ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পাচারকারী চক্রের দুজন গ্রেফতার

লিবিয়ায় জিম্মিদশা থেকেফেরা যুবক এরশাদ এখন পঙ্গুপ্রায়

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ১ নভেম্বর ২০১৭

লিবিয়ায় জিম্মিদশা থেকেফেরা যুবক এরশাদ এখন পঙ্গুপ্রায়

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সংসারে সুদিন ফিরিয়ে আনার আশায় দালালের মাধ্যমে লিবিয়ায় যাই। ভেবেছিলাম সেখানে ভাল থাকতে পারব। পিতা-মাতার কষ্ট দূর হবে। কিন্তু সে ভাগ্য আর হলো না। উপরন্তু পঙ্গু হয়ে সারাজীবন সংসারের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকার অবস্থা হয়েছে। কথাগুলো আর শেষ করতে পারছিলেন না এএম এরশাদ মিয়া। কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল। একপর্যায়ে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন। তার সঙ্গে একই পরিস্থিতির কথা বলতে বলতে কাঁদছিলেন লিবিয়ায় জিম্মিদশা থেকে দেশে ফেরা আরেক যুবক এরশাদ খোন্দকার। র‌্যাব এ দুই যুবকের সঙ্গে আরেকজনকে লিবিয়া থেকে সেখানে থাকা বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। আর পাচারকারী চক্রের এক হোতাসহ দুজনকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। অন্যদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে। মঙ্গলবার কাওরানবাজারের র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া বিভাগে এক আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনে লিবিয়ায় জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার পাওয়া এএম এরশাদ মিয়া নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, তারা তিন ভাই। বাড়ি গোপালগঞ্জে। এসএসসি পাস করার পর ভর্তি হই পুরান ঢাকার সরকারী কবি নজরুল কলেজে। এইচএসসি পরীক্ষায় ফেল করি। ২০১০ সালে মালয়েশিয়ার সারওয়াক শহরের ইন্টি কলেজ থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্টে অনার্স শেষ করি। ২০১৫ সালে দেশে আসি। এরপর ইউরোপের কোন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। এ সময় পরিচয় হয় স্থানীয় দালাল মোশারফ হোসেনের সঙ্গে। আট লাখ টাকায় তাকে বৈধভাবে গ্রীসে ভাল চাকরির প্রলোভন দেখায়। ঢাকার রেজওয়ান ওভারসিস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা চারজন গ্রীসে যাওয়ার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। চলতি বছরের ২৩ এপ্রিল গ্রীসের উদ্দেশে তাদের ঢাকা থেকে তুরস্কের ইস্তানবুল যাওয়ার বিমান টিকেট করে পাঠিয়ে দেয়। ইস্তানবুল যাওয়ার পর তাদের ই-মেইলের মাধ্যমে পরবর্তী গন্তব্যের টিকেট দেয়া হবে জানানো হয়। ইস্তানবুুল বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর তাদের সঙ্গে দালালরা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। দুদিন ইস্তানবুলে অবস্থানের পর তার ও তার সঙ্গে যাওয়া এরশাদ খোন্দকারের হাতে লিবিয়া যাওয়ার বিমান টিকেট দেয়া হয়। তারা লিবিয়ার রাজধানীর ত্রিপলীর মেতিকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর ঘটতে থাকে লোমহর্ষক সব ঘটনা। আচমকা দুটি গ্রুপ দুটি করে চারটি গাড়ি নিয়ে বিমানবন্দরে অস্ত্রসহ হাজির হয়। দুটি গ্রুপ তাদের দুজনকে নিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করে। দুই গ্রুপই আমরা তাদের লোক বলে দাবি করে। এ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি শুরু হয়। মাঝখানে পড়ে আমরা গুলিবিদ্ধ হই। আমার পেট, হাত, পিঠসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলি লাগে। আমাকে শার্টের কলার ধরে গাড়িতে তোলা হয়। এরপর আর আমার কিছুই মনে নেই। পরবর্তীতে দেখি আমি হাসপাতালে। আমার চার দিন পর জ্ঞান ফিরেছে বলে চিকিৎসকরা জানান। অপরজনের অবস্থাও একই রকম। হাসপাতালে আমাদের ছবি তোলে জিম্মিকারীরা। তারা আমাদের ছবি বাড়ির লোকজনের কাছে পাঠিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। তিন দফায় আমার পরিবারের কাছ থেকে জিম্মিকারীরা টাকা আদায় করে। আমি তাদের হাত-পায়ে ধরি আমাকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য। একপর্যায়ে বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে জিম্মিকারীরা পালিয়ে যায়। পরে আমাকে লিবিয়ার মেতিকার আবু সেলিম মুসলিম হাসপাতালে ভর্তি করে আর এরশাদ খোন্দকারকে মেতিকা হাসপাতাল ত্রিপলীতে ভর্তি করে। প্রায় চার মাস পর গত ২ আগস্ট লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস ও ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের (আইওএম) সহায়তায় এবং র‌্যাবের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র ধরে দেশে ফিরতে সক্ষম হই। দেশে ফেরার পর আবার হাসপাতালে ভর্তি হই।
×