ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার দিনরাত

প্রকাশিত: ০৩:৪৬, ৩১ অক্টোবর ২০১৭

ঢাকার দিনরাত

শীতকাল যাদের পছন্দ তারা ইতোমধ্যেই সুখবার্তাটি পেয়ে গেছেন- শীত আসি-আসি করছে। ঢাকায় এখন কোন কোন রাতে তাপমাত্রা নেমে আসছে বাইশ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। দিনের বেলা আর অসহ্য গরম নেই। সূর্য আর তীব্র তাপ ছড়াচ্ছে না। গরমে ঘর্মাক্ত আর হাঁসফাঁস দিনগুলো বিদায় নিচ্ছে। কাল থেকে শুরু নবেম্বর। সাধারণত এই মাসেই ঢাকাবাসী পুরুষেরা হাফ হাতা শার্টকে বিদায় দিয়ে হাফ সোয়েটার নামান আলমারি থেকে। আর নারীরা পাতলা শাল রাখেন সঙ্গে বাইরে বেরুলে। তবে শীত পুরোপুরি না এলেও রাজধানীর সাংস্কৃতিক অঙ্গন রীতিমতো জমজমাট হয়ে উঠেছে। প্রতিটি আর্ট গ্যালারিতে চলছে চিত্র প্রদর্শনী, নাটকের মঞ্চগুলোর ফুরসত নেই; গানের জলসা বসছে নিয়মিতভাবেই। তবে এবার বেঙ্গল আয়োজিত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত উৎসবটি হচ্ছে না। আয়োজকরা সংবাদ সম্মেলন করে নির্ধারিত ভেন্যু বরাদ্দ না পাওয়ার কথা জানান। বিগত পাঁচ বছর বেশ সফলতার সঙ্গেই এই উৎসবটি হয়েছে, একথা বলতেই হবে। ঢাকায় রাতভর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বেশ একটা প্রাণবন্ত উৎসব করার রেওয়াজ গড়ে উঠেছিল, এটা সত্যি। শতভাগ দর্শক-শ্রোতাই যে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের রস উপভোগে সমর্থ, এমনটা হয়তো সঠিক নয়। তবে তাতেও ক্ষতি নেই। ঢাকার তারুণ্যশক্তি সুরের ধারায় অবগাহনের চাইতে পরস্পর আড্ডা-গল্প আর আনন্দেও যদি রাত পার করে থাকে, তারপরও এটিকে স্বাভাবিক প্রাণোচ্ছলতা হিসেবে দেখতে হবে। সেটুকু উদারতা নিশ্চয়ই সংস্কৃতিবান ঢাকাবাসীর রয়েছে। এবার উৎসব না হওয়ায় সত্যিকারের সঙ্গীতপ্রেমীরা কষ্ট পাবেন। অবশ্য আয়োজকরা চাইলে এই কষ্ট কমানোর উদ্যোগ নিতে পারেন। আর্মি স্টেডিয়াম পাওয়া যায়নি, তাই আন্তর্জাতিক উৎসবটি হচ্ছে না। এবার উৎসবটি জাতীয় পর্যায়েও হতে পারে। পাঁচ দিনের জায়গায় তিন দিন হলেও অসুবিধে নেই। আর ভেন্যু? ধানমণ্ডির ছায়ানট ভবনে হতে পারে। দেশের তরুণ-প্রবীণ নির্বিশেষে উচ্চাঙ্গসঙ্গীত শিল্পীদের পরিবেশনায় এরকম একটি উৎসব হলে আশাহত শ্রোতৃবৃন্দ অনেকখানি সান্তনা লাভ করবেনÑ এতে কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া বিদেশের অতিথি শিল্পীদের বাহুল্যে অনেক সময় দেশের গুণী শিল্পীরাও বাদ পড়ে যান। এবার তাদেরও সুযোগ করে দেয়া যেতে পারে। আরণ্যক নাট্যদলের সাড়ে চার দশক পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত ‘পুষ্প ও মঙ্গল’ শীর্ষক নাট্যোৎসবে ভারত ছাড়াও ইরানসহ কয়েকটি দেশের নাট্যদল যোগ দিয়েছিল। তাদের পরিবেশিত নাটক ঢাকার দর্শকরা বেশ উপভোগ করেন। আশির দশকের শুরুর দিকে তরুণ বয়সে আরণ্যকে যোগ দিয়ে ‘ওরা কদম আলী’, ‘ইবলিশ’, ‘গিনিপিগ’সহ বেশ কিছু নাটকে অভিনয় করেছি। দলটির একটি আদর্শ রয়েছে। তাদের স্লোগান- নাটক শুধু বিনোদন নয়, শ্রেণি সংগ্রামের সূতীক্ষ্ম হাতিয়ার। নাট্যকর্মী বন্ধুদের এই উৎসবে সংহতিজ্ঞাপন ও শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে ‘ময়ূর সিংহাসন’ নাটকের অংশবিশেষ দেখে মনে হলো এতগুলো বছর ধরে আরণ্যক তার আদর্শ লালন করে আসছে নিষ্ঠার সঙ্গেই। মামুনুর রশীদ, মান্নান হীরারা এখনও দাপুটে মঞ্চাভিনেতা। বহু তরুণ মুখ মঞ্চ আলোকিত করে চলেছে। বহু প্রতীক্ষিত মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভার ঢাকার রাস্তায় যানবাহনের গতি এখন ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারে নেমে এসেছে। ২০২৫ সাল নাগাদ তা চার কিলোমিটারে নেমে আসতে পারে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী এখন যানজটে দৈনিক গড়ে ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ২০২৫ সাল নাগাদ অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেক আগে থেকেই পরিকল্পিতভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, তা হয়নি। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পরই বলা যায়, ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন কিছুটা গতি পেয়েছে। গত সাড়ে আট বছরে ছয়টি বড় ফ্লাইওভার ও ওভারপাস চালু হয়েছে। একটি মেট্রো রেল, একটি বিআরটি ও দুটি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ এগিয়ে চলেছে। নির্মাণ কাজের জন্য মানুষকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সে কারণে মানুষ সাময়িকভাবে কিছু ক্ষোভ প্রকাশ করলেও দীর্ঘ মেয়াদের সুফল বিবেচনায় তারা সেই ভোগান্তি মেনেও নিচ্ছে। পাঁচটি পথে হবে মেট্রো রেল, ছয়টি পথে হবে এক্সপ্রেসওয়ে এবং দুটি পথে হবে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি। বর্তমানে উত্তরা থেকে পল্লবী হয়ে মতিঝিল পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেলপথের কাজ এগিয়ে চলেছে। এরই মধ্যে ১০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর, গুলিস্তান হয়ে ঝিলমিল পর্যন্ত বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি-৩ প্রকল্পের গাজীপুর অংশের কাজ এগিয়ে চলেছে। এ পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ হয়েছে ৯ শতাংশ। ২০২৫ সালের আগেই এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা যায়। আর তাতে ঢাকা হয়তো আবারও কিছুটা গতি ফিরে পাবে। সুদীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারটি চূড়ান্তভাবে চালু হলো বৃহস্পতিবার। শহরের যানজটপ্রবণ মালিবাগ-মগবাজার এলাকা দিয়ে ৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভারটি নির্ধারিত সময়ের প্রায় তিন বছর পরে শেষ হলো। ঢাকার প্রথম ফ্লাইওভার প্রকল্প ছিল খিলগাঁও ফ্লাইওভার। এরপর মহাখালী ফ্লাইওভার প্রকল্পের কাজ শুরু হয় এবং মহাখালী ফ্লাইওভারই প্রথম চালু হয়। সে হিসেবে মহাখালী ফ্লাইওভারই ঢাকার প্রথম ফ্লাইওভার। এরপর খিলগাঁও এবং তেজগাঁও ফ্লাইওভার চালু হয়। নকশায় ত্রুটি এবং ফ্লাইওভারের দৈর্ঘ্য বাড়ানোর কারণে মালিবাগ-মগবাজার ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ অনেক দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং খরচও বেড়েছে। এনিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। তিন ভাগে মৌচাক-মগবাজার ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ করা হয়েছে। একটি অংশে রয়েছে সাতরাস্তা-মগবাজার-হলি ফ্যামিলি পর্যন্ত, আরেকটি অংশ শান্তিনগর-মালিবাগ-রাজারবাগ পর্যন্ত এবং শেষ অংশটি বাংলামোটর-মগবাজার-মৌচাক পর্যন্ত। ২০১৬ সালের ৩০ মার্চ এ ফ্লাইওভারের হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল থেকে সাতরাস্তা পর্যন্ত অংশ উন্মুক্ত করা হয়। এরপর ওই বছরেরই ১৫ সেপ্টেম্বর এ ফ্লাইওভারের ইস্কাটন- মৌচাক অংশ খুলে দেয়া হয়। সর্বশেষে চলতি বছরের ১৭ মে এফডিসি মোড় থেকে সোনারগাঁও হোটেলের দিকের অংশটি যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। জনকণ্ঠ ভবনের সপ্তম ফ্লোরে সম্পাদকীয় ও ফিচার বিভাগ। আমার কক্ষটি থেকে সদ্য চালু হওয়া উড়াল সড়কের ইস্কাটন প্রান্তের যান চলাচল ভালোভাবে দেখা যায়। শনিবারে ঢাকায় বহু অফিস বন্ধ। তাই এদিন যানবাহনের বাহুল্য থাকবে না ভেবেছিলাম। কিন্তু দেখলাম প্রান্তটিতে দিনভরই থেমে থাকা ব্যক্তিগত গাড়ির সারি, ওপর থেকে নিচে নামার অপেক্ষায়। কখনো কখনো এই সারি দীর্ঘতর হচ্ছে। ঢাকায় প্রথম চালু হওয়া মহাখালি ফ্লাইওভারের যানজটে সর্বোচ্চ এক ঘণ্টা বসে থাকারও অভিজ্ঞতা হয়েছে। মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভার যাতায়াতে কতোটা ভোগান্তি কমাবে সেটা আগামী কয়েক মাসেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। গাড়ির সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং সিঙ্গাপুরের মতো জোড় ও বেজোড় সংখ্যার নম্বর প্লেটযুক্ত গাড়ির ভিন্ন ভিন্ন দিবসে চলাচল নির্দিষ্ট করা হলে