ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

কিশোরীকে পুড়িয়ে হত্যা ॥ স্মার্টফোন চুরির অভিযোগকে কেন্দ্র করে নৃশংসতা

এ বর্বরতার শেষ নেই

প্রকাশিত: ০৫:৩৮, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

এ বর্বরতার শেষ নেই

গাফফার খান চৌধুরী/মোস্তফা কামাল সরকার ॥ এবার নরসিংদীতে সামান্য মোবাইল ফোন চুরির অভিযোগে এক কিশোরী স্কুলছাত্রীকে পরিকল্পিতভাবে বাড়ি থেকে অপহরণ করার পর কেরোসিন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড নিহত কিশোরীর চাচি। হত্যাকাণ্ডে জড়িত চারজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে পুলিশ। হত্যাকারী চারজনের মধ্যে দুইজন হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড নিহতের চাচির ভাই। অপর দুইজন চাচির ভাইয়ের পরিচিত। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে সারা নরসিংদীতে এবং জেলাটি থেকে বের হওয়ার প্রতিটি পথে চেকপোস্ট বসিয়ে ব্লকরেইড পদ্ধতিতে অভিযান শুরু করেছে পুলিশ ও র‌্যাব। ইতোমধ্যেই পুলিশ প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে একজনকে শনাক্ত করতে পেরেছে। তার জবানবন্দী রেকর্ড করা হচ্ছে। এমন ঘটনায় সারাদেশে আবারও রীতিমতো হৈচৈ পড়ে গেছে। যদিও শিশু, কিশোর বা কিশোরীদের নির্যাতনের ঘটনা নতুন নয়। প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। কোমলমতি শিশু, কিশোর ও কিশোরীরা শারীরিক, মানসিক এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের এক ধরনের মানসিক বিকৃতির লক্ষণ। সচেতনতা ছাড়া সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ দূর করা সম্ভব নয়। পাশাপাশি যে কোন অপরাধ বিশেষ করে শিশু, কিশোর বা কিশোরীদের নির্যাতনের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। শুক্রবার রাত দশটার দিকে জেলার শিবপুর উপজেলার যোশর ইউনিয়নের খৈনকুট গ্রামের একটি কাঠাল বাগান থেকে আজিজা খাতুন (১৩) নামের খৈনকুট সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রীকে মারাত্মক দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করেন তার পিতামাতা। রাতেই তাকে নরসিংদী থেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা বিফলে ঢেলে দিয়ে শনিবার ভোর পাঁচটার দিকে না ফেরার দেশে চলে যায় আজিজা। আজিজার পিতা আব্দুস ছাত্তার ও মা জোসনা বেগমসহ স্বজনদের অভিযোগ, একটি মোবাইল ফোন চুরি যাওয়ার সূত্র ধরে ঘটনাটি ঘটে। তাদের গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী আব্দুস ছালাম তার স্ত্রী বিউটি বেগমের জন্য বিদেশ থেকে একটি এ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন পাঠায়। আব্দুস ছালাম হচ্ছে আব্দুস ছাত্তারের ভাই। সে হিসেবে আব্দুস ছাত্তার বিউটি বেগমের ভাসুর। ফোনটি সপ্তাহখানেক আগে চুরি যায়। বিউটি বেগমের ধারণা মোবাইল ফোনটি তারই ভাসুর আব্দুস ছাত্তারের দুই মেয়ে আজিজা ও আজিজার বড় বোন মাফিয়ার মধ্যে যে কোন একজন চুরি করেছে। কিন্তু দুই বোন বরাবরই তারা মোবাইল ফোন চুরি করেনি বলে দাবি করে আসছে। এতে চাচি বিউটি বেগম ক্ষুব্ধ হয়ে ৩/৪ যুবককে নিয়ে জোরপূর্বক আজিজাকে একটি সিএনজি চালিত অটোরিক্সায় তুলে শুক্রবার দুপুরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। এদিন ঘটনার সময় তিনি ও তার স্ত্রী বাড়িতে ছিলেন না। আজিজাকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও পাওয়া যাচ্ছিল না। শুক্রবার রাতে বাড়ির কাছের একটি কাঁঠাল বাগান থেকে আজিজাকে গুরুতর দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। আজিজাকে মোবাইল ফোন চুরির বিষয়টি স্বীকার না করলে পুড়িয়ে হত্যা করা হবে বলে তার চাচি বিউটি হুমকি দিয়েছিল। মৃত্যুর আগে আজিজা তাকে তার চাচির ভাইয়েরাই এ ঘটনা ঘটিয়েছে বলে জানিয়েছে। শিবপুর মডেল থানার ওসি সৈয়দুজ্জামান জানান, ঘটনাস্থল থেকে একটি পেট্রোলের বোতল উদ্ধার হয়েছে। নরসিংদীর পুলিশ সুপার আমেনা বেগমসহ পুলিশের ও সংশ্লিষ্ট উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। জেলাটির শিবপুর সার্কেলের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রেজোয়ান আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যেই কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীকে শনাক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে একজনকে তাদের হেফাজতে রাখা হয়েছে। তার জবানবন্দী গ্রহণ করা হচ্ছে। জবানবন্দী মোতাবেক ওই কিশোরীকে বাড়ি থেকে তুলে এনে ওই কাঁঠাল বাগানে নিয়ে হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়েছে। সেই আগুনে পুড়েই কিশোরীর মৃত্যু হয়েছে। পুরো ঘটনার সঙ্গে নিহত কিশোরীর চাচি বিউটি বেগম জড়িত বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য