ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বীরেন্দ্রনাথ অধিকারী

স্মরণ ॥ ফণী ভূষণ মজুমদার ॥ অনন্য এক বিপ্লবী

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

স্মরণ ॥ ফণী ভূষণ মজুমদার ॥ অনন্য এক বিপ্লবী

আজ ৩১ অক্টোবর এমন একজন মহান দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদের ৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকী, যার নামের সঙ্গে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তিনি ‘ফণী ভূষণ মজুমদার’, বিপ্লবী তো বটেই, তবে অন্য সকলের চেয়ে ব্যতিক্রমধর্মী। তার রাজনৈতিক কর্মধারা, জীবনাচার, চলন, বলন, আচার, ব্যবহার- সবকিছুতেই ছিল স্বকীয়তা, যেসবের শুরু একেবারে তার শৈশব থেকেই। সেকালের মাদারীপুরের প্রমত্ত আড়িয়াল খাঁর তীরে ভারতবিখ্যাত অম্বিকাচরণ মজুমদারের পরিবারে জন্মসূত্রে তার ধমনীতে ছিল রাজনীতির লহুধারা প্রবহমান। রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার সুবাদে সে সময়ের ভারতবর্ষের যুগান্তর, অনুশীলন, স্বদেশী ও অহিংসবাদী আন্দোলনের বহু রাজনৈতিক নেতাকর্মীর সংশ্রবে আসার অবাধ সুযোগ সৃষ্টি হয় তার। তাছাড়া সে সময়ে গোটা ভারতর্ষের মধ্যে একক অঞ্চল হিসেবে মাদারীপুরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বিপ্লবীর জন্ম ও সমাবেশ ঘটেছিল, যাঁদের প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গেই পর্যায়ক্রমে ফণী ভূষণ মজুমদারের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সখ্য গড়ে ওঠে। পারিবারিক শিক্ষার পাশাপাশি তিনি সকল রাজনৈতিক নেতাকর্মীর কাছ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, যা কিছু ভাল তা গ্রহণ করেছেন, মন্দ সবকিছু বর্জন করেছেন, যে সবের প্রতিফলন ঘটেছে তার জীবনব্যাপী কর্মধারায়। এ কারণেই তিনি ব্যতিক্রম, স্বকীয়তায় সমুজ্জ্বল বিপ্লবী। ১৯১৫ সালে উড়িষ্যার বালাশোরের বুড়িবালাম নদীর তীরে বিপ্লবী বাঘা যতীনের নেতৃত্বে ব্রিটিশবিরোধী অসম যুদ্ধে যে ক’জন বিপ্লবী বীর শহীদ হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মাদারীপুরের সন্তান নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত, যিনি ফণী ভূষণ মজুমদারের আত্মীয়, বয়সে তার চেয়ে বছর সাতেক বড়। ১৯২০ সালের দিকে ফণী ভূষণ মজুমদার সান্নিপাতিক জ্বরাক্রান্ত হলে চিকিৎসার জন্য তাকে নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তদের মাদারীপুর শহরের বাসায় রাখা হয়। নীরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের জ্যেষ্ঠ সহোদর অমলেন্দু দাশগুপ্ত সাহিত্যিক হলেও মূলত তিনি ছিলেন বিপ্লবীদের বুদ্ধি বা পরামর্শদাতা। অসুস্থ অবস্থায় অনুজতুল্য ফণীভূষণ মজুমদার তার কাছে অনেক বিষয়ে পাঠদান নিয়েছেন। একদিন কথা প্রসঙ্গে অগ্রজের প্রতি অনুজের এরূপ প্রশ্ন ছিল ‘আচ্ছা দাদা, শুনেছি মৃত্যুর সময় নীরেন’ দা বলে গিয়েছেন, ‘আমরা মরে যাচ্ছি, কিন্তু যেসব অস্ত্র-বারুদ রেখে যাচ্ছি, সে সব একদিন বিস্ফোরিত হয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীন হবেই, কেউ রুখতে পারবে না’, তো কী এবং কোথায় সেই সব অস্ত্র-বারুদ?’ অনুজের প্রশ্ন শুনে মৃদু হেসে অমলেন্দু দাশগুপ্ত বললেন, ‘আমি, তুমি, আমরা সকলে সেই সব অস্ত্র-বারুদ।’ উত্তর শুনে যেন আপাদমস্তক বিদ্যুতপ্রবাহ বয়ে যায়, শিহরিত হয়ে দেশাত্ববোধের অমোঘ টানে তাৎক্ষণিকভাবেই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের শপথ নেন যুবক ফণী ভূষণ মজুমদার। এভাবেই রাজনীতিতে যাত্রা শুরু তার। অমলেন্দু দাশগুপ্ত তাত্ত্বিক গুরু হলেও, মূলত ফণী ভূষণ মজুমদারের বাস্তব রাজনীতির হাতে খড়ি বিপ্লবী পূর্ণ চন্দ্র দাসের হাত ধরে। অসুস্থ অবস্থায় তিনি দেখতে পেলেন, দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য শহীদ হওয়া এক বিপ্লবীর বাসা হওয়ার কারণে সেখানে বিপ্লবীদের আনাগোনা লেগেই থাকত। বিখ্যাত আরেক রাজনৈতিক পরিবারের রোগাক্রান্ত সদ্য কৈশোর পেরুনো এক যুবককে সকলে সেখানে এক নজর দেখা এবং তার ভাল-মন্দ খোঁজখবর নেয়া তাদের কর্তব্য বলেই মনে করতেন তারা। এ রকমই একজন ‘পূর্ণচন্দ্র দাস’, যিনি টগবগে এক যুবক, ততদিনে পূর্ণমাত্রায় বিপ্লবী, ব্রিটিশদের ত্রাস। বিপ্লবী পূর্ণ চন্দ্র দাস নিয়মিত অনুজতুল্য ফণী ভূষণ মজুমদারের কুশলাদি জিজ্ঞেস করেন। এক দুর্নিবার আকর্ষণে পেয়ে বসে, সুস্থ হয়ে পুরোদস্তুর রাজনৈতিক কর্মী বনে যান ফণী ভূষণ মজুমদার। এভাবেই সেই যে ঘর ছাড়লেন, আর ঘরে ফেরা হয়নি তার। ব্রিটিশ পেরিয়ে পাকিস্তান, তারপর স্বাধিকার আন্দোলন থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন এবং স্বাধীন বাংলাদেশে আমৃত্যু ফণী দার এই সার্বজনীন জনপ্রিয়তার বিন্দুমাত্র ঘাটতি দেখা যায়নি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালনার জন্য প্রায়শই তিনি পশ্চিমবঙ্গে ট্রেনে ভ্রমণ করতেন। সে সময় ‘জয় বাংলা’র ভিড়ে ট্রেনে সিট পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল। কিন্তু তাতে কী! যখনই কেউ দেখেছে, ফণী ভূষণ মজুমদার ট্রেনে দাঁড়িয়ে, অমনি সিট ছেড়ে উঠে তাকে বসার ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওখানকার মানুষজন। ফণী দা বিব্রত হয়ে বলতেন, না, না, প্রয়োজন নেই, আপনারা বসুন। কিন্তু ভারত বিভাগের দুই যুগ পার হয়ে গেলেও ওখানকার মানুষজন তাদের প্রিয় নেতাকে ভোলেনি, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করেনি তারা। তাদের ভাষ্য ছিল, আপনি নেতাজীর সহকর্মী, আপনি আমাদের নেতা, আপনি দাঁড়িয়ে থাকবেন, আর আমরা বসে যাব, তা হতে পারে না। শুধু পশ্চিমবঙ্গেই নয়, সে সময় মুক্তিযুদ্ধের প্রচারণায় ভারতবর্ষের যে প্রান্তেই ফণী দা গিয়েছেন সেখানেই তাকে ঘিরে ধরেছে সেখানকার লোকজন। ভারতীয়দের মধ্যে ফণী দার বিপুল এই জনপ্রিয়তাকে মোক্ষম কাজে লাগিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকার। সে সময় তিনি মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন না বটে, কিন্তু মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাকে এমন সব কর্মকাণ্ডের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে, যে সব অন্য কাউকে দিয়ে সম্ভব ছিল না। ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভা এবং রাজ্যসভার সদস্যদের যুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভাষণদানের জন্য ফণী দাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি বেশ কয়েক দিন আগে দিল্লী গিয়ে দলমত নির্বিশেষে পুরনো সব শীর্ষস্থানীয় এবং প্রভাবশালী নেতৃবৃন্দকে সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলার জন্য রাজি করান। তাদের মধ্যে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী তো বটেই, আরও ছিলেন গুলজারি লাল নন্দা, মোরারজি দেশাই, চরণ সিং, শরণ সিং, ওয়াই বি চ্যবন, ডি পি ধর, জগজীবন রাম, চন্দ্র শেখর, অটল বিহারী বাজপেয়ী প্রমুখ। ফণী দা বলেছেন, একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ, যিনি উক্ত পার্লামেন্টে ফণী দা ভাষণদানকালে প্রতিবাদ করেছিলেন। তবে অন্য সদস্যরা