ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পালিয়ে আসা স্বজনদের আশ্রয় দেয়ায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা

সিডনি মেলবোর্নে ব্যবসা বাণিজ্যে এগিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৬:০২, ২ নভেম্বর ২০১৭

সিডনি মেলবোর্নে ব্যবসা বাণিজ্যে এগিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা

মোয়াজ্জেমুল হক, অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরে ॥ নাগরিকত্ব, দেশ, বসবাসের ভিটেমাটিহারা ওরা। বিশ্বের সবচেযে নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর তালিকায় ইতোমধ্যে এরা স্থান করে নিয়েছে। উন্নতসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশে দেশে বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে যাচ্ছে ওরা। বর্তমান মিয়ানমার সরকার ও সে দেশের উগ্রবাদী মগদের নির্মম হত্যাকা- ও নানামুখী বর্বরতার শিকার হয়ে ওরা কয়েক দশক ধরে কেবলই দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুলছে বিভিন্ন দেশে রিফিউজি হিসেবে। এ জাতিগোষ্ঠীর নাম রোহিঙ্গা। তাদের আঞ্চলিক ভাষায় ‘রোহাইঙ্গা’ নামেই পরিচিত। যেসব দেশে ওরা স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি লাভ করেছে সেদেশে এদের রয়েছে সাংগঠনিক তৎপরতা। গড়ে তোলা হয়েছে বিভিন্ন নামের সংগঠন। ওদের পক্ষ থেকে সবুজ সঙ্কেত নিয়েই নিজেদের গন্তব্য বেছে নিচ্ছে। গত ৯ থেকে ২৮ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ও মেলবোর্ন সফর করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নেতা ও সদস্যদের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে। সাবেক বর্মা ও বর্তমানে মিয়ানমার সরকারের জান্তা বাহিনীর সদস্যদের জ্বালাও-পোড়াও, হত্যা, ধর্ষণ ও দেশান্তরী হতে বাধ্য করার ঘটনা চলছে কয়েক দশক জুড়ে। ওদের হিং¯্র ছোবলে টিকতে না পেরে এসব রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্য দলে দলে বাংলাদেশমুখী হয়েছে বহু আগে থেকে। আর বাংলাদেশ থেকে অবৈধ সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করে ওদের একটি অংশ ইতোপূর্বে পৌঁছে গেছে বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে। ওরা সেখানে মিয়ানমারের রিফিউজি হিসেবে পরিচিতি ও স্থায়ী বসবাসের অনুমতি কার্ড লাভ করেছে। দীর্ঘ সময় জুড়ে থাকার কারণে ওরা সেসব দেশের আইনকানুন ও রীতিনীতি মেনে চলার সুবাদে অনেকেই বিত্তবানেও পরিণত হয়েছেন বটে। এসব বিত্তবান প্রতিনিয়ত মিয়ানমারে ও বাংলাদেশে আশ্রিত হয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য অর্থসহ বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে আছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনি ও মেলবোর্ন সফরকালে দেখা গেছে রোহিঙ্গাদের অবস্থান। ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরি ছাড়াও বিভিন্নভাবে এরা এদের জীবন ধারণ প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠনের নেতা রাহমাতউল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। তিনি সিডনির লেকাম্বায় একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া সাংবাদিক হিসেবে পরিচয় পেয়ে তিনি দ্রুত মোবাইল ফোনে আরও কিছু রোহিঙ্গাকে জড়ো করেন। রোহিঙ্গারা সাংবাদিকদের ‘খবরগ্যা’ বলেই আখ্যায়িত করেন। রাহমাতউল্লাহসহ অন্যান্য রোহিঙ্গা সদস্যের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের নিত্যদিনের ঘটনাবলীর খবরাখবর রাখেন। মোবাইল ফোনে রাখাইনের রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইতোমধ্যে আশ্রিত রোহিঙ্গার সঙ্গে নিত্য যোগাযোগ রয়েছে। ওরা সকলেই স্বাধীন আরাকানের স্বপ্ন দেখেন। আশা করেন, কোন না কোনদিন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সদস্যদের এ রকম পরিস্থিতির অবসান ঘটবে। অনেক রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেছে, বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে ওরা সুযোগ পেলেও মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী নয়। গত ২৫ আগস্টের রাতে মিয়ানমার জান্তা বাহিনীর গণহত্যা শুরু হওয়ার পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসার যে ঢল রোহিঙ্গাদের মাঝে নেমেছে এবং অসহায় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ যে উদারতার পরিচয় দিয়েছে তা তাদের কাছে ছিল অচিন্ত্যনীয়। যে কারণে তাদের মুখে মুখে বাংলদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম গুঞ্জরিত হচ্ছে। অনেকের সঙ্গে আলাপ করে ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুযোগ দেয়া হলেও রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। এদের মধ্যে এমন কোন একজনকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি যারা স্বজন হারায়নি। আর যারা এখনও বেঁচে আছে তাদেরকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে বসবাসের জন্য বাসা ভাড়া করে রাখা হয়েছে। জীবনযাপনের জন্য বিভিন্ন পথে বিদেশ থেকে রোহিঙ্গারা অর্থ প্রেরণ করছে। এদিকে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যানে যা উঠে এসেছে তাতে দেখা যায়, রাখাইন অঞ্চল থেকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। এর আগে এসেছে আরও ৫ লাখ। আরও আগে বছরের পর