ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

যে শোকগাথা আজ শক্তির উৎস

প্রকাশিত: ০৩:৩৯, ৩ নভেম্বর ২০১৭

যে শোকগাথা আজ শক্তির উৎস

জন্মদাতা পিতাকে হারানোর বেদনা কতটা মর্মস্পর্শী, কতটা যন্ত্রণার তা কেবল সন্তানমাত্রই অনুভব করতে পারে। আমার বাবা শহীদ এম মনসুর আলীকে হারানো আমার কাছে এতটা কষ্টের, এতটা শোকের যে তা নিয়ে লিখতে গিয়ে বার বার কলম থেমে যায়। কী করে লিখি বাবাকে হারানোর সেই দুঃসহ স্মৃতি! পিতার এমন মর্মান্তিক হত্যাকান্ড কি কোন সন্তান লিখতে পারে! তবুও আজ নিজ হাতেই লিখছি পিতার বিয়োগান্তক ইতিহাস। ৩ নবেম্বর এলেই বুকটা ভারি হয়ে যায়। নিজেকে পাথরসম যন্ত্রণাকাতর মনে হয়, চারদিকটা কেমন যেন অসহায় লাগে। কারণ, পঁচাত্তরের ৩ নবেম্বর ভোররাতে জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামানের সঙ্গে আমার বাবা এম মনসুর আলীকে হারিয়েছিলাম। সেদিন কারা অভ্যন্তরে যেভাবে তাঁদের হত্যা করা হয়েছে, এমন পৈশাচিক হত্যাকা- বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কখনও ঘটেনি। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি মানুষ সেই পৈশাচিক ঘটনা সম্পর্কে অবগত রয়েছেন। বাবার সঙ্গে শেষ মুহূর্ত কাটানোর দুঃসহ স্মৃৃতি দিয়েই লেখাটি শুরু করতে চাই। আমার বাবা তখন প্রধানমন্ত্রী। সরকারী বাসভবনে আমরা সপরিবারে বাস করতাম। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার দুঃসংবাদটি যখন আমার বাবা পেয়েছিলেন তখন তিনি কিছু সময়ের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। আমি, মা, ভাই-বোন সবাই ভেঙ্গে পড়েছিলাম। বাকরুদ্ধ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক হতেই দেখলামÑ বাবা শিশুর মতো অঝোরে কাঁদছেন। তৎকালীন সেনাপ্রধান কে এম শফিউল্লাহ্সহ উর্ধতন কর্মকর্তাদের টেলিফোনে প্রতিরোধের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু কাপুরুষের দল কেউ এগিয়ে আসেনি। অসহায় মনসুর আলী সহকর্মীদের পরামর্শে আত্মগোপনে চলে গেলেন। কিন্তু আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ও দেখেছিÑ কী উ™ে^গ, প্রচ- বেদনা নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর কথা মনে করছেন, অন্যদিকে প্রতিশোধ এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে দলীয় সহকর্মী, তদানীন্তন সামরিকÑবেসামরিক কর্মকর্তাদের পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু সহকর্মীর ভীরুতা, আপোসকামিতা এবং জীবনরক্ষার প্রাণান্তকর চেষ্টা এবং অন্যদিকে সামরিকÑবেসামরিক নেতৃত্বের কাপুরুষতার কারণে মনসুর আলী সফল হতে পারেননি। আমি তখন বাকশালের পাবনা জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। আমাকে গ্রেফতার করতে পারলেই হত্যা করা হতো। আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ই আমার বাবা মনসুর আলী আমাকে আত্মগোপনে থাকার নির্দেশ দিলেন। মতিঝিল টিঅ্যান্ডটি কলোনির এক পরিচিত জনের বাসায় ১৬ আগস্ট গভীর রাতে তিনি আমাকে বিদায় জানালেন। বিদায় বেলায় তিনি বলেছিলেন, দুঃখী, মেহনতি মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে তিনি যে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন, তা থেকে যেন কখনও বিচ্যুত না হই। বাবার সেই উপদেশ আজও মেনে চলি। বিদায় বেলায় তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কেঁদেছেন। সেদিন দেশ ছাড়ার মুহূর্তটি পাথর চাপা কষ্টের মতো আজও বয়ে চলেছি। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, যেন আমার বাবাকে সুস্থ রাখেন, ভাল রাখেন। কিন্তু পরদিনই অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে তিনি গ্রেফতার হলেন। পরবর্তীতে ৩ নবেম্ব^র ভোররাতে জেলখানায় নির্মমভাবে বাবাসহ চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হলো। আমার জীবনের সেই ভয়ঙ্কর দুঃসংবাদটি আমি শুনতে পেলাম ৪ নবেম্ব^র। আমি তখন আত্মগোপনে ছিলাম। কিন্তু বাবাকে শেষবারের মতো দেখার সুযোগ থেকেও আমি বঞ্চিত হলাম। বাবাকে হারানোর সেই ক্ষত আজও বয়ে চলেছি। আমার বাবা শহীদ এম মনসুর আলী বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের ১৪টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই দায়িত্ব পালনকালে তিনি অসহায়Ñদরিদ্র মানুষকে যেভাবে সাহায্যÑসহযোগিতা করেছেন, তা মানুষ আজও ভুলে যায়নি। বাবার শোককে শক্তিতে পরিণত করে আমি দেশ ও জাতির কল্যাণে নির্বাচনে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিলাম। বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থেকে সিরাজগঞ্জের কাজীপুরের মানুষ আমাকে বারবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত করেছে। আমার সন্তানও ওই এলাকা থেকে একবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। সন্তান হিসেবে আমি গর্বিত এজন্য যে শহীদ এম মনসুর আলী আমার বাবা। