ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্যে ন্যায় বিচার না পাওয়ার আশঙ্কা

দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার স্থায়ী জামিনের আবেদন নাকচ

প্রকাশিত: ০৫:১৬, ৩ নভেম্বর ২০১৭

দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার স্থায়ী জামিনের আবেদন নাকচ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার স্থায়ী জামিনের আবেদন নাকচ করেছে আদালত। বৃহস্পতিবার পুরান ঢাকার বকশীবাজারে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের বিচারক ড. আখতারুজ্জামান জামিন আবেদন নাকচ করেন। অন্যদিকে, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১১ সাক্ষীকে জেরা করার বিষয়ে খালেদা জিয়ার লিভ টু আপীল শুনানি শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রথম দিনের শুনানি শেষে রবিবার পর্যন্ত মুলতবি করে আপীল বিভাগ। এদিন জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে খালেদা জিয়া বলেছেন, রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে তাকে সরাতে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার নীলনক্সা বাস্তবায়ন করছে ক্ষমতাসীনরা। প্রায় বিশ মিনিটের বক্তব্যে তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের মন্ত্রী এবং দলীয় লোকজন মামলা শেষ হওয়ার আগেই বিচার নিয়ে কথা বলছেন, মুখে মুখে রায় দিয়ে দিচ্ছেন। তারা বলছেন এই মামলায় আমার সাজা হয়ে যাবে এবং আমাকে কাশিমপুর কারাগারে রাখা হবে। এতে আমার আশঙ্কা হচ্ছে, আমি আদৌ এ মামলায় ন্যায়বিচার পাব না। আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য বেলা ১১টা ২৪ মিনিটে খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত হন। এ সময় তার আইনজীবীরা জিয়া অরফানেজ ও চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় স্থায়ী জামিনের আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তার স্থায়ী জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে। অন্তর্বর্তীকালীন জামিন বহাল রাখে। এরপর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের কার্যক্রম মুলতবি রাখার আরেকটি আবেদন করেন তার আইনজীবীরা। আদালত সেটিও নামঞ্জুর করে আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য দিতে নির্দেশ দেয়। খালেদা জিয়া দুপুর ১টার দিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের বক্তব্য দেয়া শুরু করেন। প্রায় বিশ মিনিট বক্তব্য দেয়ার পর তৃতীয় দিনেও নিজের পক্ষে বক্তব্য শেষ না করে খালেদা জিয়া ক্লান্তি ও অসুস্থতার কথা জানিয়ে পরবর্তী তারিখে বাকি বক্তব্য উপস্থাপনের অনুমতি চাইলে বিচারক মোঃ আখতারুজ্জামান তা মঞ্জুর করে ৯ নবেম্বর দিন রাখেন। খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলাও ওই দিন একই আদালতে শুনানির জন্য উঠবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া দুই কোটি ১০ লাখ টাকা আত্মসাতের এ মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থন করে নিজের বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন গত ১৯ অক্টোবর। সেদিন তিনি দাবি করেন, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে এতিমদের জন্য আসা একটি টাকাও তছরুপ বা অপচয় করা হয়নি, তা ব্যাংকে গচ্ছিত রয়েছে। এরপর ২৬ অক্টোবর আত্মপক্ষ সমর্থনের দ্বিতীয় দিনে তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে এ মামলা ‘ভুয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’। আর বৃহস্পতিবার আদালতে হাজির হয়ে খালেদা জিয়া স্থায়ী জামিনের আবেদন করলেও বিচারক তা নাকচ করে ৯ নবেম্বর পর্যন্ত জামিন মঞ্জুর করেন। এদিন আত্মপক্ষ সমর্থনের শুনানিতে ২০০৭ সালে জরুরী অবস্থার মধ্যে গ্রেফতার হওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন বলেন, তখন আমাদের দুই নেত্রীর বিরুদ্ধেই মামলা হয়েছিল। কিন্তু এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর কোন জাদুর কাঠির বলে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হয়েছে, অথবা আদালত থেকে খারিজ আদেশ দেয়া হয়েছে। আর আমার বিরুদ্ধে মামলা চলছে রকেটের গতির মতো। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি এখন ক্ষমতায় থাকলে কোন ‘জাদুর কাঠি’ ব্যবহার করতেন না। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মামলা প্রত্যাহার করাতেন না বা আদালতে ‘হস্তক্ষেপ’ করতেন না। স্বল্প সময় বক্তব্য দিয়ে কিছু সময় থেমে খালেদা জিয়া বলেন, আমার বক্তব্য কিন্তু শেষ হল না। আগামী তারিখে আমি আরও কথা বলব। এখন আমি ক্লান্ত ও অসুস্থ। খালেদা জিয়ার হাজিরা উপলক্ষে এদিন আদালতে উপস্থিত হন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন, সমিতির সম্পাদক ও বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, আইনজীবী সানাউল্লাহ মিয়া, মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার, জিয়া উদ্দিন জিয়া, এম হেলাল উদ্দিন প্রমুখ। দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। খালেদা জিয়ার আদালতে আগমনকে কেন্দ্র করে মৎস ভবন, কার্জন হল, পলাশীসহ বিভিন্ন স্থানে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয়। লিভ টু আপীলের শুনানি রবিবার পর্যন্ত মুলতবি ॥ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের ১১ সাক্ষীকে জেরা করার বিষয়ে খালেদা জিয়ার দায়ের করা লিভ টু আপীলের শুনানি শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার প্রথম দিনের শুনানি শেষে আগামী রবিবার পরবর্তী শুনানির দিন ঠিক করেছে আপীল বিভাগ। খালেদার করা আবেদনের ওপর বৃহস্পতিবার শুনানি গ্রহণ করেন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আব্দুল ওয়াহ্হাব মিঞার নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপীল বিভাগের বেঞ্চ। আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। দুদকের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। এর আগে বুধবার সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের চেম্বার জজ আদালত বিষয়টি শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার দিন নির্ধারণ করে আপীল বিভাগের (নিয়মিত) পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠান। গত ২২ অক্টোবর ১১ সাক্ষীকে জেরা চেয়ে বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার করা আবেদন পর্যবেক্ষণসহ নিষ্পত্তি করে দেয় হাইকোর্ট। আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে খালেদা জিয়া চাইলে এই মামলায় তার ছেলে তারেক রহমানের পক্ষে করা জেরা ব্যবহার করতে পারবেন বলে পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়। বিচারপতি মোঃ শওকত হোসেন ও বিচারপতি মোঃ নজরুল ইসলাম তালুকদারের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। পরে এই আদেশের বিরুদ্ধে লিভ টু আপীল করেন খালেদা জিয়া। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্টের নামে অবৈধভাবে তিন কোটি ১৫ লাখ ৪৩ হাজার টাকা লেনদেনের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়াসহ চার জনের বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ৮ আগস্ট তেজগাঁও থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১২ সালের ১৬ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক হারুন-অর-রশিদ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী (পলাতক), হারিছের তখনকার সহকারী একান্ত সচিব ও বিআইডব্লিউটিএর নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক জিয়াউল ইসলাম মুন্না এবং ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকার একান্ত সচিব মনিরুল ইসলাম খান। এ ছাড়া জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৪৩ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ এনে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০১০ সালের ৫ আগস্ট খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক হারুন আর রশীদ। ২০১৪ সালের ১৯ মার্চ খালেদা জিয়াসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে আদালত। মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান ছাড়া অন্য আসামিরা হলেন- মাগুরার সাবেক সংসদ সদস্য কাজী সালিমুল হক কামাল, ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান।
×