বছর পরিবার নিয়ে চলে এসেছে অনেকে। বাংলাদেশে আসার পর এদের অনেকেই এদেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশান্তরি হয়েছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে সর্বোচ্চসংখ্যক রোহিঙ্গা আশ্রয় লাভ করেছে বাংলাদেশে, যার সংখ্যা ১০ লক্ষাধিক। এছাড়া বর্তমানে সৌদি আরবে আড়াই লাখ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১২ হাজার, পাকিস্তানে সাড়ে ৩ লাখ, ভারতে ৪০ হাজার, জাপানে প্রায় ১৮ হাজার, এদের মধ্যে ২০১৬ সালে প্রায় ১১ হাজার রোহিঙ্গা রিফিউজির মর্যাদা পেতে জাপান সরকারের কাছে আবেদন করেছে। এছাড়াও বর্তমানে মালয়েশিয়ায় দেড় লক্ষাধিক, থাইল্যান্ডে ৫ হাজার, ইন্দোনেশিয়ায় ১ হাজার আর অস্ট্রেলিয়ায় রয়েছে ৮ সহ¯্রাধিক। শুধু এসব দেশ নয়, যুক্তরাষ্ট্রসহ আরও কিছু দেশে রোহিঙ্গারা ইতোমধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেছে। এদের অনেকেই রিফিউজির মর্যাদা পায়নি। অবৈধভাবে তারা সেখানে রয়ে গেছে। তবে বিশ্বের দেশে দেশে কত রোহিঙ্গা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান রোহিঙ্গা সংগঠনগুলোর কাছেও নেই। সিডনি ও মেলবোর্নে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মিয়ানমারের জান্তা সরকার রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের সমূলে উৎখাতের নীলনক্সা করেই অভিযান চালিয়েছে দফায় দফায়। এখন মিয়ানমার সরকার বাংলাদেশের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে ফিরিয়ে নেয়ার যে প্রাথমিক প্রস্তাব করেছে তা আদৌ কতটুকু সফলতা বয়ে আনবে তা নিয়ে তারা সন্দিহান। বিশ্ব চাপের মুখে বর্তমানে সুচি সরকার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার যে কথা বলছে তা বাস্তবে রূপ আদৌ নেবে কিনা এবং যদি শুরুও হয় তা নিয়ে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। ফলে রোহিঙ্গাদের মাঝে নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ তেমন একটা নেই বললেই চলে। আর এ কারণেই বহু আগে থেকেই রোহিঙ্গারা দুঃসাহসিক কায়দায় উত্তাল সাগরপথ পাড়ি দেয়াসহ বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দেশান্তরি হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় রোহিঙ্গাদের ‘বোট পিপল’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। কেননা, এদের অধিকাংশ ইন্দোনেশিয়া হয়ে মহাসাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া উপকূলে পৌঁছার পর সেখানকার কোস্টগার্ড সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে। পরে সে দেশের সরকারের নির্দেশে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে। যদিও গত ২৫ আগস্ট রাখাইন রাজ্যের ঘটনার পর ওপথে রোহিঙ্গারা যেতে পারেনি। কেননা, অস্ট্রেলীয় সরকার এ দফায় সে দেশের কোস্টগার্ড বাহিনীর সদস্যদের সর্বক্ষণিক সজাগ রেখেছে। এর পরও এরা দুর্গম বিভিন্ন পথ পাড়ি দিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে পৌঁছে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা নেতা রাহমাতউল্লাহ জনকণ্ঠকে আরও জানিয়েছেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জন্য যে সেফ জোন সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে তা তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য। তবে সর্বাগ্রে রয়েছে তাদের নাগরিকত্বের অধিকার। বর্তমানে মিয়ানমার সরকার সে দেশে রোহিঙ্গাদের জন্য যে এনভিসি (ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড) দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। তাতে তারা সন্তুষ্ট নয়। কেননা, এ জাতীয় কার্ডে তাদের নাগরিকত্বের অধিকার নেই। উল্টো এতে তাদের বাংলাদেশী হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে, যা তাদের কাছে কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে রোহিঙ্গাদের পক্ষে এবং মিয়ানমার সরকারের বর্বরতার বিরুদ্ধে যে আওয়াজ উঠেছে তাতেও মিয়ানমার সরকার দুর্দমনীয় অবস্থানে রয়েছে। অর্থাৎ, বর্তমান মিয়ানমার সরকারের চিন্তাভাবনা অতীত সরকারের প্রণীত নীলনক্সা পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করা। ফলে পালিয়ে আসা ও বিভিন্ন দেশে আশ্রয় গ্রহণকারী রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছা পোষণ করছে না। এছাড়াও মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর সদস্য ছাড়াও উগ্র মগরা কথায় কথায় রোহিঙ্গাদের ওপর হামলে পড়ে। অতীতের দুঃসহ যন্ত্রণার কথা ও বীভৎস চিত্র অনেকের মাঝে সদা জাগ্রত। তাই ওরা দলে দলে বাংলাদেশমুখী হয়েছে এবং আগামীতে কোন না কোনদিন কোন না কোন দেশ রোহিঙ্গাদের রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় দেয়ার বড় ধরনের আশা তাদের ভেতরে প্রোথিত হয়ে আছে। যারা দেশান্তরি হয়েছে তাদের যে আর ফিরে আসতে হবে না তা তারা নিশ্চিত। আর এ কারণে বর্তমানে যারা রাখাইন রাজ্য ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তাদের পুনরায় রাখাইন রাজ্যে ফিরে যেতে বারণ করেই চলেছে। তাদের মাঝে সবচেয়ে বড় শঙ্কা হচ্ছে মিয়ানমার বাহিনী ও উগ্র মগরা আবারও বর্বর কায়দায় যে কোন সময় তাদের ওপর হামলে পড়তে পারে এবং রাখাইনকে রোহিঙ্গামুক্ত করেই ছাড়বে। এরপরও তারা আশাবাদী যে, এ সমস্যার সমাধান কোন না কোনদিন হবে, হতে হবেই।
×