ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ বিতরণকালে খালেদা

সরকারের কোন ত্রাণ তৎপরতা চোখে পড়ছে না

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

সরকারের কোন ত্রাণ তৎপরতা চোখে পড়ছে না

শরীফুল ইসলাম, চট্টগ্রাম থেকে ॥ রোহিঙ্গারা দেশের জাতীয় সঙ্কট উল্লেখ করে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তাদের দেশে ফেরত নিতে মিয়ানমার সরকার এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, তাদের মাঝে শুধুমাত্র ত্রাণ বিরতণ করেই এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এ বিষয়ে সরকারকে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও বাড়াতে হবে। আন্তর্জাতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে দ্রুত রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ তৎপরতা চালাতে যেমন ব্যর্থ হয়েছে, তেমনি রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতেও সরকার ব্যর্থ। তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হচ্ছে। এই ব্যবস্থা যাতে আর না হয় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। অবিলম্বে সরকারকে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে হবে উল্লেখ করেন। সোমবার দুপুরে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ময়নারগোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ত্রাণ বিতরণ শেষে তিনি এসব কথা বলেন। এখানে ত্রাণ বিতরণের আগে তিনি শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। এ সময় তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতনে পিতা হারানো চার মাস বয়সী ছোট্ট একটি রোহিঙ্গা শিশু কোলে নেন। রোহিঙ্গাদের উপর নির্যাতনের বর্ণনা শুনে তিনি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। রোহিঙ্গাদের শরণার্থীদের তিনি ধৈর্য ধারণ করতে বলেন এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে বলেন। এ সময় তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে বলব, শুধু কথার কথা বললে হবে না, এটা কাজে দেখিয়ে দিতে হবে। সেজন্য অবিলম্বে মানবিক স্বার্থে আপনারা এই রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য দায়িত্ব নিতে হবে। যাতে শরণার্থী রোহিঙ্গারা তাদের নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে। এটা আপনাদের নৈতিক দায়িত্ব বলে মনে করি। ত্রাণ বিতরণ শেষে খালেদা জিয়া আরও বলেন, বিএনপি রোহিঙ্গা সঙ্কটের শুরু থেকেই ত্রাণ বিতরণ করলেও এখানে সরকারের কোন ত্রাণ তৎপরতা চোখে পড়ছে না। বাংলাদেশ একটি গরিব এবং ঘনবসতি দেশ। রোহিঙ্গাদের বেশিদিন সহায়তা করা কঠিন। বিশ্বের বড় বড় দেশগুলোকে বলব তারা যেন মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টি করে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোকে আরও বেশি করে রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ পাঠানোর আহ্বান জানান। তিনি মিয়ানমার সরকারকেও অবিলম্বে রোহিঙ্গাদের ফিরে নেয়ার জন্য আহ্বান জানান। বলেন, বাংলাদেশের মানুষ উদার। তাই বিপদের সময় রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এদেশের পক্ষে বেশিদিন রোহিঙ্গাদের সহযোগিতা করা সম্ভব হবে না উল্লেখ করেন। ১৯৭৮ সালেও একবার এমন হয়েছিল। তখন মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়েছিল। ’৯৩ সালেও আবার এসেছিল আমার সরকারের আমলে। তখনও মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের দেশে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মিয়ানমার সরকারকেও আহ্বান জানাবো, আপনাদের নিজের দেশের মানুষকে ফিরিয়ে নিয়ে নিরাপত্তা ও নাগরিকত্বসহ সব ধরনের সহযোগিতা দেবেন। তাদের ওপর যে নির্যাতন হয়েছে তা অমানবিক। ওপরে ওপরে সহানুভূতি দেখালে হবে না। সামনে শীত আসছে, বর্ষা আসছে। এরা যাতে তাদের নিজের দেশে ফিরে যেতে পারে নিরাপদে থাকতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের কাজ আমরা চালিয়ে যাব যতদিন পারি। কিন্তু এভাবে সমস্যার সমাধান হবে না। আলাপ-আলোচনা ও কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে তাদের নাগরিককে সে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং তাদের নির্ভয়ে থাকতে দিতে হবে। হত্যা-নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আহ্বান জানিয়েছিলাম। এরপর বাংলাদেশ সরকার এদেশে তাদের আশ্রয় দেয়। এরপর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায় এবং তাদের ফেরত নিতে নির্দেশ দেয়। কিন্তু এরপরও রোহিঙ্গারা তাদের দেশে নির্যাতিত হতে থাকে এবং এ দেশে আসতে থাকে। বিএনপি নেত্রী এ সময় আরও বলেন, বিএনপির দাবির পরই কেবল সরকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শৃঙ্খলা আনতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে। তাদের কারণে এখন ক্যাম্পে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। রোহিঙ্গাদের মাঝে সেনাবাহিনী সুষ্ঠুভাবে রিলিফ কার্ড বিতরণ করেছে। এজন্য সেনাবাহিনীকে তিনি ধন্যবাদ জানান। ত্রাণ দেয়ার সফরে সাংবাদিকদের ওপর হামলার বিষয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কারা এই হামলা চালিয়েছে সরকার তা জানে এবং সেটা মিডিয়াতেও দেখা গেছে। সরকারকে অবশ্যই এগুলো বন্ধ করতে হবে। এগুলো করে কোন লাভ হবে না। বরং এগুলো করে মানুষের কাছ থেকে আপনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের ওপর হামলার তীব্র নিন্দা জানান এবং আহতদের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ত্রাণ বিতরণকালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে আরও ছিলেন, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ড. মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল নোমান, মোহাম্মাদ শাজাহান, মীর মোহাম্মাদ নাছির, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমান, জয়নাল আবেদীন ফারুক, যুগ্ম মহাসচিব খায়রুল কবির খোকন, হাবিবুন্নবী খান সোহেল, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, শামা ওবায়েদ প্রমুখ। এদিকে ত্রাণ বিতরণের পূর্বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, খালেদা জিয়ার ত্রাণ বিতরণ স্থলে সেনাবাহিনী এবং পুলিশ থাকার কথা ছিল। কিন্তু ত্রাণ বিতরণকালে তাদের দেখা যায়নি। ত্রাণ বিতরণের জন্য কক্সবাজারের ডিসি এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা এ বিষয়ে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করে বলে তিনি অভিযোগ করেন। দলের অপর স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, গত রবিবার এখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল। কিন্তু সোমবার খালেদা জিয়ার সময় তারাই নাই কেন? তিনি বলেন বিএনপির পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের মাঝে ১১০ টন চাল (১০ কেজি চালের ১১ হাজার ব্যাগ) বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া ড্যাবের স্বাস্থ্য ক্যাম্পের মাধ্যমে প্রসূতি মায়েদের জন্য ৫ হাজার ব্যাগ এবং শিশুদের জন্য আরও ৫ হাজার ব্যাগ ত্রাণসামগ্রী স্বাস্থ্য ক্যাম্পের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে উল্লেখ করেন। সোমবার বেলা সোয়া ১১টার সময় বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কক্সবাজার সার্কিট হাউস থেকে উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরের উদ্দেশে রওনা দেন। এরপর কলাতলী হয়ে মেরিনড্রাইভ সড়ক ধরে সোনারাপাড় হয়ে উখিয়ার কোটবাজার, উখিয়ার সদর, কুতুবপালং বালুখালী ও হাকিমপাড়া হয়ে ময়নারগোনা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শিবিরে পৌঁছান দুপুর সোয়া ১টায়। খালেদা জিয়া যখন শফিউল্লাহ কাটার ময়নারগোনা ক্যাম্পে পৌঁছান তার আগে থেকে সেখানে হাজারো রোহিঙ্গা শরণার্থী অপেক্ষা করছিল ত্রাণ নিতে। বিএনপি নেত্রীর উপস্থিতিতে ঘিরে পুরো ক্যাম্পে তখন নেতাকর্মী, স্থানীয় মানুষ আর রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী মিলে সমাবেশস্থলের রূপ নেয়। ভিড় ঠেলে খালেদা জিয়া ত্রাণ দেয়ার স্থানে পৌঁছেই অপেক্ষারত শরণার্থীদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করেন। ত্রাণ দেয়ার এক পর্যায়ে এক রোহিঙ্গা নারী মিয়ানমার সরকারের নির্যাতনের বর্ণনা করে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। খালেদা জিয়া সেই কাহিনী শুনে কিছুক্ষণের জন্য আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন। এখানে ত্রাণ বিতরণ শেষে তিনি হাকিমপাড়া ও বালুখালী রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ বিতরণ করেন। পরে বালুখালী পানবাজারে অবস্থিত ডক্টর এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ড্যাবের স্বাস্থ্য ক্যাম্প উদ্বোধন করেন। এই স্বাস্থ্য ক্যাম্প থেকে রোহিঙ্গাদের সার্বক্ষণিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ড্যাবের স্বাস্থ্য ক্যাম্প উদ্বোধনের পর সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে তিনি বেলা তিনটায় তিনি কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন। বিকেল সোয়া চারটায় তিনি কক্সবাজার সার্কিট হাউসে পৌঁছান। এখানে মধ্যাহ্নভোজ এবং বিরতির পর সন্ধ্যায় চট্টগ্রামের উদ্দেশে রওনা হন এবং রাতে তিনি চট্টগ্রাম সার্কিটর হাউসে অবস্থান করেন। আজ মঙ্গলবার তিনি ঢাকার উদ্দেশে চট্টগ্রাম ত্যাগ করবেন।
×