ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে থাকতে হবে

প্রকাশিত: ০৬:০৫, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে থাকতে হবে

মুনিবা মাজারি একজন পাকিস্তানী মানবাধিকার কর্মী, চিত্র শিল্পী, টেলিভিশন উপস্থাপক। সমাধিক পরিচিত আয়রন লেডি হিসেবে । ২০১১ সালে বিবিসির ‘১০০ সর্বাধিক অনুপ্রেরণমূলক নারী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং পরের বছর ফোর্বসের ‘আন্ডার থার্টি ইম্পেক্ট চ্যালেঞ্জ’-এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হন। এ বছরেও ফোর্বসের ‘আন্ডার থার্টি ইম্পেক্ট চ্যালেঞ্জ’ স্থান করে নিয়েছেন মুনিবা মাজারি। একুশ বছর বয়সে তিনি কার এক্সিডেন্ট এ তার শরীরের বিভিন্ন অংশ ভেঙ্গে যায়। বেঁচে থাকার আশা ছিল না প্রায়। ডাক্তারদের শত চেষ্টায় বেঁচে উঠলেও পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয় তাকে। এর পর থেকেই শুরু হয় জীবন সংগ্রাম। হুইল চেয়ারে বসেই তিনি বিশ্বকে জয় করেছেন। তিনি প্রথম পাকিস্তানী নারী মডেল যে কিনা হুইল চেয়ারে বসে বিশ্ববাসীকে দেখিয়েছেন ইচ্ছা শক্তি থাকলে অসাধ্যকেও সাধন করা যায়। মুনিবার জন্ম পাকিস্তানের এক রক্ষণশীল পরিবারে। সেখানে তার বাবা মার মুখে হাসি ফুটানোই ছিল প্রধান কাজ। বাবা-মার আদেশে ১৮ বছর বয়সেই তাকে বিয়ের পিড়িতে বসতে হয়। তিনি বিয়ে নিয়ে অখুশি থাকার পরে ও বাবা-মার কথা ভেবে হাসি মুখে মেনে নেন সেই বিয়ে। বিয়ের দুই বছরের মাথায় ২০০৭ সালে মুনিবা তার বাড়িতে যাবার পথে রোড এ্যাক্সিডেন্টে আক্রান্ত হন, মুনিবার স্বামী গাড়ি চালাচ্ছিলেন। তার স্বামী তাকে ফেলে গাড়ি থেকে বের হয়ে যান, তাকে উদ্ধারের চেষ্টা ও করেননি। সে সময় তিনি বুঝতে পারলেন তার শরীর কোনভাবেই নাড়াতে পারছেন না। শেষ পর্যন্ত উদ্ধারকারী দল গাড়ি কেটে তাকে বের করে আনেন। তখন তিনি সংজ্ঞাহীন । তার হাত, কাঁধ, পাঁজর এবং কলার থেকে একাধিক ফ্র্যাকচারস হয়। একদিন ডাক্তারা এসে তাকে বলেছিলেন যে, তার স্পাইনাল ইনজুরি এত যে তিনি আর কখনও হাঁটতে, ছবি আঁকতে পারবেন না। এমনকি মা হতে পারবেন না। হাসপাতালের বেডে তাকে প্রতিদিন নতুন নতুন দুঃসংবাদ শুনতে হতো। তখন প্রতিটি দিন সকাল হলে তাকে মৃত্যু যন্ত্রণা আঁকড়ে ধরত। মুনিবা ছবি আঁকতে ভালবাসতেন। আগে ছবি আঁকা ছিল তার প্রতিদিনের সঙ্গী। কিন্তু এ্যাক্সিডেন্টের পর প্রতিদিন হাসপাতালের বেডে শুয়ে মনের ক্যানভাসে নতুন নতুন ছবি আঁকতেন। হাসপাতালের লম্বা সাদা করিডোর তার ক্যানভাসে মিশে থাকত। মুনিবা ভাবলেন এভাবে চলতে থাকলে উনি আরও অন্ধকারের অতলে ডুবে যাবেন। তিনি আবার নিজেকে নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার তাগিদে যাত্রা শুরু করলেন।