ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বন্দীদের সুচিকিৎসার জন্য প্রকল্প

‘কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র’ নির্মাণ করা হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

‘কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র’ নির্মাণ করা হচ্ছে

মশিউর রহমান খান ॥ দেশে প্রথমবারের মতো ৬৮ কারাগারের মাদকাসক্ত বন্দীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সর্বোচ্চ চিকিৎসার জন্য আধুনিক ‘মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র’ নির্মাণ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে কারাবন্দী নারী-পুরুষ, কারা কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় নাগরিকদের প্রাথমিকসহ সব প্রকার স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ২শ’ শয্যা বিশিষ্ট ডিজিটাল সুবিধা সমৃদ্ধ ‘কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল’ নির্মাণ করা হচ্ছে। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জের কারা সীমানায় সারাদেশ থেকে আসা বন্দীর দ্বিতীয় পর্যায়ের চিকিৎসা প্রদানের জন্য এই দুটি প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্পটির নাম দেয়া হয়েছে ‘কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র’। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অধীনে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে। প্রায় ২শ’ ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বন্দীর সুচিকিৎসার জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রকল্পটির কাজ শুরু করা হবে। এটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে ২০২০ সালের জুনে। সম্পূর্ণ সরকারী অর্থায়নে এটি নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে দেশের সব কারাগারে আটক গড়ে প্রায় ৭০ হাজার বন্দীর মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশের অধিক সরাসরি মাদকাসক্ত বন্দী রয়েছে। যারা বিভিন্ন সময় কারাগারে মাদক মামলায় গ্রেফতার হয়ে আটক রয়েছে। কারাগারে কোন কোন সময় এর হার ১৫ শতাংশও ছাড়িয়ে যায়। এতে সারাদেশের কারা হাসপাতালের স্টাফদেরও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে কারাগারে বন্দীদের মাঝে মাদকাসক্তের হার অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা কারাকর্তৃপক্ষের। কারা অধিদফতরের হিসাবে মোট কারাবন্দীর মধ্যে শতকরা ১০ ভাগের বেশি বন্দীই সরাসরি মাদকাসক্ত বলে জানা গেছে। যাদের মধ্যে বেশিরভাগই কিশোর ও যুবক-যুবতী রয়েছেন। কারাসূত্র জানায়, এসব মাদকাসক্ত কারাবন্দীদের মধ্যে প্রায় ৪২ ভাগই যুবক যুবতী। যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। এছাড়া ১৮ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে কিশোর মাদকাসক্ত বন্দী প্রায় ২৭ শতাংশ। মাদকাসক্ত কারাবন্দীদের মধ্যে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সীরা। এরপর রয়েছে যথাক্রমে ৪৫ থেকে ৫৪, ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী এবং ৬৫ বছরের উর্ধে যাদের বয়স তারা। এসব মাদকাসক্ত বন্দীরাই দীর্ঘদিন কারা অভ্যন্তরে থাকতে থাকতে একপর্যায়ে মানসিক হীনম্মন্যতায় ভোগে। একসময় মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়তে দেখা গেছে। কারা অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশের ৬৭টি কারাগারে মানসিক রোগাক্রান্ত বন্দীর সংখ্যা ৩শ’ ৮৫। এর মধ্যে ২৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী বন্দী রয়েছেন ৩৭ দশমিক ৪০ শতাংশ। এছাড়াও ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী মানসিক রোগাক্রান্ত বন্দী রয়েছেন ৫৪। ৩৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী ১শ’ ২০ জন রয়েছেন। তবে ৪৫ থেকে ৫৪ বছর বয়সী বন্দীদের মধ্যে মানসিক রোগাক্রান্তের সংখ্যা অর্ধেকেরও বেশি কমে এসেছে। এই বয়সীদের মধ্যে মানসিক রোগাক্রান্ত বন্দী রয়েছেন মাত্র ৪০ জন। ৫৫ থেকে ৬৪ বছর বয়সী মানসিক রোগাক্রান্ত করাবন্দী রয়েছেন ২৩ জন। আর ৬৫ বছর বা এর উর্ধে এমন মানসিক রোগাক্রান্ত কারাবন্দী রয়েছেন ৪ জন। বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত মাদকাসক্তির দ্বিতীয় দাপ মানসিক রোগ। এ কারণেই কারাগারে যেসব মাদকাসক্ত বন্দী আসেন, দীর্ঘদিন কারা অভ্যন্তরে আটক থেকে সৃষ্ট নানা সমস্যার কারণে একপর্যায়ে সেসব বন্দীই মানসিক রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন। তাই মাদকাসক্ত কারাবন্দীদের দ্বিতীয় ধাপে পৌঁছানোর আগেই যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলে অনেকাংশেই এ সমস্যা সমাধান হবে। তাছাড়া কারাগারে