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মহানায়ক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে চারজন জাতীয় নেতা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শহীদ এম মনসুর আলী অন্যতম। তিনি সর্বমুহূর্তে আমার আদর্শিক নেতা। যখনই আমি কোন কাজ করি, চিন্তা করি, আমার চিন্তাÑচেতনায় সব সময় আমার পিতার জন্য আবেগ অনুভব করি। তিনি যেমন জীবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন, মরণেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেই আছেন। আমার পিতা তার পরিবারের বাইরে প্রতিটি মুহূর্ত বঙ্গবন্ধুর কথা ভাবতেন, বঙ্গবন্ধুর কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধু ছাড়া যেন তার কোন অস্তিত্বই ছিল না। মাঝেমধ্যে মনে হতো আমাদের চেয়েও তিনি বঙ্গবন্ধুকে বেশি ভালবাসতেন। সন্তান হিসেবে দেখেছি ৬ দফার আন্দোলনে যখন অনেক সহকর্মী বঙ্গবন্ধুকে ত্যাগ করে চলে গেছেন, কারাবন্দী অবস্থা থেকেও আমার বাবা শত প্রলোভন ও চাপের মুখেও তখনকার পিডিএমপন্থী আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান, সালাম খানদের সঙ্গে যোগদান করেননি। দীর্ঘ কারাজীবন ভোগ করেছেন, কিন্তু নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানী করেননি। আমার বাবার দৃঢ় অভিব্যক্তি ও মনোভাব দেখেছি, ১৯৬৬Ñ৬৭ সালে যখন তিনি পাবনা কারাগারে বন্দী ছিলেন, আমিও বাবার সঙ্গে একই কারাগারে বন্দী ছিলাম। দীর্ঘ রাজনৈতিক লড়াইÑসংগ্রাম শেষে যখন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়, বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী তখন আমার বাবাসহ জাতীয় চার নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে মুজিবনগর সরকার গঠন করে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেন। দুঃসাহসিক ও গৌরবময় সেই মুহূর্তগুলো আমার প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ সেই দিনগুলোতে কী দৃঢ় সংকল্প নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ছিনিয়ে আনতে এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করতে অন্য তিন জাতীয় নেতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং কাজ করে গেছেন তা আমি দেখেছি। খন্দকার মোশতাকের মতো কয়েকজন সুযোগসন্ধানী ওই প্রবাসী মুজিবনগর সরকারের এই চারজন নেতার মধ্যে ফাটল ধরাবার চেষ্টা করেছেন। স্বাধীনতার প্রশ্নে আপোস করার নানা প্রলোভনের জাল বিস্তার করে মুজিবনগর সরকারের নেতৃত্বকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু একটি বিপদগ্রস্ত জাতির যুগসন্ধিক্ষণে শহীদ এম মনসুর আলী অন্য তিন নেতার সঙ্গে থেকে সব ভয়ভীতি, অনিশ্চয়তা এবং প্রলোভন উপেক্ষা করে মুক্তিযুদ্ধকে সফল করেছেন। সফেদ পায়জামাÑপাঞ্জাবি পরে আমার বাবা সেই ক’মাস মুজিবনগরের রণাঙ্গনে ছুটে বেরিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রবাসী সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে হাজার হাজার দলীয় সহকর্মী এবং দেশ থেকে পালিয়ে আসা মানুষকে আর্থিক সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। আমি প্রত্যক্ষ করেছি হাজারো অমানিশার মধ্যেও সাধারণ বাঙালীর চেয়ে দীর্ঘদেহী আমার পিতার উজ্জ্বল প্রত্যয়দীপ্ত মুখচ্ছবি। সহকর্মীদের উদ্দেশে তিনি সর্বদা বলতেন বাঙালীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী এবং জীবিত বঙ্গবন্ধুকে আমরা ইনশাল্লাহ মুক্ত করব। জাতীয় চার নেতার নেতৃত্বে মুজিবনগরে যে মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব সংগঠিত হয়েছিল তা নিয়ে একটি মহাকাব্য রচনা করা যেতে পারে। ১৫ আগস্ট হত্যাকা-ের পর আমার বাবা মনসুর আলীকে খন্দকার মোশতাক প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এম মনসুর আলী বলেছিলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। জীবন দেব, তবুও তোমার মতো বেইমানের সঙ্গে হাত মেলাব না। ৩ নবেম্বর কারা অভ্যন্তরে জীবন দেয়ার মধ্য দিয়ে তিনি তার কথা রেখেছেন। নেতা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বেইমানী করেননি। আমার শহীদ পিতার এই আদর্শ বুকে ধারণ করেই বঙ্গবন্ধুর কন্যা, আমার নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমৃত্যু কাজ করে যাব। ৩ নবেম্বর মৃত্যুঞ্জয়ী শহীদ পিতার প্রতি এটাই আমার প্রত্যয়দীপ্ত শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×