তিনি তার ভাইকে বললেন, তার জন্য ক্যানভাস আর রঙ আনতে। তিনি এবার আঁকতে চান। প্রথমে তুলির আঁচরে তিনি যে ছবি আঁকেন তা হলো তার হসপিটালের বেডে থাকার ছবি। সবাই তার আঁকা ছবি দেখে বাহবা দিতে লাগল কিন্তু তার হাসপাতাল জীবনের করুণ কাহিনী জানতে চাইল না। তখনি তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি নিজের জন্য বাঁচবেন। তিনি ভাবলেন অন্য কারও জন্য নিখুঁত হওয়ার প্রয়োজন নেই। আমার ভয়কে জয় করতে হবে। তিনি তার ভয়গুলো একটি কাগজে লিপিবদ্ধ করলেন। প্রতিজ্ঞা করলেন আমি আমার ভয়গুলোকে জয় করব। সবচেয়ে ভয়ের ব্যাপার ছিল তার স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্স। তিনি যখন জানলেন তার স্বামী আরেকটি বিয়ে করছেন তখন তিনি শুধু একটি এসএমএস করেন তার প্রাক্তন স্বামীর কাছে ‘আমি জেনে খুব খুশি হলাম তুমি আবার বিয়ে করছ তোমার জন্য অনেক শুভ কামনা।’ তার দ্বিতীয় ভয় ছিল তিনি কখনও মা হতে পারবেন না। তিনি ভাবলেন এই পৃথিবীতে অনেক বাচ্চা আছে যারা এতিম যাদের কেউ নেই তাদের মাঝ থেকে যে কাউকে তার বাচ্চা হিসেবে নিতেই পারেন তিনি। তার মতো করে গড়ে তুলবেন তাকে। শিক্ষা দেবেন, মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবেন। এরপর তিনি বিভিন্ন অনাথ আশ্রমে যোগাযোগ করতে লাগলেন। এর প্রায় দুই বছর পর তিনি অনাথ আশ্রম থেকে বাচ্চা নিলেন। ওই সময় অনাথ ছেলেটার দুইদিন বয়স ছিল আজ তার বয়স ৬ বছর। সেই থেকে শুরু হলো তার নতুন করে বেড়ে ওঠার ইতিহাস। মুনিবা তার এক সাক্ষাৎকারে বলেন- ‘যখন আপনি হুইলচেয়ারে থাকবেন, সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার কি জানেন? মানুষ মনে করে যে, তারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না, কারণ সবাই মনে করে এই দুনিয়াতে নিখুঁত মানুষ সব কিছুর অংশীদার আর অক্ষম মানুষেরা সব কিছুর থেকে বঞ্চিত থাকবে তাই তাদের নিয়তি। এরপর থেকে আমি নিজেকে আর ও বেশি করে তুলে ধরার চেষ্টা করি। সত্যি কথা বলতে আপনি যখন নিজের পথকে সঠিক ভেবে মেনে নেবেন তখন অন্যরা তা মেনে নেবে। নিজেকে নিজের আত্মশক্তিতে বলিয়ান করতে হবে। ভাবতে হবে আমার প্ল্যান অনুযায়ী সব হবে। এই জীবনে সব কিছুর স্বাদ নিতে হবে। তবে সব কিছুর স্বাদ নেয়া এত সহজ নয়। কখনও নিজের ওপর দোষারোপ করবে না। জীবনে হাসি কান্না থাকবে সেটাই স্বাভাবিক তার মাঝেই উঠে দাঁড়াতে হবে। বার বার বার্থ হলে ও চেষ্টা করে গেলে সফল হবে নিশ্চয়ই। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত কে প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসকে এনজয় করতে হয়। কখনও নিজের জীবিত থাকার অবস্থায় মরে গেলে চলবে না। সব সময় বিধাতার কাছে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে বেঁচে থাকার জন্য। জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত বেঁচে থাকতে হবে নিজের মতো করে।
×