ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল হিসাব

প্রকাশিত: ০৬:১১, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

পুঁজিবাজারে ব্যাংকের বিনিয়োগ নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভুল হিসাব

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ পুঁজিবাজারে ব্যাংক ও তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ বিষয়ে ভুল হিসাব করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাণিজ্যিক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধনকে মূল ব্যাংকের বিনিয়োগ হিসাব থেকে অব্যাহতি দেয়ার পরও কৌশলে তা অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। আর এ কারণে মূল ব্যাংকের বিনিয়োগ না বাড়া সত্ত্বেও অনেকগুলো ব্যাংকের এক্সপোজার লিমিট ছাড়িয়ে যায় তা। এর বাইরে বাজারমূল্যে হিসাব গণনার বিষয়তো রয়েছেই। পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের দীর্ঘদিনের দাবির মুখে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর মাসে এক প্রজ্ঞাপনে ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানির মূলধনকে ব্যাংকের পুঁজিবাজার এক্সপোজার থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এতে বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। বাজার কিছুটা গতিশীল হয়ে উঠে। কিন্তু চলতি বছরের শেষ ভাগে হঠাৎ করেই আগের অবস্থান থেকে সরে আসে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগের প্রজ্ঞাপনটি বহাল থাকা সত্ত্বেও সাবসিডিয়ারির মূলধনকে মূল ব্যাংকের এক্সপোজারে হিসাব করতে থাকে। এতে কয়েকটি ব্যাংকের এক্সপোজার নির্ধারিত সীমা ছাড়িয়ে যায়। উল্লেখ, বর্তমানে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তার রেগুলেটরি মূলধনের সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। রেগুলেটরি মূলধনের মধ্যে রয়েছে পরিশোধিত মূলধন, অবণ্টিত মুনাফা, প্রিমিয়াম আয় ও বিধিবদ্ধ সঞ্চিতি। আগে ব্যাংকগুলো তাদের আমানত ও দায়ের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ অর্থ পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত। নতুন নিয়মের কারণে এমনিতে তাদের বিনিয়োগ সক্ষমতা কমে গেছে। তার ওপর এক্সপোজার নির্ধারণে শুভঙ্করের ফাঁকি বিষয়টিকে নাজুক করে তুলেছে। জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিটি ব্যাংককে শেয়ার, বন্ড ও মিউচুয়াল ফান্ডে নিজের বিনিয়োগের পাশাপাশি সহযোগী প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগের তথ্য দিতে হয়। এর মধ্যে আছে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নিজের বিনিয়োগ ও গ্রাহকদের দেয়া মার্জিন ঋণ। আর এর মাধ্যমে কৌশলে সহযোগী প্রতিষ্ঠানের মূলধনকেই এক্সপোজারের মধ্যে নিয়ে আসা হচ্ছে। ধরা যাক, এবিসি সিকিসিউরিটিজ হচ্ছে এবিসি ব্যাংকের একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন ১০০ টাকা। প্রতিষ্ঠানটি তার ব্যবসার প্রয়োজনে বিভিন্ন উৎস থেকে ২০০ টাকা ঋণ নিয়েছে। সব মিলিয়ে এটি নিজস্ব পোর্টফোলিও ও গ্রাহকদের মার্জিন ঋণ হিসাবে ৩০০ টাকা বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসারে, এই ৩০০ টাকাকে মূল ব্যাংকের এক্সপোজারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। অথচ এর মধ্যে ১০০ টাকা ওই সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূলধন থেকে এসেছে, যা ২০১৫ সালের প্রজ্ঞাপন অনুসারে এক্সপোজারের বাইরে থাকার কথা। এক্সপোজার গণনার এই শুভঙ্করের ফাঁকির কারণে সম্প্রতি কয়েকটি ব্যাংক সমস্যায় পড়ে বলে জানা গেছে। আর এই ভুল হিসাবের ওপর ভিত্তি করে ৭টি ব্যাংককে সম্প্রতি জরিমানা করা হয়েছে। আরও কয়েকটি ব্যাংককে হয়ত জরিমানা করা হতো, কিন্তু পুঁজিবাজারে তীব্র প্রতিক্রিয়া হওয়ায় পিছিয়ে যায় বাংলাদেশ ব্যাংক। এমন অবস্থায় পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠানের পরিশোধিত মূরধন নয়, তাদের সব ধরনের বিনিয়োগকে মূল ব্যাংকের এক্সপোজার গণনার বাইরে রাখার দাবি জানিয়েছেন। পাশাপাশি তারা বাজারমূল্যের পরিবর্তে ক্রয়মূল্যে এক্সপোজার গণনারও দাবি করেছেন। কারণ একটি ব্যাংক যত টাকার বিনিয়োগ করে তত টাকাই তার ঝুঁকি। কিন্তু মার্কেট প্রাইসে এক্সপোজার গণনা করা হলে ঝুঁকি না বাড়া সত্ত্বেও অকারণে তাদের এক্সপোজার বেড়ে যায়। ধরা যাক, একটি ব্যাংক ২০ টাকা দরে ১০০০ শেয়ার কিনেছে। এতে ব্যাংকটির ২০ হাজার টাকা লেগেছে। বড়জোর এই ২০ হাজার টাকাই ব্যাংকটির ঝুঁকি। ব্যাংকটি শেয়ার কেনার কিছুদিন পর দাম বেড়ে ৩০ টাকা হলে মোট শেয়ারের বাজার মূল্য দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার টাকা। এই টাকার পুরোটা ব্যাংকের ঝুঁকি নয়। কারণ ১০ হাজার টাকা ব্যাংকটির মুনাফা। অথচ বাংলাদেশ ব্যাংক এই ৩০ হাজার টাকাকে পুঁজিবাজারের এক্সপোজারের অন্তর্ভুক্ত করছে। এতে বাজার একটু গতিশীল হলেই ব্যাংকগুলোকে শেয়ার বিক্রি করে বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারিত সীমার মধ্যে নিয়ে আসতে হয়। এতে বাজারে বিক্রির চাপ বাড়ে। বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘদিন শেয়ার ধারণ করবে-এমনটি সবাই আশা করলেও এই এক্সপোজারের খড়কের কারণে তারা তা পারে না। এ বিষয়ে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ব্রোকার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আহমেদ রশিদ লালী বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলো নিয়ন্ত্রক করুক সেখানে আমাদের কোন আপত্তি নেই। তবে আমরা চাই ব্যাংকগুলোর পুঁজিবাজারের বিনিয়োগ নিয়ে যাতে আইনের মধ্যে থেকে তারা কাজটি করুক। তিনি আরও বলেন, আইনে কিছু সমস্যা আছে, যেগুলে পরিবর্তন করার জন্য সংসদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ব্যাংক কোম্পানি আইনের ১২৩ ধারার ক্ষমতা বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটি করতে পারে। একই কথা বলেন বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স এ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি মোঃ ছায়েদুর রহমান। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক এমন কিছু কাজ করছে, যেটি আইনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। এটি নিয়ে ভুল বোঝাবুঝির হচ্ছে। এতে করে পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তিনি বলেন, সবগুলো ব্যাংক একদিনে আইন লঙ্ঘন করেনি। এভাবে ঢালাও করে প্রচার না করে, একটি সতর্কপত্র বা সময়ে সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মনিটরিংয়ে রাখলে নেতিবাচক প্রভাবটি বাজারে পড়ত না।
×