ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

’৪২ সাল নাগাদ মানব মূলধন সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিতে সরকার বদ্ধপরিকর

এবারের শিশু বাজেট বাস্তবায়ন শুরু ॥ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৩০ অক্টোবর ২০১৭

এবারের শিশু বাজেট বাস্তবায়ন শুরু ॥ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের পরিকল্পনা

এম শাহজাহান ॥ মানব মূলধন গঠনে শিশু বাজেট বাস্তবায়নে সবচেয়ে বেশি জোর দেয়া হচ্ছে। ‘বিকশিত শিশু : সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ স্লোগান সামনে রেখে চলতি বাজেটে ৫৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এর আওতায় দারিদ্র্যমুক্ত পরিবেশে শিশুর বেড়ে ওঠা, দীর্ঘস্থায়ী ও স্বল্পকালীন পুষ্টিহীনতা রোধ, উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরেপড়া নিয়ন্ত্রণ, বাল্যবিবাহ, নিপীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে ১৩ মন্ত্রণালয়কে সম্পৃক্ত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে শিশু বাজেট বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়গুলো কাজ শুরু করেছে। জানা গেছে, দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে কর্মক্ষম অংশের অনুপাত সর্বোচ্চ পর্যায়ে পেঁছবে ২০৪২ সাল নাগাদ। জনমিতির এই সুবিধার পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করতে হলে আজকে যে শিশু জন্ম গ্রহণ করবে তার দিকে সবচেয়ে বেশি যতœবান হতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। শিশুরা আগামী দিনের ভবিষ্যত, আগামী দিনে জাতির কা-ারী। তাই এ সময় থেকেই তাদের গড়ে উঠতে হবে। যেতে হবে বহুদূর। ইতোমধ্যে শিশু উন্নয়নে নানা ধরনের প্রশাসনিক ও আইনী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে শিশু আইন-২০১৩ এবং জাতীয় শিশুনীতি ২০১১ অন্যতম। এছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘের কনভেনশন অন রাইটস অব চিল্ড্রেন অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এই অনুমোদনের ফলে শিশু রক্ষায় দেশে যেসব আইন করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের পথ সুগম হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তথ্যমতে, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ শিশু। শিশুদের সমতা ও বৈষম্যহীন পরিবেশে যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার ওপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যত। শিশু উন্নয়ন সহায়ক সুযোগ-সুবিধা আবার নির্ভর করছে একটি রাষ্ট্রীয় নীতি কাঠামো ও আর্থিক ব্যবস্থাপনার ওপর। সে কারণে শিশুদের উদ্দেশে করা শিশুসংক্রান্ত নীতি, আইন ও প্রবিধির উদ্দেশ্য পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের বিষয়টি নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জানিয়েছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এবং আমাদের রূপকল্প ও কৌশলগত পরিকল্পনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে শিশুদের আমাদের কর্মকান্ডের কেন্দ্রে রাখতে হবে। এ কথা সত্যি যে, কোথায় এবং কিভাবে শিশুরা দারিদ্র্য, দীর্ঘস্থায়ী ও স্বল্পকালীন পুষ্টিহীনতা, উচ্চ মাধ্যমিকে ঝরেপড়া, বাল্যবিবাহ, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এবং মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তা বুঝতে আমরা কঠোর পরিশ্রম করছি; যাতে রাষ্ট্রযন্ত্র যথাযথ নীতিমালা প্রয়োগ করতে পারে। এ কারণে শিশু উন্নয়নে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। বাস্তবায়ন করা হচ্ছে শিশু বাজেট। তিনি বলেন শিশু সুরক্ষা, কল্যাণ ও বিকাশে বাড়বে সরকারী বিনিয়োগ। শিশুর প্রারম্ভিক যত্নে বিনিয়োগের সামাজিক রিটার্ন বেশি হওয়ায় তা দারিদ্র্য বৈষম্য হ্রাসে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখছে। তাই লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বাজেট বাস্তবায়নে কাজ করা হচ্ছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ পাঁচ বছরের নিচের শিশু মৃত্যু হ্রাসে ব্যাপক সফল্য অর্জন করেছে। নবজাতকের মৃত্যুহার ৫ বছরের নিম্নে মোট শিশুমৃত্যুও ৬০ ভাগ। বাংলাদেশ জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্য জরিপ (২০১১) অনুযায়ী নবজাতকের মৃত্যুহার প্রতি হাজারে ৩২ এবং অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ গর্ভকালীন শ্বাসরোধ ২১ ভাগ, পচন জনিত ২৪ ভাগ এবং অপরিপক্ক কম ওজনে জন্মগ্রহণকারী নবজাতক ১১ ভাগ যার অধিকাংশ নিরাময়যোগ্য। গবেষণা থেকে এটি প্রমাণিত যে, উচ্চমানের শিশুযতœ এ ধরনের মৃত্যু এড়াতে সহায়তা করে। জেলা হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসমূহে চালু স্পেশাল কেয়ার নিউবোন ইউনিট (স্ক্যানু) গুরুতর অসুস্থ নবজাতকের চিকিৎসায় কার্যকর মডেল। এখন পর্যন্ত দেশের ৩৮ জেলায় ৪২ স্ক্যানু স্থাপন করা হয়েছে। এই বছরের মধ্যে আরও তেরোটি নতুন স্ক্যানু বিভিন্ন পর্যায়ের হাসপাতালে স্থাপন প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া স্ক্যানু সেবা পর্যায়ক্রমে সকল