ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকল্প শহরে কর্মসংস্থান করতে হবে

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকল্প শহরে কর্মসংস্থান করতে হবে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ বাংলাদেশে টেকসই নগর উন্নয়নে কার্যকর ও দীর্ঘমেয়াদী নীতিমালা প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছেন নগর ও নগর ভাবনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশী-বিদেশী বক্তারা। তারা বলেন, নগরীর বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধির পাশাপাশি পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে তাদের নিজস্ব আয় বাড়াতে হবে। বড় শহরের ওপর চাপ কমাতে ছোট ছোট শহরেও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়ার ওপর জোর দিতে হবে। নগরীর সকল উন্নয়নই করতে হবে সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী। শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘সিটিস ফোরাম: বিল্ডিং নলেজ নেটওয়ার্ক এ্যান্ড পার্টনারশিপ ফর সাসটেনেবল আরবান ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক দু’দিনব্যাপী সেমিনারের প্রথম দিনে তারা এসব কথা বলেন। বিশ্বব্যাংক আয়োজিত এই অনুষ্ঠানের সার্বিক সহযোগিতায় ছিল মিউনিসিপ্যাল এ্যাসোসিয়েসন অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআই পি), বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট এবং সুইস এজেন্সি। অনুষ্ঠানে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার ৩ শতাধিক মেয়র অংশ নেন। সকাল দশটায় প্রথম দিনের অধিবেশন শুরু হয়ে চলে বিকেল সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। আজ রবিবার সকালেও একই সময় শুরু হবে দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন। অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, যে সকল মেয়র এখানে এসেছেন তারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। তারা তাদের নিজস্ব এলাকায় নিরন্তর পরিশ্রম করছেন। তারা বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছেন। তিনি বলেন, দুদিনের অনুষ্ঠানে দেশী- বিদেশী পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে অনেক সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার বিষয়ও উঠে আসবে। একইভাবে অভিজ্ঞতা বিনিময়ের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে নতুন পথও খুঁজে পাওয়া যাবে। শিরীন শারমিন বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা অগ্রগামী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই বাংলাদেশের অর্থনীতি অগ্রসর হচ্ছে। বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক সক্ষমতা রয়েছে তা দ্রুত নগরায়ণের ক্ষেত্রে সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম। স্থানীয় সরকার প্রশাসন এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা নগর উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখবে বলেও আশা করেন তিনি। শিরীন শারমিন বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের জন্য কাজ করছেন। ফলে আগামীর বাংলাদেশ আরও ভাল কিছু পাবে। আরও উন্নয়ন হবে। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, সমগ্র বাংলাদেশ থেকে আগত তিন শতাধিক মেয়র আজকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়েছেন। এই অনুষ্ঠান থেকে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মেয়রের বক্তব্য থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের মেয়ররা নিজেদের নগরেও তা কাজে লাগাবেন বলে আশা রাখেন স্পীকার। বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর কিমিআও ফান তার বক্তব্যে বলেন, শহরের খুব দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছে কিন্তু অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রতিরোধ করতে হবে। বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়নের জন্য আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে চাই। বাংলাদেশের ৫০ তম স্বাধীনতা দিবসে অবশ্যই বাংলাদেশে নিশ্চিত করতে হবে টেকসই শহরায়ন। অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, আমরা ঢাকা শহরের জন্য বিশ্বমানের পরিকল্পনা গ্রহণ করছি। উন্নত বিশ্বের সিটিগুলোর অভিজ্ঞতা আমরা কাজে লাগাচ্ছি। গত জুলাইয়ে আমরা বিশ্বব্যাংককে নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলাম সেখানে ঢাকার বিভিন্ন সমস্যা উঠে এসেছিল। আমরা সেগুলো সমাধানে কাজ করছি। এখানে বিভিন্ন দাতা সংস্থা আমাদের সহায়তা করছে। বিশ্ব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে; আমরাও বিশেষভাবে ঢাকাকে পরিচ্ছন্ন ও সুন্দর নগরী গড়তে কাজ করছি। মিউনিসিপ্যাল এ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি আব্দুল বাতেনের সভাপতিত্বে সেমিনারের উদ্বোধনী অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেন হলস্ট্যান। ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকল্প শহরে কর্মসংস্থান প্রয়োজন রাজধানী ঢাকার ওপর চাপ কমাতে বিকল্প শহরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্বব্যাংকের প্রধান নগর বিশেষজ্ঞ বালাকৃষ্ণ মেনন। তিনি বলেন, আমি ২০ বছর আগে ঢাকায় এসেছিলাম। সে সময় ঢাকার সমস্যা নিয়ে এক সেমিনারে কথা বলেছি। ওই সময়ও ঢাকার অধিক জনসংখ্যা একটি বড় সমস্যা ছিল। এবারও ঢাকায় এসে একই সমস্যার কথাই শুনেছি। তিনি বলেন, গত পাঁচ বছরে কর্মসংস্থানের সন্ধানে ঢাকায় ২০ লক্ষাধিক মানুষ এসেছে। তাই ঢাকায় জনসংখ্যার চাপ কমাতে অন্যান্য শহরে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি বলেন, ঢাকার জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা গেছে অনেক সময় ঢাকার সমস্যা সমাধানে অনেক ভুল পলিসি গ্রহণ করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত অতিথিদের উদ্দেশে বালাকৃষ্ণ মেনন বলেন, আমার চেয়ে আপনারা ভাল জানেন ঢাকায় ট্র্যাফিক সমস্যা, ড্রেনেজ ব্যবস্থার সমস্যাসহ বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে। অপরিকল্পিতভাবে শহর গড়ে ওঠার ফল হিসেবেই এসব সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে ঢাকাবাসীকে। তাই খুব দ্রুত সময়ের মধ্য ঢাকার বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে এর জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে হব। আর এর জন্য সঠিক নেতৃত্ব ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য স্থির করা প্রয়োজন। ঢাকার বিভিন্ন উন্নয়নের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আমি গুলশানে গেছি সেখানে খুব ছিমছাম রোড দেখতে পেলাম। আমি এদেশে নিউ থিংস দেখেছি। আশা রাখি, ২০ বছর পর ঢাকায় আজকের সমস্যা থাকবে না। নগরগুলোকে নিজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ বাংলাদেশের নগর উন্নয়নে সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে নিজস্ব আয় বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন বক্তারা। তারা বলেন, মেয়রদের নিজ দায়িত্বে পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশনের আয়ের খাত খুঁজে বের করতে হবে। তাহলেই অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে। অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় অধিবেশনে সিটি লিডারশিপ এ্যান্ড গুড গবর্নেন্স বিষয়ক আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন ক্লেমশন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জেমস এইচ স্পেনসার। এই অধিবেশনে নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভি বলেন, ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ২০ কিলোমিটার। আর এ কারণেই হয়ত এখনও নারায়ণগঞ্জের উন্নয়ন থমকে আছে। এটা আলোর নিচেই অন্ধকার থাকার মতো। তিনি বলেন, একেবারেই যে উন্নয়ন হয়নি তাও নয়, অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। উন্নত বিশ্বে যেখানে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা হয়েছে সব সময়। বাংলাদেশে হয়েছে তার উল্টা চিত্র। সব সময়ই চেষ্টা করা হয়েছে স্থানীয় সরকারকে দুর্বল করে