তাকে নিবৃত করে বসিয়ে দেন। ফণী দার জ্বালাময়ী ভাষণে মুহুর্মুহু করতালি এবং ‘জয়বাংলা’ সেøাগানে সেদিন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ভারতীয় পার্লামেন্ট। পরে জয়প্রকাশ ফণী দার কাছে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং বাংলাদেশের পক্ষেই কাজ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রথম মন্ত্রিসভায় ফণী দাকে খাদ্য ও বেসামরিক পরিবহন দফতরের দায়িত্ব অর্পণ করেন। এ খবর শুনে তৎকালীন যুব এবং ছাত্র নেতাদের মধ্যে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। ফণী দা তখন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ফুলার রোডে তার ভাগ্নে অধ্যাপক হীরণ¥য় সেনগুপ্তের বাসায় অবস্থান করছিলেন। আর যায় কোথায়! ফণী দার অমত সত্ত্বেও ছাত্র-যুব নেতারা সেখান থেকে তাকে মাথায় তুলে বের করে নিয়ে আসেন, আনন্দ মিছিল করেন। সে যা হোক, ফণী দা কিন্তু এই আনন্দের আতিশয্যে গা ভাসিয়ে বসে থাকেননি। তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহে একের পর এক দেশ, যথা- অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ড, আমেরিকা, জাপান, ভারত প্রভৃতি দেশ ভ্রমণপূর্বক অনেক চুক্তি সম্পাদন করেন। কিন্তু তার পরও দেশী-বিদেশী কুচক্রী মহলের ষড়যন্ত্রের ফলে ’৭৪ সালে দেশে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তিনি নিজে কৃচ্ছ্র সাধনে কঠোর হন, অন্যদেরও তাতে উদ্বুদ্ধ করেন। সে সময়ে তার বাসা ও পরিবারের জন্য যে খাদ্য তালিকা তিনি নিজে তৈরি করে দেন, তা ছিল বিস্ময়কর। পরিবারের সদস্য এবং অতিথিদের সপ্তাহের মেন্যু ছিল এ রকম- প্রতিদিন সকালে ও রাতে আটার রুটি, সঙ্গে কুমড়া বা পেঁপে বা বেগুন সবজি, দুপুরে দুই দিন ভাত আর অন্য পাঁচ দিন গমভাঙ্গা খিচুড়ি, সঙ্গে ডাল ও নিরামিষ তরকারি, মাত্র দুয়েক দিন মাছ রাখা হতো। তিনি নিজে ওই দিনগুলোতে কোন সময়েই ভাত খাননি, তিন বেলা আটার রুটি খেয়েছেন। আর প্রতি সপ্তাহে রেশন দোকান থেকে চাল, গম, চিনি, কেরোসিন, সাবান ইত্যাদি তার বাসার জন্য ক্রয় করা ছিল বাধ্যতামূলক। বিশ্বে আর কোথাও কেন মন্ত্রীর বাসায় কোন কালে এমন খাবার মেন্যু করা হয়েছে বলে আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। এতদসত্ত্বেও ওই সময় একদিন বিবিসির বাংলা সংবাদে বাংলাদেশের খাদ্যমন্ত্রীকে নিয়ে বিরূপ সমালোচনা করা হয়। ফণী দা বিষয়টি জানতে পেরে তৎকালীন ঢাকার বিসিসি ব্যুরো চীফ মার্ক টালিকে নিজে ডায়াল করে এই বলে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন যে, মার্ক টালি বিনা নোটিসে যে কোন দিন যে কোন সময়ে তার বাসা বা কর্মস্থলে এসে খাদ্য তালিকাসহ সকল কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ ও আহার গ্রহণ করতে পারেন। তখনকার খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় সাংবাদিক মার্ক টালি কুপোকাত হয়ে ফণী দার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এই তো আজীবন বিপ্লবী ফণী ভূষণ মজুমদার। এই অনন্য বিপ্লবীর ব্যাপারে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী আরেক স্বনামখ্যাত বিপ্লবী পঞ্চানন চক্রবর্তী স্মৃতিচারণে যেমনটি বলেছেন, ‘ফণী তেজে ব্যক্তি মর্যাদা, দুঃসাহসে সহকর্মীদের মর্যাদা এবং সংগ্রামী নির্দেশে জাতির মর্যাদা উঁচাইয়া ধরিল। নেতৃত্বের এই তো আবাহন। এই আমাদের ফণী।’ ৩৭তম মহাপ্রয়াণ দিবসে আমৃত্যু বিপ্লবী বীর ফণী ভূষণ মজুমদারের প্রতি বিনম্র প্রণতি ও শ্রদ্ধাঞ্জলি। লেখক : মুক্তিযোদ্ধা ও প্রযুক্তিবিদ
×