জেলায় সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে, সরকারী বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে মাতৃমৃত্যু হার ১৯৮০ সালের চেয়ে ৭৫ শতাংশ কমানো সম্ভব হয়েছে। একই সময়ে শিশুমৃত্যু হার কমেছে ৪ গুণের বেশি। চরম দারিদ্র্য কমে দাঁড়িয়েছে ১২ দশমিক ৯ শতাংশে এবং ২০১৫ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির হার পৌঁছেছে ৯৮ শতাংশে। কিছু সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ অধিকাংশ নিম্ন আয়ের এবং মধ্য আয়ের দেশের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তবে শিশুরা যেসব কঠিন বিষয়ের সম্মুখীন হচ্ছে তা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম, বাল্যবিবাহ, উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবার অভাব, অপুষ্টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ার হার, সহিংসতা ও নির্যাতন। এসব ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য নীতিনির্ধারণী মহলকে সদা মনোযোগী থাকা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৩ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের জন্য ৫৬ হাজার কোটি টাকার পৃথক শিশু বাজেট বাস্তবায়নের কাজ এগিয়ে চলছে। চলতি বাজেটে মন্ত্রণালয়-বিভাগ বেড়েছে ছয়টি। গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরের চেয়ে বরাদ্দ বেড়েছে ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ শিশুকেন্দ্রিক বাজেট ৪৬ হাজার কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৬ হাজার কোটি টাকায়, প্রবৃদ্ধির হার হিসেবে যা ২১ দশমিক ৪ শতাংশ পর্যন্ত। চলতি বাজেটে ছয়টি মন্ত্রণালয় ও সাতটি বিভাগের জন্য পৃথক শিশু বাজেট দেয়া হয়। এ বছর গুরুত্বপূর্ণ দুটি মন্ত্রণালয়কে শিশু বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়: তথ্য মন্ত্রণালয় এবং শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এ বছর শিশু বাজেটে অন্তর্ভুক্ত নতুন বিভাগ হলো-জননিরাপত্তা বিভাগ এবং আইন ও বিচার বিভাগ। অন্যদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগকে এ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগকে শিশু বাজেট দেয়া হয়েছে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভা হলো প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় সরকার বিভাগ। এদিকে, শিশু কল্যাণে সরকার আন্তরিক হলেও শিশুর প্রতি নৃশংসতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, শিশুহত্যা প্রতিরোধের আহ্বান এখন সব মহলে জোরদার হচ্ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) এক জরিপে বলা হয়, দুই-তৃতীয়াংশ শিশুকে মা-বাবা মারধর করেন। ৭৪ দশমিক ৪ শতাংশ শিশুকে মানসিক চাপ দিয়ে শৃঙ্খলা শেখানো হয়। শিশু অধিকার ফোরামের এক হিসেবে দেখা গেছে, সাড়ে তিন বছরে ৭৭৭ শিশু নির্যাতনে মারা গেছে। শিশুহত্যা একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুর কল্যাণে বর্তমান সময়ে ব্যয়িত অর্থ বা বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদে মানবসম্পদ সৃষ্টি করে যা অর্থনীতিকে প্রতিযোগিতামূলক উৎকর্ষতার দিকে এগিয়ে নেবে। শিশুর জন্য আরও সুপরিকল্পিত বাজেট প্রয়োজন ॥ শিশু বিশেষজ্ঞ, এ্যাক্টিভিস্ট এবং শিশু অধিকার সংরক্ষণ ও বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ভবিষ্যতের সুনাগরিক তৈরির লক্ষ্যে শিশুর জন্য সুনির্দিষ্ট ও সুপরিকল্পিত বাজেট বরাদ্দ ও বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ, সেভ দ্য চিলড্রেন, ইউনিসেফ, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও শিশু একাডেমি ইতোমধ্যে শিশুর জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি তা বাস্তবায়নের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। এসব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান থেকে বলা হচ্ছে শিশুর কল্যাণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে একটি সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। এ বাজেট বাস্তবায়নে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনাও গ্রহণ করা প্রয়োজন। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি সেমিনারে মহিলা শিশুবিষয়ক মন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি, চলতি অর্থবছরের জন্য শিশু বাজেট প্রণয়ন ও বরাদ্দ বৃদ্ধিকে একটি শুভ সূচনা হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি ‘স্ট্রেংথেনিং ক্যাপাসিটি ফর চাইল্ড ফোকাস বাজেটিং ইন বাংলাদেশ’ (এসসি-সিএফবি) প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে বলেন, শিশু বাজেট প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের জন্য একটি অপারেশনাল গাইডলাইন তৈরি করতে অর্থ মন্ত্রণালয় এ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ইউনিসেফ ও সেভ দ্য চিলড্রেনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে। তিনি বলেন, একটি পূর্ণাঙ্গ অপারেশনাল গাইডলাইন সম্পন্ন হলেই বাংলাদেশে শিশু বাজেটের সঠিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।
×