পেঁয়াজ, রসুন আদার আমদানিকারক। শ্যামবাজারে তার আড়ত আছে। ওইখানে পাশাপাশি তার তিনটি বাড়ি রয়েছে। তার তিন ছেলে। বড় ছেলে মুন্না লন্ডন প্রবাসী। মেঝ ছেলে অনিক কানাডায় থাকে। আর ছোট ছেলে শাওন মায়ের কাছে থেকে পড়াশোনা করে। সে এ লেভেলে পড়ে। শামসুন্নাহার খুবই ধর্মভিরু ছিলেন। তিনি বোরখা পরতেন। চোখ ছাড়া আর সবকিছু ঢেকে চলাফেরা করতেন শামসুন্নাহার। এক স্বামীর তিন স্ত্রীকে বিয়ে করায় তার ধন সম্পত্তি ও দাম্পত্য কলহের কারণটি হত্যাকা-ের মটিভকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। পুলিশ কর্মকর্তারা আব্দুল করিমের পরিবারের প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলেও পারিবারিক জটিলতার আঁচ পাওয়া গেছে। খুনের সময়ে ব্যবসায়ী করিম তখন ঘরে ছিলেন না। তিনি গ্রোসারি ব্যবসা ছাড়াও এফডিসিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রের প্রযোজনা ও পরিচালনায় যুক্ত বলে জানিয়েছেন পুলিশ। বাড়ির পঞ্চম তলার ফ্ল্যাটে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে মা ও ছেলেকে হত্যা করা হয়। শামসুন্নাহারের লাশ শোবার ঘরে ছিল, সিঁড়িতে পড়ে ছিল শাওনের লাশ। দুটি মৃতদেহের সুরতহাল প্রস্তুতকারী রমনা থানার এসআই আতোয়ার হোসেন বলেন, শাওনের গলাকাটা ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। শামসুন্নাহারের থুতনি, বুক ও পেটে ছুরিকাঘাতের জখম। রমনা থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত হত্যাকা-ে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। মামলাও হয়নি। নিহত শামসুন্নাহারের গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জ। তার ভাই ঢাকায় এলে মামলা করা হবে বলে পুলিশ কর্মকর্তারা জানান। হত্যাকা-ের কারণ কি তা জানতে চাইলে রমনা থানার পুলিশ কর্মকর্তা জানান, যেহেতু আব্দুল করিম তিনটি বিয়ে করেছেন। তাই পারিবারিক বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে তদন্ত কাজ করছি। তবে ব্যবসায়িকসহ অন্যান্য বিষয়ও মাথায় রেখেছেন বলে জানান ওই পুলিশ কর্মকর্তা। খুন হওয়া শামসুন্নাহার ব্যবসায়ী করিমের প্রথম স্ত্রী। তার বড় দুই ছেলে বিদেশে থাকেন। হত্যাকা-ের পর পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছিলেন, করিমের দ্বিতীয় স্ত্রী রয়েছে। বৃহস্পতিবার তার তৃতীয় স্ত্রীর খোঁজ পাওয়া যায়। তৃতীয় স্ত্রী শারমিন আক্তার মুক্তা নামে এক নারীকে বৃহস্পতিবার নয়া পল্টনের একটি বাসা থেকে আটক করেছে। স্ত্রী মুক্তাকে আটকের পর পুলিশ জানায়, তিনি করিমের তৃতীয় স্ত্রী। দ্বিতীয় স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ির পর চার বছর আগে তিনি মুক্তাকে বিয়ে করেন আব্দুল করিম। তার তিন স্ত্রীই ঢাকায় থাকেন। তার তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকেও খোঁজ হচ্ছে। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানান তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা। করিমের প্রথম স্ত্রীর ঘরে তিন ছেলে, তালাকপ্রাপ্ত দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরে এক ছেলে রয়েছে। তৃতীয় স্ত্রী মুক্তার কোন সন্তান নেই। হত্যাকা-ের পর করিম, বাড়ির দারোয়ান নোমান এবং গৃহকর্মী রাশিদাকে থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। মুক্তার দুই ভাইয়ের সঙ্গে বাড়ি বা জমিসংক্রান্ত কোন বিরোধ ছিল কিনা সেই বিষয়েও খোঁজ নিচ্ছে পুলিশ। বাড়ির দারোয়ান নোমান পুলিশকে বলেছে, বুধবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে আমি নিচে ডিউটি করছিলাম, হঠাৎ একজন ভাড়াটিয়া নিচে নামার সময় আমাকে বলেন ৫ তলায় কারা যেন গ-গল করছে। আমি তখন উপরে উঠে সিঁড়িতে দেখি শাওন (১৮) রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। ভেতরে তার মাকে ডাকতে গিয়ে দেখি একটা কক্ষে রক্তাক্ত অবস্থায় তিনিও পড়ে আছেন। এ সময় আমি চিৎকার করে আশপাশের লোকজনকে ডেকে আনি। এর কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ আসে। বাড়ি থেকে অপরিচিত কেউ বের হয়ে গেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন আমি দেখিনি। বুধবার সন্ধ্যার পর এক ব্যক্তি ওই ভবন থেকে নামার সময় তাকে উপরে ঝামেলা হচ্ছে বলে গিয়েছিলেন। তখন তিনি উপরে গিয়ে লাশ দেখতে পান। তিনি (দারোয়ান) পুলিশকে জানান, দুটি ভবনের একজনই দারোয়ান নোমান। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দারোয়ান নোমান শুধু দারোয়ানগিরিই করে না, ভাড়া ওঠানো থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালার বাজারও করে। ওই সময় ঘরে থাকা গৃহপরিচালিকা রাশিদা পুলিশকে বলেছেন, এক মাস আগে আমি এই বাড়িতে কাজ যোগ দিয়েছি। অন্যদিনের মতো বুধবারও সাড়ে ৫টার দিকে বাড়িতে প্রবেশ করি। খালা (করিমের স্ত্রী) দরজা খুলে দেয়ার পর সোজা রান্নাঘরে গিয়ে রান্নার প্রস্তুতি নেই। ১০/১৫ মিনিট পরে দেখি রান্নাঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তখন মনে করেছি খালা হয়ত বাইরে থেকে বন্ধ করে রেখেছেন। কিছুক্ষণ পরই খালার চিৎকার শুনতে পাই। তিনি বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার করছিলেন। আমি তখন রান্নাঘরের জানালা দিয়ে চিৎকার করতে থাকি। এর কিছুক্ষণ পর দারোয়ান নোমান এসে দরজা খুলে আমাকে বের করেন। তখন আমি দেখি খালা ও মামার লাশ পড়ে আছে। ততক্ষণে হত্যাকা- ঘটিয়ে খুনীরা পালিয়ে গেছে। গৃহকর্মী রাশিদা এক মাস আগে এই বাসায় কাজে যোগ দিয়েছে। তার স্বামী আব্দুল গনি দুদকের পাশে টিনশেড বস্তিতে থাকে। ময়মনংসিহে তাদের গ্রামের বাড়ি। সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে, যেই ভবনে মা-ছেলে খুন হলেন সেই ভবনের নিচে অফিস এবং পাশে করিমের আরেকটি ভবনের নিচে দর্জি দোকান থাকলেও কেউ কিছু টের পায়নি। কাকরাইলে রাজমনি ঈশা খাঁ হোটেলের বিপরীত দিকে ওভারব্রিজের পাশের গলির ভেতরে ভবনে ঘটে এই হত্যাকা-টি ঘটেছে। বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থলে গিয়ে আশপাশের ভবনগুলোর বাসিন্দাদের এমন স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় দেখা গেছে যে, আগের দিন এখানে খুনের ঘটনা ঘটেছে তার কোন রেশ দেখা যায়নি। বৃহস্পতিবার দুপুরে ঝাড়ু দিতে দেখা যায় নুরুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তিকে। যে ভবনে খুন হন শামসুন্নাহার ও শাওন, তার নিচে প্রধান ফটকের সামনে তিনি ঝাড়ু দিচ্ছেন। তার কাছে খুনের ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই স্থানে প্রতিদিন জোহর, আসর ও মাগরিবে নামাজ পড়ানো হয়। এতে অংশ নেন আশপাশের বিভিন্ন অফিসের কর্মীরা। বুধবার মাগরিবের নামাজ পড়িয়ে চলে যাওয়ায় খুনের বিষয়ে কিছু জানেন না বলে জানান নুরুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার কাকরাইলের ঘটনাস্থলে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর জনাকীর্ণ এলাকা কাকরাইলের রাজমণি-ইশা খাঁ হোটেলের বিপরীত পাশে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম গলির ষষ্ঠ তলা একটি ভবনের ৫ তলায় থাকতেন নিহত শামসুন্নাহার ও তার পুত্র শাওন। ৭৯/১, মায়াকানন নামের এই বাড়িটির মালিক আব্দুল করিম। তার স্ত্রী শামসুন্নাহার করিম (৪৫) ও ছেলে শাওন করিম (১৮) এই ফ্ল্যাটে বসবাস করতেন। এই এলাকায় আব্দুল করিমের তিনটি ভবন। বাড়িটির নিচতলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত সব ফ্ল্যাট ভাড়া দেয়া। চতুর্থ তলায় একটা ল’ চেম্বারও আছে। নিচ তলায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিসও রয়েছে। অন্য ফ্ল্যাটগুলোতে ভাড়াটিয়ারা থাকেন। ষষ্ঠ তলায়ও ভাড়া দেয়া। করিমের দুটি ভবনের নিচেই কলাপসিবল গেট আছে, তবে অফিস থাকার কারণে সেগুলো প্রায় সর্বক্ষণই থাকে খোলা। এই বিষয়টি তুলে ধরে হত্যাকা-ের পর নিরাপত্তাহীনতার ভোগার কথা জানান এক ভাড়াটিয়া। আলাপ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভাড়াটিয়া বলেন, উনারা (করিম) বড়লোক। ঢাকায় তিন চারটি বাড়ি ছাড়াও শ্যামবাজারে আড়ত আছে। তিনটি বিয়ে করেছেন। তৃতীয় স্ত্রীর ভাইদের সঙ্গে ঝামেলার কথাও শুনেছি। তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, খুব শীঘ্রই মা-ছেলে জোড়া খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন হবে। খুনীরাও ধরা পড়বে।
×