ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

৩ ঘণ্টা পর ঢামেকে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হল

প্রকাশিত: ০২:২০, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

৩ ঘণ্টা পর ঢামেকে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক রোগীর মৃত্যু নিয়ে তুলাকালাম কান্ড ঘটেছে। এই ঘটনার প্রতিবাদে চিকিৎসকরা জরুরী বিভাগে গেট বন্ধ করে দেয়। সেখানে আনসার সদস্যদের পাহাড়া বসানো হয়। এতে প্রায় তিন ঘন্টা চিকিৎসা সেবা বন্ধ ছিল। এ সময় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহর থেকে রোগীরা আসলেও ভর্তির টিকিট কাউন্টার বন্ধ থাকায় চরম দূভোর্গে পড়তে হয় রোগীর স্বজনদের। অনেক রোগী দালালদের খপ্পড়ে বাইরের ক্লিনিকে চিকিৎসা সেবা নেয়। তুচ্ছ এই ঘটনায় দেশের বৃহৎ এই চিকিৎসা সেবা কেন্দ্র প্রায় তিন ঘন্টা চিকিৎসা সেবা অচল হয়ে পড়ে। এদিকে সংঘর্ষে তিন চিকিৎসক, চার আনসার সদস্যসহ প্রায় দশজন আহত হয়েছে। ঘটনার পর পুলিশ রোগীর তিন স্বজনকে আটক করেছে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কেএম নাসিরউদ্দিন আহমেদ জানান, রোগীর স্বজনদের সঙ্গে চিকিৎসকদের হাতাহাতির ঘটনায় তিন ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর আবার চালু হয়েছে। চিকিৎসকদের নিরাপত্তার কারনে জরুরী বিভাগে গেট বন্ধ করা হয়েছে। রবিবার দুপুর ২টা ১০ মিনিট থেকে বন্ধ থাকা জরুরি বিভাগ আবার চালু হয় বিকাল ৫টার দিকে। তিনি জানান, চিকিৎসক ও আনসার সদস্যদের মারধরের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের বিরুদ্ধে মামলার প্রক্রিয়া চলছে। আগামীতে চিকিৎসকদের ওপর হামলা ও নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হবে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হৃদরোগে আক্রান্ত নওশাদ (৫২) ঢামেক হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) চিকিৎসাধীন ছিলেন। রবিবার দুপুর দেড়টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় নওশাদের মৃত্যু হলে তার স্বজনরা চিকিৎসকদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে উভয়ের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারি ঘটনা ঘটে। পরে সংঘর্ষে রূপ নেয়। রোগীর স্বজনের হামলায় কর্তব্যরত চিকিৎসক ডঃ শামিমুর রহমান, শাওন ও সায়েম নামে তিনজন আহত হয়। এতে বাদল, শাহআলমসহ চারজন আনসার সদস্য আহত হয়। ঘটনাস্থল হাসপাতালের ২ এর করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) সংঘর্ষে থামাতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ভবনের ওয়ার্ড মাষ্টার মোঃ রিয়াজ উদ্দিন ও ভারপ্রাপ্ত সর্দার রমিউদ্দিন আহত হয়। চিকিৎসকদের হামলায় রোগীর স্বজনদের মধ্যে দু’জন আহত হয়েছে। খবর পেয়ে হাপসাতালে পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কে এম নাসিরুদ্দিন ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন আনেন। এ সময় শাহবাগ থানা পুলিশ রোগীর তিনজনকে আটক করে থানায় নিয়ে যায়। সংঘষের্র আশংকায় জরুরী বিভাগের আশপাশে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পরে হাসপাতালের পরিচালক চিকিৎসক নেতা ও কয়েকজন ইন্টার্নি চিকিৎসকদের নিয়ে তার রুমে ডেকে নিয়ে যান। সেখানে জরুরী বৈঠকে বসেন। বিকেল ৫টায় বৈঠক শেষে জরুরী বিভাগের গেট খুলে দেয়া হয়। আস্তে আস্তে চিকিৎসা সেবা সচল হতে থাকে। ওয়ার্ডগুলো চিকিৎসকরা তাদের চিকিৎসা সেবা শুরু করে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দুপুর ২টায় পরিস্থিতি যখন নিয়ন্ত্রনে তখন কয়েক ইন্টার্নি চিকিৎসক, নার্স ও বাদ্রার মিলিত হয়ে হাসপাতালের সমস্ত চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে। আধাঘন্টা পর তারা জরুরী বিভাগে মূল গেট ও রোগী ভর্তি কাউন্টার বন্ধ করে দেয়। এ সময় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা প্রায় শতাধিক গুরুতর অসুস্থ্য রোগী হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা থাকতে হয়। এদের মধ্যে অনেকে রোগী দালালদের খপ্পড়ে পড়ে বাইরে ক্লিনিকে চলে যেতে হয়। ঢামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, জরুরী বিভাগে গেট ও ভর্তি টিকিট কাউন্টার বন্ধ থাকায় অনেক রোগীর স্বজনরা বহু আকুতি বিনতি করে চিকিৎসকদের মন গোলাতে পারেননি। ‘ভাই রোগীরে ভর্তি করান, দেরি করাইয়েন না, নইলে রোগী বাঁচবো না। অনেক দূর থেকে আসছি। