ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রদীপ মালাকার

রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের, বাংলাদেশ কেন প্রতিপক্ষ

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ১ নভেম্বর ২০১৭

রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের, বাংলাদেশ কেন প্রতিপক্ষ

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে কথিত সন্ত্রাস দমনের নামে সেদেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা, গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, নারীদের ধর্ষণ করে। সর্বশেষ মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এতে দেখা দেয় মানবিক বিপর্যয়। চলমান সেনা অভিযানে জাতিসংঘসহ সারা বিশ্বের প্রতিবাদ, ব্যাপক সমালোচনার মুখে এ সমস্যার সমাধানে আগ্রহ দেখিয়েছেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলার আউং সান সুচি। তিনি যাচাই-বাছাই সাপেক্ষে ফেরত নিতে সম্মতি জানিয়েছেন রোহিঙ্গাদের। সম্প্রতি এক সাক্ষাতকারে তিনি জানান, ১৯৯২ সালের বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যকার চুক্তি অনুযায়ী যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার কথা। ইতোপূর্বে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান ও অন্যান্য কর্মকর্তাও দাবি করেন, যাদের নাগরিকত্বের কাগজ আছে তাদেরই যাচাই-বাছাই করে ফেরত নেয়া হবে। মিয়ানমারে ৫ কোটির অধিক জনসংখ্যার ৫% রোহিঙ্গা মুসলমান, ৫% রোহিঙ্গা হিন্দু ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠী এবং বাকি ৯০% বৌদ্ধ মগ। আউং সান সুচিসহ মিয়ানমারের শাসকরা রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করেনি। তারা যে অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর মতো একটি জাতি তা মিয়ানমার সরকার স্বীকার করে না। রোহিঙ্গারা বাঙালী মুসলমান, তারা বহিরাগত ও সন্ত্রাসী এবং ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় থেকে সে দেশে অবৈধভাবে বসবাস শুরু করেছে। কাজেই বর্মীদের জন্য বার্মা। এতে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, উগ্র জাতীয়তাবাদের নাম করে তিনি (সুচি) রোহিঙ্গা নিধন ও বহিষ্কারের এক জঘন্য খেলায় মত্ত হয়েছেন। ২৫ আগস্টের পর থেকে উন্মাদপ্রায়, বর্বর ও সাম্প্রদায়িক মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর নিষ্ঠুর অত্যাচারে বাধ্য হয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। মনে পড়ে, ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে টিক্কা খানের নৃশংস গণহত্যা ও অত্যাচারে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে এক কোটি বাঙালী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। নয় মাসের যুদ্ধের এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক চাপে কূটকৌশলী ইয়াহিয়া শুধু ৩০ লাখ (যার সকলেই মুসলমান) শরণার্থী ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছিল। এখানেও শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিতে শুভঙ্করের ফাঁকি ১৯৯২ চুক্তিকেই সমর্থন করেছে। এতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর মধ্য থেকে যাদের কাগজপত্র আছে বা নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে পারবে তারাই ফিরে যেতে পারবে, বাদবাকি অন্যরা নয় । পশ্চিম মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী মূলত রোহিঙ্গারা। জানা যায়, কুরুখ নামে অস্ত্রিক জাতির একটি শাখা পূর্ব ভারত থেকে খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ বছর আগে রাখাইন রাজ্যে বসতি স্থাপন করে। এরপর ক্রমান্বয়ে বঙ্গোপসাগরের উপকূলে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছে। মধ্যযুগে স্বাধীন রাখাইনকে রোসাং বা রোসাঙ্গ বলা হতো। রোসাং থেকেই সম্ভবত রোহাঙ্গা বা রোহিঙ্গার উৎপত্তি। তখন মুসলমানগণ এই রাজ্য শাসন করতেন। ফলে রাজভাষা ছিল ফার্সী। তবে বাংলা সাহিত্য চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজদরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারে রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য ‘পদ্মাবতী’। