ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

অধ্যাপক ড. এম এ মাননান

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের ২৫ বছর

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় গৌরবের ২৫ বছর

বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় ২৫ বছরে উপনীত হয়েছে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে সেই যে পথ চলা শুরু হয়েছিল বাংলার ঘরে ঘরে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর, সেই পথচলা পূর্ণতা পেয়েছে তথ্য প্রযুক্তির ছোঁয়ায়। বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সবাইকে শিক্ষার আওতায় আনার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই স্বপ্ন পূরণে কাজ করছে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষাবঞ্চিত মানুষকে স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে তাদেরকে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। গতানুগতিক ব্যবস্থার পরিবর্তে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় ৪৩টি একাডেমিক প্রোগ্রামের মাধ্যমে শিক্ষাকে সহজলভ্য করেছে। প্রায় ১৬০০ স্টাডি সেন্টারে ছয় লক্ষাধিক অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী নিয়ে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এখন পৃথিবীতে সপ্তম এবং বিশ্বময় ৬০টি ওপেন ইউনিভার্সিটির মধ্যে তৃতীয়। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে বিগত কয়েক বছরে। অবকাঠামোগত দিক ছাড়াও শিখন ও শিক্ষণগত দিক দিয়েও অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। বিশেষত বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্পের প্রভাব এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। সত্যিকার অর্থে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় অনলাইন ও ভার্চুয়াল শিক্ষার জগতে প্রবেশ করেছে। জন্মলগ্ন থেকে ২০১৩ পর্যন্ত মুদ্রিত পাঠসামগ্রী ও জাতীয় টেলিভিশন ও বেতার এর মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হলেও ২০১৪ থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্য প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা কার্যক্রম জোরেশোরে শুরু হয়েছে। এখন শিক্ষার্থীরা বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার প্রোগ্রামগুলোতে অংশগ্রহণকারীরা বইপত্র, শিক্ষকের প্রভাষণসহ শিক্ষা বিষয়ক সব সেবা পাচ্ছে ঘরে বসে ই-প্ল্যাটফরম, ওয়েবটিভি, ওয়েবরেডিও, মাইক্রো-এসডি কার্ড, বাউটিউব, ইউটিউব, ফেসবুক, আইভিসিআর ইত্যাদির মাধ্যমে। বিটিভি ও বাংলাদেশ বেতার তো আছেই। ওয়েবসাইটে পেয়ে যাচ্ছে সকল বই ই-বুক আকারে। বিভিন্ন তথ্য পাচ্ছে বাউবি এ্যাপসের মাধ্যমে গুগল প্লে-স্টোর থেকে। ফি জমা দিচ্ছে অনলাইনে, পরীক্ষার ফলাফল পাচ্ছে সেলফোন আর বাউবি ওয়েবসাইটে। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্কুল, বিভাগ ও দফতরের কাজে গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং (ঊজচ) বাস্তবায়ন করা হয়েছে যার মধ্যে রয়েছে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট মডিউল, স্টোর ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট মডিউল, ইফাইলিং মডিউল, পে-রোল মডিউল ও ইনটেগ্রেটেড ফিন্যান্স এ্যান্ড এ্যাকাউন্টস মডিউলের সমন্বয়। এই সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়কে অটোমেশনের আওতায় আনা হয়েছে। এসএমএস কমিউনিকেশন সিস্টেম নামক অনলাইন এপ্লিকেশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ছাড়াও বাউবিতে কর্মরত সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ যে কোন শ্রেণী-পেশার মানুষকে মোবাইল ফোনে তাৎক্ষণিক জরুরী তথ্য/এসএমএস প্রেরণ করা হয়ে থাকে। ডিজিটাল আইডি কার্ড ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম বাস্তবায়নের মাধ্যমে কর্মরত সকল শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দ্রুততম সময়ে সিকিউরিটি বারকোডসহ ডিজিটাল আইডি কার্ড দেয়া হয়। অন্য একটি সফ্টওয়ারের মাধ্যমে সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যদের জন্য এসএসসি ও এইচএসসি সমমানের নিশ-১ প্রোগ্রামের সকল কার্যক্রম অতি দ্রুত সময়ে নির্ভুলভাবে অন-লাইনে সম্পন্ন করা হয়। ই-লার্নিং সেন্টার ও লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের ঘরে বসে অনলাইনে শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালনাযোগ্য ইথারনেট আইপি নেটওয়ার্কভিত্তিক সার্ভিলেন্স সিস্টেমের মাধ্যমে সমগ্র ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বাউবির মূল ক্যাম্পাসে সকল স্কুল, বিভাগ, দফতর ও কেন্দ্রসমূহে ছয় শতাধিক কম্পিউটার ও আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি স্থাপনের মাধ্যমে সব ব্যহারকারীর জন্য সার্বক্ষণিক নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। এছাড়াও একযোগে বাউবির ১২ আঞ্চলিক কেন্দ্রকে অপটিকেল ফাইবারের মাধ্যমে ও অর্ধশতাধিক উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রকে মডেমের মাধ্যমে বাউবির মূল নেটওয়ার্কের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। বাউবির ক্রয় প্রক্রিয়ায় গতিশীলতা ও স্বচ্ছতা আনয়নের লক্ষ্যে বাউবিতে ইলেক্ট্রোনিক গভর্মেন্ট প্রকিউরমেন্ট বা ইজিপি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ইলার্নিং পলিসি, ওপেন এডুকেশনাল রিসোর্স পলিসি ও ইলার্নিং কোয়ালিটি এস্যুরেন্স ফ্রেমওয়ার্কসহ ৩০টির অধিক পলিসি ও বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে যা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে গতি ও স্বচ্ছতা এনেছে। এ যেন গত ২৫ বছরে ক্রমাগত এগিয়ে চলার এক রুপালি অভিযাত্রার গল্প। বিম্স নামক সিস্টেমসহ কয়েকটি ইনোভেটিভ সফ্টওয়্যারের সাহায্যে অতি দ্রুত পরীক্ষার ফল প্রক্রিয়াকরণ ও প্রকাশ করার কারণে ফল-প্রকাশ প্রলম্বিত-জটমুক্ত হয়ে দুই মাস সময়ের মধ্যে প্রকাশিত হচ্ছে। উত্তরপত্র বিলি ও পরীক্ষণ ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণের ফলে পরীক্ষা ব্যবস্থা এখন জটিলতামুক্ত হয়েছে। আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলো সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা, ফিঙ্গার রিকগ্নিশন সিস্টেমের মাধ্যমে অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করা, পরীক্ষা পদ্ধতি ডিজিটালাইজড্ করা, পরীক্ষার ফলাফল সংক্রান্ত অভিযোগ অনলাইনের মাধ্যমে সমাধান করাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ওয়ান-স্পট সার্ভিস দেয়ার ব্যবস্থা করায় প্রশাসনে গতিময়তা অনেক বেড়েছে। বাউবিতে আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি। স্বপ্ন দেখি এক আলোকিত বাংলাদেশের। আর সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নের জন্য আমরা চাই একটি আলাদা এডুকেশন টিভি চ্যানেল যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রগুলোকে বিশেষ প্রক্রিয়ার সাহায্যে ইনটেগ্রেডেড করে লাইভ ক্লাস করানো সম্ভব হবে। এতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসার গতি দ্রুত হবে। আমরা আরও স্বপ্ন দেখছি এ বিশ্ববিদ্যালয়কে বাংলাদেশের সর্বপ্রথম পেপারলেস বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার। রজতজয়ন্তী উপলক্ষে আমাদের এ স্বপ্ন বাস্তবায়নে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সকলকেসহ অন্যান্য অংশীজনদের সহযোগিতা বিশেষভাবে কামনা করছি। সবাই মিলে এক সঙ্গে দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে ছুটে চলব সামনের দিকে, প্রজন্মের পর প্রজন্মকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করব যারা এ সোনার বাংলাকে সুখে-শান্তিতে ভরপুর করে রাখবে। লেখক: উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
×