বন্দী আধুনিক হাসপাতাল ও মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র হলে নতুনভাবে মাদকাসক্ত হওয়ার প্রবণতাও হ্রাস করা সম্ভব হবে। কারা সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের বিভিন্ন কারাগারে আটক কারাবন্দীদের সুচিকিৎসার জন্য ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দীদের পাঠানো হয়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাকর্তৃপক্ষ এসব রোগীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারী বিশেষায়িত হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা প্রদান করেন। গত বছর রাজধানীর বারডেম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দেয় যে, তাদের হাসপাতালে বন্দী রোগী রেখে চিকিৎসা করলে হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য সারাদেশ থেকে আসা অন্য রোগীর ও হাসপাতাল প্রশাসনের নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। তাই তাদের হাসপাতালে কোন রোগী না আনতে বা ভর্তি না করতে অনুরোধ করেন। এরই অংশ হিসেবে কারা কর্তৃপক্ষকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা মানতে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু নিজস্ব কোন বিশেষায়িত হাসপাতাল না থাকায় ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তার না থাকায় বাধ্য হয়ে কারাকর্তৃপক্ষ বারডেমসহ সব বিশেষায়িত হাসপাতালে তাদের বন্দী রোগীকে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। বর্তমানে সারাদেশের ৬৮ কারাগারের মোট ১শ’ ১২টি ডাক্তারের পদের মধ্যে মাত্র ৬ জন ডাক্তার রয়েছে। ফলে কোনক্রমেই ফার্মাসিস্ট ও কয়েকজন নার্স দিয়েই সারাদেশে আটক ৭০ হাজার বন্দীর চিকিৎসা চলছে। এর বাইরে জেলা কারাগারের ক্ষেত্রে সিভিল সার্জনের মাধ্যমে প্রতি সপ্তাহে নির্ধারিত সময়ে ডাক্তার দিয়ে কোনমতে চিকিৎসা চলছে সারাদেশের কারাবন্দীদের। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা গেলে বন্দী চিকিৎসার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে বলে ধারণা কারাকর্তৃপক্ষের। কারা অধিদফতর সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নামের এই আধুনিক হাসপাতালটিতে থাকবে মনোবিজ্ঞান ইউনিট, সার্জারি ইউনিট, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন ডিপার্টমেন্ট, কার্ডিওলজি ইউনিট, রেডিওলজি ইউনিট, প্যাথলজি ইউনিট, জরুরী বিভাগ, চর্মরোগ ইউনিট, অপারেশন থিয়েটার, এনেসথেসিয়া ইউনিট, পেডিইয়াট্রিকস ইউনিট, মেডিসিন ইউনিট, গাইনিকোলজি ও বিস্টরিক্স ইউনিট, সার্জারি ইউনিট, অর্থোপেডিক ইউনিট, চোখের ইউনিটসহ গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু ইউনিট। বঙ্গবন্ধু কারা প্রশিক্ষণ কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে ২৬০টি শয্যার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে ১৯ লাখ টাকা। আর ১৬৫টি কেবিনের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ লাখ ৫ হাজার টাকা। এছাড়া ২৮ লাখ টাকা ব্যয়ে আদালত নির্দেশিত বা গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর রোগে আক্রান্ত অসুস্থ রোগীদের জন্য ১শ’ ৬৫টি কেবিনও তৈরি করা হবে ওই হাসপাতালে। ২০২০ সালের জুনেই এটি নির্মাণ শেষে চালু করা হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দীন জনকণ্ঠকে বলেন, সারাদেশের আটক প্রায় ৭০ হাজার কারাবন্দীর সুচিকিৎসার স্বার্থে সরকার দেশে প্রথমবারের মতো কেরানীগঞ্জ কারা কমপ্লেক্স এলাকায় কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল ও মাদকাসক্ত কারাবন্দীর চিকিৎসার জন্য প্রথমবারের মতো মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র নির্মাণ করছে। সরকারী অর্থে প্রায় ২শ’ ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে শুরু হয়ে প্রকল্পটি ২০২০ সালের জুনে এটির নির্মাণ কাজ শেষ হবে। এরপরই এটি চিকিৎসার জন্য খুলে দেয়া হবে। এই হাসপাতালটিতে আধুনিক প্রায় সব চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী, এই হাসপাতালটিতে এই প্রথমবারের মতো এতে কারাবন্দীর চিকিৎসার পাশপাশি কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীর চিকিৎসাও করা হবে। পাশাপাশি কেরানীগঞ্জের স্থানীয় নাগরিকদেরও চিকিৎসার যাবতীয় ব্যবস্থা করা হবে। এতে সারাদেশের কারা হাসপাতালের স্টাফদেরও প্রশিক্ষণ প্রদান করা হবে। হাসপাতাল ও মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রটি তৈরি হলে কারাগারে আটক হাজার হাজার মাদকাসক্ত বন্দীর সুচিকিৎসা করে বন্দীদের সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব হবে। এর মাধ্যমে কারাগারে বন্দীদের মাঝে মাদকাসক্তের হার অনেকটাই কমে আসবে বলে আশা করি।
×