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুলমূল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে ও পৃষ্ঠপোষকতায়। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর উদ্ভব হয়। প্রাথমিকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমান ও স্থানীয় আরাকানীদের সংমিশ্রণে রোহিঙ্গা জাতির উদ্ভব হয়। পরবর্তীতে বাঙালী, পার্র্সি, তুর্কী, মুঘল, আরব ও পাঠান, মধ্য এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার মানুষের মিশ্রণে এই জাতি ত্রয়োদশ–চতুর্দশ শতাব্দীতে একটি পূর্ণাঙ্গ জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মিয়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, মংডু, কিওকতাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিলা, কাইউকপাইড, পুন্যাগুন ও পাউকতাই এলাকায় এদের অবস্থান। আরাকান রাজ্যের ভাষার নামও রোহিঙ্গা। আরাকানে রোহিঙ্গাদের বসবাসের ঐতিহাসিক পটভূমি রয়েছে। ইতিহাস বলছে, রোহিঙ্গারা আরাকানের ভূমিপুত্র। ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের আরাকান স্বাধীন রাজ্য ছিল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মিয়ানমারের (বার্মা) দক্ষিণে বাস করত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ‘মগরা’ এবং উত্তরে ইসলাম ও হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী ‘রোহিঙ্গা’ সম্প্রদায়। তবে আরাকান রাজ্যের মালভূমিতে ‘রাখাইন’ ও সমতলে ‘রোহিঙ্গ’ জাতি গোষ্ঠীর লোকেরা বসবাস করত। মগরা ছিল মূলত মঙ্গোলীয় এবং তাদের একটি অংশ ছিল জলদস্যু। ‘রোহিঙ্গাদের উৎস ও বিকাশ’ শীর্ষক এক গবেষণায় অধ্যাপক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘রাজা ভোধাপোয়া আরাকান দখল করে বার্মার সঙ্গে যুক্ত করার আগে ১৪০৪ থেকে ১৬২২ সাল পর্যন্ত ১৬ জন মুসলিম রাজা আরাকান শাসন করেন। আর এতেই বোঝা যায় রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এ রাজ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। রাজা ভোধাপোয়া ১৭৮৪ সালে এ রাজ্য দখলের পর বৌদ্ধ ধর্মের আধিপত্য বিস্তার লাভ করে। তারপর বর্মীদের সঙ্গে তিনটি যুদ্ধের (১৮২৫ , ১৮৫২ ও ১৮৮৫) পর ১৮৮৬ সালে ইংরেজরা বার্মায় কলোনি স্থাপন করে। পরবর্তীতে ইংরেজরা বার্মাকে ভারতের অংশ হিসেবে শাসন করে ১৯১৯ সাল থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত। ওই বছর থেকে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা অর্জন পর্যন্ত বার্মা ছিল ব্রিটেনের ক্রাউন কলোনি। বিদায়ের আগে ইংরেজরা বার্মার ১৩৯টি জাতি গোষ্ঠীর তালিকা তৈরি করে। রোহিঙ্গাদের নাম সেখানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। আর এখানেই অশান্তির বীজ বপন করা হয়েছে। বার্মায় অশান্তি ও অস্থিতিশীলতার যে বীজ ব্রিটিশরা বপন করে গিয়েছিল কালান্তরে তাই এক আন্তর্জাতিক মানবিক সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী বার্মায় বসবাস করার পরও রোহিঙ্গারা আজ নিজ দেশেই পরবাসী বলে দাবি করা হয়। বার্মার প্রথম পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর সবকিছু পাল্টে যায়। রাতারাতি রোহিঙ্গারা হয়ে যায় বিদেশী। তখন থেকেই শুরু হয় তাদের বিরুদ্ধে অত্যাচার, অবিচার ও লাঞ্ছনা। তাদের নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। পরবর্তীতে সামরিক শাসকগণও রোহিঙ্গাদের জাতিসত্তা ও নাগরিক অধিকার ধারাবাহিকভাবে অস্বীকার করে। তারই ফলশ্রুতিতে ৮০’র দশকে নির্যাতিত, বঞ্চিত, ক্ষুব্ধ ও রাষ্ট্রবিহীন রোহিঙ্গাদের একটি অংশ সশস্ত্র আন্দোলনে নামে। তারা ‘আরকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি’ সংক্ষেপে (আরসা) নামে সংগঠন গঠন করে মিয়ানমার শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। আর মিয়ানমারের সামরিক শাসকগণ সেই সুযোগ নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানোর লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে প্রচারণা চালায় যে, তারা রোহিঙ্গা নয়, তারা বিদেশী, বাঙালী ও সন্ত্রাসী। কক্সবাজারের উখিয়াসহ বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা সাংবাদিকদের বলেছেন, আমরা বাঙালী নই, বার্মাইয়া। আমাদের দেশ বার্মা। সেখানে বাপ-দাদার ভিটে আছে, কবর আছে। আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু কে তাদের দায়ভার গ্রহণ করবে? চীন, ভারত, রাশিয়া, জাপানসহ ক্ষমতাধর দেশগুলো তো প্রকারান্তরে মিয়ানমার সরকারকেই সমর্থন করেছে। ক্ষমতাধর এই দেশগুলো তাদের স্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য দিয়েছে। ফলে মিয়ানমারে এসব দেশের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের কাছে মারা গেছে বিশ্ব মানবতা। দেশান্তরে যাওয়ার প্রবণতা দীর্ঘদিনের। ইউরোপের ইমিগ্রানটরা গড়ে তুলেছেন আধুনিক আমেরিকা। বিভিন্ন সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানসহ অনেক দেশে। মুঘলদের বংশধর তো ভারতেই অবস্থান করছেন। তাদের কাউকেই এখন আর তাদের পূর্ব পুরুষদের দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না। তাই মিয়ানমারকে বুঝতে হবে যে, শত শত বছর বার্মায় বসবাস করার পর বর্তমান প্রজন্মের রোহিঙ্গারা কোনভাবেই বাঙালী নয়, তারা বর্মী। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসেও আমরা দেখি, সেই ব্রিটিশ আমলে কিছু লোক বার্মার কয়েকটি শহরে গিয়ে চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্য করেছে; কিন্তু ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার পর সেই আকর্ষণ আর অবশিষ্ট ছিল না। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙালীরা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে উগ্র বর্মীরা যে প্রচারণা চালাচ্ছে তাও সত্য নয়। রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের। এখানে বাংলাদেশ কোন প্রতিপক্ষ নয়। কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যা, অত্যাচার, নির্যাতন থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে যখন বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তখন তো বাংলাদেশের ওপর অযাচিতভাবে দায়িত্ব এসেই পড়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘসহ আজ বিশ্ব বিবেক রোহিঙ্গাদের পক্ষে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে সাময়িক আশ্রয় দিয়েছে; কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট এই সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। তবে সুচির রূপরেখায় তা অসম্ভব। কারণ, তিনি ১৯৯২ সালের স্বাক্ষরিত বাংলাদেশ-মিয়ানমার চুক্তিকেই ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু অধিকাংশ শরণার্থীর কোন কাগজপত্রই নেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘের অধিবেশনে সমস্যার আশু ও দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের লক্ষ্যে সেফ জোনসহ (সেফ জোন হলো রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিজ রাজ্যে ফিরিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরাপত্তা দেয়া) পাঁচ দফা দাবি জানান, যা বিশ্বের সকল বিবেকবান মানুষের প্রশংসা কুড়িয়েছে। তাছাড়া সুচির নির্দেশে বহুদিন ধরে চলমান সংঘর্ষ-সহিংসতার সঙ্কট সমাধানে ২০১৬ সালে আগস্টে গঠিত হয় এ্যাডভাইজরি কমিশন অন রাখাইন স্টেট। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন সুচি সরকার বরাবরে তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেয়। তদন্ত রিপোর্ট সকল শ্রেণী, গোষ্ঠী, জাতি, ধর্মের অধিকার, নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা বলায় সকল মহলেরই প্রশংসা কুড়িয়েছে। সমস্যা সৃষ্টি করেছে মিয়ানমার, এর সমাধানও তাদেরই করতে হবে। বাস্তবতার নিরিখে মানবাধিকার ও নাগরিকত্ব প্রদানের গ্যারান্টি দিয়ে তার সরকারকেই ফেরত নিতে হবে এই জনগোষ্ঠীকে। সারা বিশ্বের নজর এখন সুচির দিকে। দেখা যাক শান্তিতে নোবেল পাওয়া আউং সান সুচি কি করেন? লেখক : আমেরিকা প্রবাসী
×