হয়তো ঢাকা এই যানজটের অসহনীয় চাপ থেকে রেহাই পাবে। জাকার্তায় এমন নিয়মও রয়েছে যে তিনজন আরোহীর চেয়ে কম আরোহী নিয়ে রাস্তায় নামলে সড়ক কর্তৃপক্ষকে বিশেষ ফি দিতে হয়। বিষয়টি উদ্বেগজনক রাজধানীতে বেওয়ারিশ কুকুর নিধন কার্যক্রম কি বন্ধ রয়েছে? তা না হলে রাস্তাঘাটে এখন বেশি কুকুর দেখা যাচ্ছে কেন? বিষয়টি উদ্বেগজনক। কাগজেও দেখলাম কুকুরের কামড় ও আক্রমণে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে। আবার সময়মতো জলাতঙ্কের টিকা গ্রহণ না করার কারণে অকাল মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। মহাখালী সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, রাজধানী ও এর আশপাশের এলাকায় গত নয় মাসে কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়ে শুধু এই প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন অর্ধ লক্ষাধিক রোগী। বিগত পাঁচ বছরে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নেওয়া এ ধরনের রোগীর সংখ্যা নাকি প্রায় সাড়ে তিন লাখ! তার মধ্যে ৪৫০ জন মারাও গেছেন। তাই বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ভবিষ্যতে ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়ার আশঙ্কা অমূলক নয়। এখন বেওয়ারিশ কুকুরের উপদ্রব বেড়ে গেলেও নিষ্ঠুর কায়দায় তাদের নিধন করা হয় না। উচ্চ আদালত ২০১২ সালে এ ধরনের অমানবিক আচরণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। তবে পরিতাপের বিষয় হলো বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে পথের কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তাও বিগত বছরগুলোয় যথাযথভাবে কার্যকর করা যায়নি। এর জন্য দায়ী কে? সিটি করপোরেশনের অনীহা? পথের কুকুরের পাশাপাশি ঘরে পোষা কুকুরের কথা বলা দরকার। উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মানুষদের মধ্যে বিদেশী কুকুর পোষার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। সেসব কুকুরকে টিকা দেয়া ছাড়াও স্বাস্থ্য পরিচর্যা করা হয় ধরের লোকেদের সুস্বাস্থ্য রক্ষার তাগিদেই। তবে সেসব কুকুরকে যখন ঘরের বাইরে বের করা হয়, তখন ওই প্রাণীগুলোকে কিছুটা ভয়ঙ্কর দেখায়, তাদের হাবভাবও পথচারীদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। ভাগ্যিস বকলেসে বাঁধা এইসব কুকুর যারা নিয়ন্ত্রণ করেন তারে কঠোর সাবধানতাই পথচারীদের বড় বিপদ থেকে বাঁচায়। যাহোক, ঘরের পোষা সারমেয় হোক, কিংবা বেওয়ারিশ কুকুরই হোক, জলাতঙ্ক রোগের হাত থেকে বাঁচার একটাই পথ, ওই প্রাণীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। বিশেষ করে বেওয়ারিশ কুকুরের সংখ্যা যাতে মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, আর পথেঘাটে তারা যেন ভয়ঙ্কর না হয়ে ওঠে- সেসব দেখবার কর্মী থাকা চাই। ভাঙনের সাক্ষী হলো ঢাকা ১৯০৯ সালে নির্মিত হয় ভবনটি। পরিচিতি ছিল ল্যাবরেটরি ভবন হিসেবে। এর স্থাপত্যশৈলীও নজরকাড়া। প্রতœতত্ত্ব অধিদফতরের সংরক্ষিত ভবনের তালিকাভুক্ত ছিল না এটি। সম্প্রতি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে স্থাপনাটি। খামারবাড়ি এলাকায় বিশাল সবুজ প্রাঙ্গণের মাঝে লাল ইটের দোতলা এই কৃষি গবেষণা ভবনটির প্রতি তলার মেঝের আয়তন সাড়ে সাত হাজার বর্গফুটের মতো। ১৩ ফুট উঁচু সিলিংয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বড় বড় দরজা, শেড দেওয়া জানালা, চওড়া বারান্দা। বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাধারণ সম্পাদকের মতে: একদিকে বাংলায় কৃষি গবেষণার সূত্রপাত ও ক্রমবিবর্তনের সাক্ষী এই ভবনটি। অন্যদিকে ভবনটির স্থাপত্যশৈলী ও প্রকাশভঙ্গি পূর্ব বাংলা ও ইউরোপের এক অনবদ্য সংমিশ্রণ। শনিবার ভবন ভাঙার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে আরবান স্টাডি গ্রুপ ও বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)। ২৯ অক্টোবর ২০১৭ [email protected]
×