রাখার। তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে সেই ধারণা পাল্টে দিয়েছে। স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায়নে কাজ করছে বর্তমান সরকার। আইভি বলেন, দেশের প্রতিটি নগরীর সম্যার ধরন ও চিত্র ভিন্ন। বাংলাদেশের সব মেয়রই প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করেন। সিটি কর্পোরেশন বিভিন্ন প্রকল্প জমা দিয়ে টাকা পাচ্ছে। সে তুলনায় পৌরসভা খুব কম টাকা পায়। তবে আগের চেয়ে অনেকটাই টাকা বাড়ানো হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা স্বাবলম্বী হতে চাই সড়ক জনপদ, রেলসহ অন্যান্য খাস জমি আমাদের ব্যবহারের জন্য দেয়া হোক। যাতে আমরা জমিগুলো ভাড়া দিতে পারি ও উন্নয়নে ব্যবহার করতে পারি। তিনি বলেন, গুড গবর্নেন্স হতে হলে শুধু আয় বাড়ালেই হবে না আমাদেরও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। তিনি এমসয় পৌরসভাগুলোতে সরাকারের বাজেট বৃদ্ধির জন্য অনুরোধ করেন। এই অধিবেশনে ফিলিপিন্সের মেয়র মেল সেনেন এস সারমিনতো বলেন, মেয়রদের উচিত সুশাসন নিশ্চিত করা এবং উন্নয়ন তরান্বিত করতে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা। এসময় তিনি ফিলিপিন্সের অবস্থা তুলে ধরে বলেন, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার মত দেন। যুক্তরাষ্ট্রের সল্টলেক সিটির মেয়র রালফ বেকার বলেন, বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা ভিন্ন। আমরা বিকেন্দ্রীকরণ ক্ষমতার চর্চা করি। প্রতিনিয়ত আমাদের কাছে অনেক লোক আসে অসংখ্য সমস্যা নিয়ে। আমাদের কাজ হলো কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে তার প্রতিকার করা। তিনি বলেন, আমার শহর কিভাবে গতিশীল করব আমরা সেই লক্ষ্যে কাজ করি। আমি মনে করি এটা বাংলাদেশেও প্রযোজ্য। আমরা আমাদের শহরের সর্বত্রই যোগাযোগের আওতায় এনেছি। আমাদের শহরে যখন মন্দা চলছিল, কর আদায় হচ্ছিল না তখন আমরা ব্যবসায়ীদের আহ্বান জানাই। তাদের বিনিয়োগ করতে বলি। ব্যবসায়ীরা আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বিনিয়োগ করলে মন্দা কেটে যায়। তাই প্রতিটি সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভাকে তাদের নিজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে হবে। এই অধিবেশনে বক্তব্য রাখেন ঝিনাইদহ পৌরসভার মেয়র সাইদুল করিম মিন্টু। তিনি তার পৌরসভার বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মসূচী তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমরা পৌরসভায় যে উন্নয়ন কর্মকা- পরিচালনা করি তার বেশিরভাগ অর্থই নিজস্ব আয় থেকে। আমরা পৌর এলাকায় উন্নয়ন কাজে স্থানীয়দের সংযুক্ত করেছি। তিনি আরও বলেন, নিজস্ব আয় বাড়ানোর জন্য আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে এলাকায় ঘুরে বেরিয়েছি। তখন দেখলাম বিভিন্ন বাড়ির ছাদে বিলবোর্ড রয়েছে। অথচ এসব বিলবোর্ডের জন্য পৌরসভায় কর পাওয়ার কথা। আমরা বিলবোর্ডের করও বাড়িয়েছি। এই খাতে বছরে ৩০ হাজার টাকা থেকে আয় বৃদ্ধি করে ৩৫ লাখে এনেছি। প্রতিটি মেয়রই যদি নিজের এলাকায় ঘুরে একটু খোঁজ করেন তাহলে পৌরসভার নিজস্ব আয় বাড়াতে পারবেন। দিনের শেষ অধিবেশনে শহর পরিকল্পনা ও টেকসই অবকাঠামে বিষয়ে আলোচনা হয়। এই অধিবেশনে বক্তারা বলেন, বাংলাদেশে নগর উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা নেই। পৌরসভার নিজস্ব আয় কম। পৌরসভার মোট ব্যয়ের ৩২ থেকে ৩৫ শতাংশ তারা বহন করতে পারে। বাকি অর্থের জন্য সরকার ও দাতা সংস্থার দিকে চেয়ে থাকতে হয়। শেষ সেশনের সভাপতিত্ব করেন বিশ্বব্যাংকের ইভারজেলিন কিম কুইনসো। বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের প্রফেসর ড. আখতার মাহমুদ, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর রবার্ট কারবেরো। অনুষ্ঠানে আগত মেয়রদের পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার আবেদন জানানো হয়। তারা বলেন স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে হবে। তাদের জন্য বাজেট বাড়াতে হবে। পৌরসভাগুলোয় যেন নিজস্ব আয়ের ব্যবস্থা থাকে সে জন্য ব্যবস্থা করতে হবে।
×