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে এভাবেই অন্তঃসত্ত্বা ঝুমুর মামা জাকির হোসেন চিৎকার আর কান্না করে বলছিলেন। তার ভাগ্নি অন্তঃসত্তা ব্যাথার যন্ত্রনা কাতরাচ্ছিলেন। এমনকি ঝুমু কিডনি ও ডায়াবেটিস রোগেও আক্রান্ত। ঝুমুকে পটুয়াখালী সদর হাসপাতাল থেকে ঢামেক হাসপাতালে আনা হয়েছে। কিন্তু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কোনো রোগীকে ভর্তি নিচ্ছে না। খুব বিপাকে পড়েছি। এ সময় অন্তঃসত্ত্বা ঝুমুর মামা জাকির হোসেন জানান, আমরা এখন এ রোগী নিয়ে কোথায় যাবো? তারা আমাদের কষ্ট বুঝতেছে না। শুধু ঝুমুরের স্বজন নয়। এরকম প্রায় শতাধিক রোগী ও তাদের স্বজন ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে অবস্থান নিলেও রোগীদের হাসপাতালে ভর্তি করছে না কর্তৃপক্ষ। বিক্রমপুর-মুন্সিগঞ্জ ভবেরচর থেকে শ্বশুর আবদুল কাদিরকে নিয়ে এসেছেন জামাতা তোফাজ্জল হোসেন। তিনি বলেন, তিনদিন ধরে প্রস্রাব-পায়খানা বন্ধ। মুন্সিগঞ্জে চিকিৎসা না পেয়ে ঢামেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে এলাম। কিন্তু ভর্তি নিচ্ছে না। রোগীর অবস্থা বেগতিক। তোফাজ্জলের স্ত্রী পারভীন বলেন, ওনার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমরা বাবা ঝুটঝামেলা বুঝি না। চিকিৎসা নিতে এসে এমন বিপাকে পড়বো বুঝিনি। নারায়ণগঞ্জ আড়াইহাজার এলাকা গর্ভবতী মেয়েকে নিয়ে এসেছেন মা আলেয়া। তিনি কান্নাকাটি করে বলেন, প্রসব বেদনা উঠেছে। মেয়ের খুব কষ্ট হচ্ছে। ভর্তি করা জরুরি। কিন্তু ভর্তি নিচ্ছে না। আল্লাহ জানে মেয়ে ও ওর অনাগত সন্তানের কী হবে? কুমিল্লা থেকে আসা ডায়রিয়া রোগী আসমা বেগমের বেহাল দশা হলেও হাসপাতালে জায়গা হচ্ছে না। ছেলে শামীম জানান, মায়ের অবস্থা খারাপ কিন্তু রোগীকে এ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাতে দিচ্ছে না। ঢামেক হাসপাতালের সামনে আরও দেখা যায়- কিশোরগঞ্জ পাকুন্দিয়া থেকে আসা মানসিক রোগী পলি আক্তার সিএনজিতেই বসে আছেন, মামা মাহবুবুল ছুটোছুটি করছেন। কিন্তু রোগীকে ভেতরে ঢুকতেই দিচ্ছেন না আনসার সদস্যরা, বন্ধ টিকেট বিক্রিও। সেখানে আরও দেখা যায়- মানিকগঞ্জের শিবালয় থানার বতুনী গ্রামের মন্টু মিয়াকে। ফুলবাড়িয়ায় অজ্ঞানপার্টির খপ্পড়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। তাকে ঢামেক হাসপাতালে আনেন বিয়াই মোসলেম। তারও ভর্তির ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। এরপর তাকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যায় স্বজনরা। এ ঢামেক শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও নাক-কান গলা বিভাগের প্রধান প্রফেসর ইউসুফ ফকির জানান, চিকিৎসকদের মারধরের ঘটনায় নিরাপত্তার কারনে সাময়িক চিকিৎসা বন্ধ করেছে ইন্টানরা। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জরুরি বৈঠকে শেষে বিকেল ৫টায় ইর্ন্টান চিকিৎসকরা তাদের চিকিৎসা সেবা শুরু করেছে। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির এস আই বাচ্চু মিয়া জানান, হাসপাতালের পরিচালকের কক্ষে ডাক্তার ও স্বজনদের নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ওখান থেকে সিদ্ধান্ত আসার পর বিকাল ৫টার দিকে জরুরি বিভাগ খুলে দেয়া হয়েছে। এখন রোগীরা চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে। শাহবাগ থানার ওসি আবুল হাসান জানান, চিকিৎসকদের ওপর হামলার ঘটনায়, ঘটনাস্থল থেকে রোগীর তিন স্বজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত করা হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
×