মিলেছে। এছাড়া সরাসরি চারজনে ওই কিশোরীর গায়ে আগুন দেয়। এই চারজনের মধ্যে দুইজন নিহত কিশোরীর চাচি বিউটি বেগমের ভাই। অপর দুইজন বিউটি বেগমের ভাইয়ের পরিচিত বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। তাদের গ্রেফতারে সারা নরসিংদীতে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশিসহ ব্লকরেইড পদ্ধতিতে অভিযান চলছে। নরসিংদী থেকে বের হওয়ার প্রতিটি রাস্তায় কড়া অভিযান চালানোর নির্দেশ এসেছে সুপারসহ পুলিশের উচ্চপর্যায় থেকে। নিহত কিশোরীর পিতা বাদী হয়ে মামলা দায়ের করছেন। জেলা পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, সামান্য মোবাইল ফোন চুরির সূত্রধরে ঘটনাটি ঘটে। ওই কিশোরীকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে হত্যা করার বিষয়টি প্রাথমিক তদন্তেই নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে হত্যার আগে কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়েছিল কিনা তা এখনও নিশ্চিত নয়। এ ব্যাপারে চিকিৎসকদের মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে। নরসিংদীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) হাসিবুল আলম জানান, ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের নির্দেশ এসেছে জেলা পুলিশ সুপার, পুলিশ সদর দফতর ও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল জানান, কিশোরীর শরীরের ৯৪ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। কীভাবে দগ্ধ হয়েছে তা জানার চেষ্টা চলছে। গত বছর খুলনায় শিশু রাকিবকে পায়ুপথে বাতাস ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা। এছাড়া গত বছরের ৮ জুলাই সিলেটে শিশু রাজনকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। এ মামলার আসামি কামরুল ইসলামকে জেদ্দা থেকে ফিরিয়ে আনে সরকার। এসব ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার বিচারে কয়েকজনের ফাঁসির দ-াদেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়া গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রাম থেকে স্কুল ছাত্র শুভ, তাজেল, মনির ও মাদ্রাসা ছাত্র ইসমাইলকে তুলে নিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যার ঘটনা আবারও ব্যাপক আলোচনার ঝড় তুলে। গত বছরের ১১ এপ্রিল গরুচোর ভেবে চার ঘণ্টার নির্যাতনের পর হাত-পা বেঁধে রাজধানীর দক্ষিণ থানাধীন এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া কালিগঞ্জের বালু নদীতে ফেলে দিয়ে কিশোর নিজাম উদ্দিনকে হত্যারও ঘটনায় সিআইডি সাত জনকে গ্রেফতার করে। মামলাটির বিচার চলছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে কুমিল্লার সদরের দক্ষিণ উপজেলাধীন দক্ষিণ রসুলপুরের ঢুলিপাড়ায় সহোদর মেহেদী হাসান জয় (৭) ও মেজবাউল হক মনিকে (৫) গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনা ঘটে। হত্যাকারী হিসেবে গ্রেফতার হয় নিহতদের বৈমাত্র (সৎভাই) ভাই বেসরকারী ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির বিবিএ (ব্যাচেলর অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন) শেষ বর্ষের ছাত্র শফিউল ইসলাম ছোটন। শিশু, কিশোর ও কিশোরদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। মানুষের সক্ষমতা বাড়ছে। একটি সমাজ যখন উন্নত সামাজিক ব্যবস্থার দিকে প্রবেশ করতে থাকে, তখন সমাজে বেশকিছু বিষয়ে পরিবর্তন আসতে থাকে। মানুষ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। চাহিদাও বাড়ছে। পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থায় যারা পিছিয়ে থাকে তাদের মধ্যে জেদ, মন কষাকষি, ক্ষোভ, না পাওয়ার ক্রোধ ও আফসোসসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। অনেক মানুষই নিজের স্বার্থ হাছিলের জন্য অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলার চেষ্টাও করে। যা অনেক সময়ই সঠিকভাবে হয় না। অযৌক্তিক কারণে এসব চাহিদা অনেকেই অর্জন করার চেষ্টা করে। বেশিরভাগ সময় অপরাধের মাধ্যমে অনেকেই এসব চাহিদা মেটানোর চেষ্টা করে থাকে। যার পরিণতি মারাত্মক অপরাাধ। এছাড়া প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতেও জেদ বা রাগের বশবর্তী হয়ে পরিকল্পিতভাবে শিশু নির্যাতন বা হত্যাকা-ের মতো মারাত্মক সব অপরাধ করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই শিশুরা শিকারে পরিণত হয়। সামাজিক সচেতনতা ছাড়া এসব অপরাধ সমাজ থেকে দূর করা কঠিন। পাশাপাশি দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ইতোমধ্যেই বিচার বিভাগ এ ধরনের অনেক মামলার ক্ষেত্রে দৃষ্টান্তমূলক রায় দিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে এ ধরনের অপরাধ দিন দিন কমে আসবে।
×