ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রভাবশালী মুসলিম বিশ্বের জোরালো অবস্থান নেই

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

প্রভাবশালী মুসলিম বিশ্বের জোরালো অবস্থান নেই

তৌহিদুর রহমান ॥ রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে মুসলিম দেশগুলোর জোরালো কোন অবস্থান নেই। বিশ্বের অধিকাংশ মুসলিম দেশ এই ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে কোন উদ্যোগ নেয়নি। বেশিরভাগ মুসলিম দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে শুধু বক্তৃতা ও বিবৃতি প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকেছে। তবে রোহিঙ্গা সঙ্কটে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, জর্দান, মালদ্বীপ জোরালো অবস্থান নিয়েছে। এদিকে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমধানে মুসলিম দেশগুলোর আরও জোরালো ভূমিকা প্রত্যাশা করছে বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, চলতি বছর ২৫ আগস্টের পর নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হলে এর সমাধানে প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলো শক্ত অবস্থান নেয়নি। অধিকাংশ দেশই এই ইস্যুতে জোরালো অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থাও (ওআইসি) রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশেষ কোন উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট তৈরির পর বাংলাদেশে গত দুই মাসে ৬ লাখ ৫ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। তবে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ যেভাবে জোরালো ভূমিকা রেখেছে, মুসলিম দেশগুলো সেভাবে কোন অবস্থান নিতে পারেনি। রোহিঙ্গা সঙ্কট তৈরির পর মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে তুরস্ক সবচেয়ে জোরালো অবস্থান নিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান এ বিষয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে কথা বলে আসছেন। এছাড়া রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এমিনে এরদোয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুট ক্যাভুফোগলু। তারা কক্সবাজারে গিয়ে রোহিঙ্গা এলাকা পরিদর্শন করেছেন। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান প্রত্যাশা করেছেন। মিয়ানমার বাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে মালয়েশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আহমদ জাহিদ হামিদি ইতোমধ্যেই ঢাকা সফর করেছেন। তিনি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পও পরিদর্শন করেছেন। বাংলাদেশ সফরকালে আহমদ জাহিদ রোহিঙ্গা ইস্যুতে তার দেশের জোরালো অবস্থানের বিষয় স্পষ্ট করেন। এছাড়া মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক সম্প্রতি জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ একা নয়। নতুন করে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে বাংলাদেশ সরকারের পাশে রয়েছে তার দেশ। ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো এল মারসুদিও রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে ঢাকায় এসেছিলেন। দেশটি রোহিঙ্গা সঙ্কটের দ্রুত সমাধান প্রত্যাশা করেছে। তবে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বরতার নিন্দা জানিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছে মালদ্বীপ। সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নৃশংসতা বন্ধে ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের সঙ্গে সব বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ রেখেছে দেশটি। মালদ্বীপ কোন প্রভাবশালী দেশ না হলেও এই ইস্যুতে তারা একটি অবস্থান নিয়েছে। যদিও মালদ্বীপের সঙ্গে মিয়ানমারের খুব বেশি বাণিজ্য নেই। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইরান জোরালো অবস্থান নিয়েছে। ইরানের প্রেসিডেন্ট ড. হাসান রুহানি ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান টেলিফোনে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে আলোচনাও করেছেন। এছাড়া ইরানের স্বাস্থ্য উপমন্ত্রী ডাঃ সৈয়দ হাদি আইয়াজি রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে ঢাকায় এসেছিলেন। এ সময় তিনি রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে ইরানের অবস্থান স্পষ্ট করেন। এদিকে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে বাংলাদেশে আসেন জর্দানের রানী রানিয়া আল আবদুল্লাহ। এদিকে মুসলিম দেশের বৃহত্তম জোট ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (ওআইসি) রোহিঙ্গা সঙ্কটে খুব বেশি জোরালো অবস্থান নিতে পারেনি। ২৫ আগস্ট নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট তৈরির আগেই ওআইসির নতুন মহাসচিব ইউসেফ বিন আহমদ আল-ওথাইমিন চার দিনের সফরে এসেছিলেন। তবে তিনি এসেছিলেন আগস্টের শুরুতে। সে সময় তিনি রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান, জাতীয় সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা রওশন এরশাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এছাড়া তিনি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পও পরিদর্শন করেন। বাংলাদেশ সফরের সময় ওআইসি মহাসচিব রোহিঙ্গা সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের দাবি তুলেছিলেন। তিনি রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। এছাড়া রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে আলোচনার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন আল-ওথাইমিন। ওআইসি মহাসচিবের সঙ্গে বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। ওআইসি মহাসচিব রোহিঙ্গা ইস্যুটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এছাড়া চলতি বছর জানুয়ারিতে মালয়েশিয়ায় ওআইসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বিশেষ বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুটি তুলে ধরে এই সমস্যার সমাধান প্রত্যাশা করা হয়েছিল। তবে নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরুর পর ওআইসি বিশেষ কোন উদ্যোগ নেয়নি। সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সৃষ্টি করতে ওআইসির কাছে জোরালো আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নাগরিকত্ব দেয়ার জন্যও চাপ দিতে ওআইসির সহায়তা চাওয়া হয়েছে। রোহিঙ্গা ইস্যুতে ওআইসি অবশ্য বরাবরই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে আসছে। বাংলাদেশ প্রত্যাশা করে এই ভূমিকা আরও জোরালো হোক। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই ইস্যুতে সম্পৃক্ত করার কাজে ওআইসির বিশেষ ভূমিকা জরুরী। এদিকে নতুন করে রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরু হলে মুসলিম বিশ্বের প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরব নীরবতা পালন করে আসছিল। এই নিয়ে মুসলিম বিশ্ব থেকে সৌদি আরবের বিরুদ্ধে সমালোচনাও শুরু হয়। ভারতের দিল্লীর জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা সাইয়্যেদ আহমদ বুখারী মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতন ইস্যুতে সৌদি আরবের নীরবতাকে দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেছিলেন। তিনি সৌদি রাজা সালমান বিন আবদুল আজিজকে পাঠানো এক চিঠিতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুসলিম দেশগুলোর জরুরী বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তবে ২৫ আগস্ট ঘটনার এক মাস পরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আদেল আল জুবেইর রোহিঙ্গা ইস্যুতে মুখ খোলেন। রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সৌদি আরব জোরালো ভূমিকা না রাখলেও দেশটি রোহিঙ্গাদের জন্য মোটা অঙ্কের ত্রাণ সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে।
×