ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মোদির লড়াকু মানসিকতা এখন আত্মরক্ষামূলক হচ্ছে

প্রকাশিত: ১৯:৪৪, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

মোদির লড়াকু মানসিকতা এখন আত্মরক্ষামূলক হচ্ছে

অনলাইন ডেস্ক ॥ ২০১৪ সালে জনগণের ঐতিহাসিক রায়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। এই জয়ের অন্যতম একটি কারণ হলো, মোদির লড়াকু মানসিকতা ও আশাবাদী বক্তৃতা। তবে তিন বছরের মধ্যেই নরেন্দ্র মোদির সুর অস্বাভাবিক রকমের আত্মরক্ষামূলক হতে শুরু করেছে। অনেকেই বলেছেন, মোদির চরিত্রগত দম্ভ ও বাগাড়ম্বর ম্লান হতে শুরু করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি তাঁর সমালোচকদের হতাশাবাদী বলে সমালোচনা করেন। তিনি ভারতের অর্থনৈতিক মন্দার জন্য সাবেক কংগ্রেস সরকারের সমালোচনা করেন। নিজেকে ‘বহিরাগত’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের মঙ্গলের জন্য তিনি ‘বিষপান’ করতেও রাজি। সম্প্রতি এক সমাবেশে মোদি বলেন, ‘অল্পসংখ্যক লোক আমাদের দুর্বল করছে। এই লোকদের শনাক্ত করা প্রয়োজন।’ তিন বছর আগে মোদি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তিনি কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দেন। তবে তাঁর নেতৃত্বকালীন বিশ্ব অর্থনীতি এগিয়ে গেলেও তাঁর প্রভাব ভারতীয় অর্থনীতিতে পড়েনি। ভারত এ সময় অর্থনৈতিক মন্দা ও কর্মসংস্থান-সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। পাহাড়সমান খারাপ ঋণের বিরুদ্ধে লড়াই করছে ব্যাংকগুলো, যা আমানত-সংকটের সৃষ্টি করছে এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অর্থনীতিবিদ প্রবীণ চক্রবর্তী বলেন, ‘ভারতের অর্থনীতি মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।’ ভারতের অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়ে মোদির প্রতিক্রিয়াকে উদ্ভট ও খাপছাড়া বলে সমালোচনা করা হয়। গত নভেম্বরে নোট বাতিলের বিতর্কিত সিদ্ধান্তকে রাজনৈতিকভাবে অবৈধ অর্থের বিরুদ্ধে অভিযান বলে চালানো হয়। তবে এর প্রতিক্রিয়ায় প্রবৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ব্যাপক দুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। আর ব্যাপক প্রশংসিত অভিন্ন পণ্য ও সেবা কর (জিএসটি) যেভাবে আরোপ করা হয়, সেটিও সমালোচিত হয়। একটি সাধারণ বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গত জুলাইয়ে দেশব্যাপী পণ্য ও সেবা কর আরোপ করা হয়। এতে করে ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হয়। অত্যন্ত বাজেভাবে ওই কর আরোপের ফলে এ অবস্থার সৃষ্টি হয় বলে মনে করা হচ্ছে। এই কর আরোপের পর শহর ও নগরের ব্যবসায়ীরা হতাশ হয়ে পড়েন। গ্রামগুলোয় যেখানে ভারতে অর্ধেক লোক কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত, তাঁরা তাঁদের আয়ের বিষয়ে অনিশ্চয়তার অভিযোগ করে আসছেন। তাঁদের ধারণা, উৎপাদনের বিপরীতে সরকার ন্যায্য মূল্য দিচ্ছে না। সম্প্রতি মোদির দল বিজেপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা অর্থনৈতিক মন্দার জন্য সরকারকে দোষারোপ করেন। বিজেপির নেতা সাবেক অর্থমন্ত্রী যশোবন্ত সিং বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দাবি করেছেন, তিনি খুব কাছ থেকে দারিদ্র্য দেখেছেন। আর ভারতে সব জনগণই যাতে একইভাবে কাছ থেকে দারিদ্র্য দেখতে পান, সেটা নিশ্চিত করতে দিনমান কাজ করে যাচ্ছেন তাঁর অর্থমন্ত্রী।’ একইভাবে মোদি বিরোধী দলের দ্বারাও সমালোচিত হচ্ছেন ব্যাপকভাবে। তাঁর প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী একসময়ের প্রতাপশালী কংগ্রেস দলের রাহুল গান্ধী হঠাৎ শক্তি সঞ্চয় করে মোদির বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে শুরু করেছেন। এর আগে রাহুল গান্ধী মোদির এতটা কঠোর সমালোচনা করেননি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে মোদির ঘনিষ্ঠ সহযোগী অমিত শাহের ছেলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ। অমিত শাহ দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকার করেন এবং এ-সংক্রান্ত খবর প্রকাশ করা অলাভজনক সংবাদ ওয়েবসাইট দ্য ওয়ারকে মামলার হুমকি দেন। তবে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে এ পর্যন্ত মোদি চারটি বিষয়ে সুবিধা পেয়েছেন। ভারত অপরিশোধিত তেলের বড় অংশই আমদানি করে থাকে। বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য কম থাকায় তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মোদি সরকারকে সহায়তা করেছে। দ্বিতীয়ত, সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভরশীল অভ্যন্তরীণ প্রধান গণমাধ্যমগুলোর বেশির ভাগই তাঁর সরকারের সমালোচনা থেকে বিরত থেকেছে। তৃতীয়ত, দলের ভেতর থেকে মোদি কোনো নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হননি। শেষ ও গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা থাকায় তারা জনগণকে বিকল্প আশা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। সংবাদবিষয়ক সাইট দ্য প্রিন্টের সম্পাদক শেখর গুপ্ত বলেন, এখনো এখানে ‘বাতাসে অনেক কিছুই ভাসছে’। তিনি মূলত ইঙ্গিত করেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে। সেখানে প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে নানা ধরনের হাস্যরস চলছে। মোদির রাজনীতি অসন্তোষের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হিন্দু মৌলবাদকে উসকে দেওয়া এবং গোমাংস খাওয়া ও বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে অনেক সমালোচনা রয়েছে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, এ বিষয়কে ঘিরে অনেক তরুণ ও শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। আর এই অসন্তোষকে ভয় পেতে শুরু করেছে বিজেপি। মুসলিমবিদ্বেষী হিসেবে পরিচিত বিতর্কিত হিন্দুধর্মীয় নেতাকে উত্তর প্রদেশে মনোনয়ন দেওয়ার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে। গত মার্চে বিজেপি উত্তর প্রদেশে জয়লাভ করে। ২০ কোটি জনসংখ্যার ওই রাজ্যের এক-পঞ্চমাংশ মুসলিম। ২০১৪ সালে তরুণদের ভোটে মোদি অভাবনীয় জয় পান। কিন্তু বর্তমানে তরুণদের সমর্থন কি কমতে শুরু করেছে? দিল্লি ও হায়দরাবাদের বেশির ভাগ প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়েই বিজেপি-সমর্থিত ছাত্রসংগঠনগুলো পরাজিত হয়েছে। গত মাসে মোদির নির্বাচনী এলাকা উত্তর প্রদেশের বারানসির শীর্ষস্থানীয় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী যৌন হয়রানির প্রতিবাদে বিক্ষোভ করলে পুলিশ তাঁকে পেটায়। এ নিয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে উত্তেজনার সৃষ্ট হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও মোদি মৌলিক কোনো সংস্কারক নন। গত জুনে দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, মোদির নিজস্ব বড় ভাবনা খুব কমই আছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, অভিন্ন পণ্য ও সেবা কর আরোপের পদক্ষেপ আগের কংগ্রেসের আমলেই নেওয়া হয়েছিল। সমালোচকেরা বলছেন, সাম্প্রতিক ইতিহাসে ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার নিয়ে শ্রম আইন সংশোধন এবং ভূমি ও বিদ্যুতের কার্যকর বাজার সৃষ্টিতে মোদির কিছুটা অর্জন রয়েছে। মোদির রাজনীতির বিষয়ে সমালোচকেরা বলছেন, ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) আদর্শের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে বিজেপির আদর্শ। ড. প্রবীণ চক্রবর্তীর মতো অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করেন, উজ্জীবিত শেয়ারবাজারকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের সুযোগ মোদির হাতে এখনো রয়েছে। দেশটির শেয়ারবাজারে বিদেশি অনেক প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী রয়েছে। রাষ্ট্রীয় কোম্পানির শেয়ার বিক্রি করে সরকার তহবিল বাড়াতে পারে এবং দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর অনিয়ম দূর করে পুনরায় মূলধনের জোগান দিতে পারে; যাতে ব্যাংকগুলো পুনরায় ঋণ দিতে পারে। এ ছাড়া সরকার রুপির মূল্য কমিয়ে রপ্তানি বাড়াতে পারে। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি বাড়াতে এবং ক্ষুদ্র ব্যবসাকে সহায়তা দিতে সুদের হার হ্রাস এবং পণ্য ও সেবা করের সরলীকরণ করতে পারে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও নির্ভরশীল। তবে মাথাচাড়া দেওয়া মৌলবাদকে মোদি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন কি না, তা পরিষ্কার নয়। যদিও মোদি একজন লড়াকু যোদ্ধা। কাজেই স্রোত তাঁর বিরুদ্ধে যাবে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি। গত আগস্টে এক মতামত জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচন হলে তিনি সহজেই জয় পাবেন। তবে রাজনীতির ক্ষেত্রে এক মাসও দীর্ঘ সময়। বিজেপি-শাসিত গুজরাট রাজ্যের আগামী ডিসেম্বরের নির্বাচন একটা বড় নিয়ামক। কেউ বলছে না যে বিজেপি তাতে হারবে। তবে জয়ের ব্যবধান নিয়ে সবারই আগ্রহ থাকবে। সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের (সিএসডিএস) সাম্প্রতিক জরিপ বলছে, জনগণ ‘জিএসটিতে খুশি নয়’। তবে কঠোর পরিশ্রম ও সততার জন্য সমর্থকদের মধ্যে মোদির সুনাম রয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সঞ্জয় কুমার বলেন, ‘মোদি সরকারের প্রতি অসন্তুষ্টি মোকাবিলায় দুটি নিয়ামক রয়েছে: এক. কার্যকর বিকল্পের অভাব। দুই. মোদির ব্যক্তিগত গ্রহণযোগ্যতা। এখানে একটাই প্রশ্ন রয়েছে, তা হলো: নিজের ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়ে মোদি কত দিন এই অসন্তোষকে চাপা দিয়ে রাখতে পারবেন?’ সূত্র- বিবিসি
×