ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশকে টার্গেট করে মিয়ানমার সীমান্তে ৪৫ কারখানা

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

বাংলাদেশকে টার্গেট করে মিয়ানমার সীমান্তে ৪৫ কারখানা

শংকর কুমার দে ॥ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা আসার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মরণনেশা ইয়াবার চালান আসার ঘটনাও বেড়েছে। শনিবারও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) ধাওয়া খেয়ে ইয়াবা চোরাচালান চক্র পৌনে ২ লাখ পিস ইয়াবা ফেলে দিয়ে পালিয়ে গেছে। বাংলাদেশকে টার্গেট করে মিয়ানমার সীমান্তে গড়ে উঠেছে ৪৫ ইয়াবা তৈরির কারখানা। মিয়ানমার থেকে প্রায় প্রতিদিনই অবৈধভাবে সীমান্ত দিয়ে সমুদ্রপথে ট্রলার ও নৌকাযোগে মরণনেশা ইয়াবার চোরাচালান আসছে বাংলাদেশে। প্রতিমাসে গড়ে ৩০ কোটি টাকার ইয়াবার চালান আসছে। প্রতিবছর ইয়াবার চালান আসছে সাড়ে ৩ শতাধিক কোটি টাকার। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের ৪৩ পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করছে চোরাচালান সিন্ডিকেট। ইয়াবার ৯০ শতাংশই নাফ নদী ও সাগরপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মিয়ানমার থেকে আসা ইয়াবার চালান কোনভাবেই বন্ধ করা যাচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে পাঠানো প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, শনিবার ভোরে কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার নাফ নদীর সাবরাং ইউনিয়নের তিন ও চার নম্বর সøুইস গেটের মাঝামাঝি ‘বকের প্যারা’ এলাকা থেকে ইয়াবাভর্তি নৌকাটি জব্দ করেছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি। বিজিবি সদস্যদের ধাওয়া খেয়ে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৯৫ পিস ইয়াবা বড়ি ফেলে পালিয়ে গেছে পাচারকারী সিন্ডিকেট সদস্যরা। মিয়ানমার জলসীমান্ত পার হয়ে ইয়াবা ভর্তি একটি নৌকা বাংলাদেশের দিকে আসতে দেখে থামানোর সংকেত দেয় বিজিবি। স্পীডবোটটি বিজিবির সদস্যদের কাছাকাছি এলে পাচারকারীরা নৌকাটি ডুবিয়ে দিয়ে সাঁতরে মিয়ানমার চলে যায়। ভাসমান নৌকার একটি পাত্রের ভেতর থেকে ১ লাখ ৭৬ হাজার ৬৯৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার করাসহ ইয়াবা চালানে ব্যবহৃত নৌকাটি জব্দ করেছে বিজিবি। এভাবেই প্রতিদিন ইয়াবার চালান আসছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মাদকসেবীদের কাছে হেরোইন, ফেনসিডিলের চাইতে ইয়াবার চাহিদাই বেশি। এ জন্য ইয়াবা পাচার রোধে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করার পরও কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ইয়াবার চোরাচালান। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমার সীমান্তে ইয়াবার কারখানাগুলো ও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার উদ্যোগ নেয়ার পরও ইয়াবা বন্ধ হচ্ছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে তাদের দেশের সীমান্ত এলাকায় গড়ে ওঠা ইয়াবা তৈরির কারখানার তালিকা দেয়া হয়। প্রদত্ত তালিকায় মিয়ানমারকে ৪৫ ইয়াবা কারখানার বিষয়ে তথ্য দেয় বাংলাদেশ। এর মধ্যে ৩৭ কারখানার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়। এসব কারখানায় ১৩ ধরনের ইয়াবা তৈরি হচ্ছে, যার বাজার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ১৭২ কিলোমিটারই অরক্ষিত। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৪৩ পয়েন্ট দিয়ে বিভিন্ন কৌশলে ইয়াবা পাচার করা হচ্ছে। এর মধ্যে টেকনাফ ও শাহপরীর দ্বীপের মধ্যবর্তী ১৪ কিলোমিটার নাফ নদীর চ্যানেল এলাকা ইয়াবা পাচারের প্রধান রুট হিসেবে ব্যবহার করে চোরাচালানিরা। ইয়াবা চোরাচালানে ছোট নৌকা, ট্রলার, মালবাহী ছোট জাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে। ইয়াবার ৯০ শতাংশই নাফ নদী ও সাগরপথে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে। মিয়ানমারের মংডু, সিটওয়ে, মইং, কুখাই, নামকখাম, শান, ওয়া, মংশাত, তাশিলেক, মংপিয়াং, মংইয়াং ও পাংশাং, কুনলং, টেংইং, সেন, লুই হুপসুর, কাইয়াং, মাহাজা এ্যান্ড হুমং, কেউও, মাওকমাই, কাকাং মংটন কাশিন ও আইক্কায় ইয়াবা কারখানা বেশি। ইয়াবা তৈরির কারখানার মধ্যে ১০টি গড়ে উঠেছে মংডুতে। এখন নাফ নদী পার হয়ে নৌযানে ইয়াবার চালান টেকনাফ, কক্সবাজার হয়ে সরাসরি রাজধানীতে চলে আসে। এছাড়া সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে ইয়াবাসহ অস্ত্রের চালান আসছে। এই ইয়াবার চালান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিনা বাধায় চলে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তা ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের গত ১৬ এপ্রিল চট্টগ্রামে ২০ লাখ ও টেকনাফ থেকে আসা ১০ লাখ ইয়াবার দুই বড় চালান আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপকেন্দ্রিক দেশের সর্ববৃহৎ একটি আন্তর্জাতিক ইয়াবা পাচার চক্র গড়ে উঠেছে, যার তালিকা তৈরি করেছে বিজিবি, র‌্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থা। গত ৪ মাসে মোট ৭৬ লাখ ইয়াবার ৪টি চালান এনেছে ইয়াবা চোরাচালান চক্র। এর মধ্যে বছরের গত ডিসেম্বর মাসে ১৬ লাখ এবং জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে তিন চালানের প্রতিটিতে ২০ লাখ করে আরও ৬০ লাখ ইয়াবা খালাস করেছে ইয়াবা পাচারকারী চক্র। গত আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা বিতাড়নের ঢল নামার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মরণনেশা ইয়াবা পাচার বেড়ে গেছে। মিয়ানমারের ইয়াবায় বিষাক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। বলা হতো শুধু রোহিঙ্গারাই ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীসহ তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই এখন ইয়াবা পাচারে সরাসরি জড়িত। দমনপীড়ন ও নির্যাতনের পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে টাকাপয়সাসহ সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়ে তাদের হাতে ইয়াবার চালান তুলে দিচ্ছে মিয়ানমারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মিয়ানমার থেকে ইয়াবাসহ আটক রোহিঙ্গাদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া এমন তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে র‌্যাব, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও গডফাদারের তালিকা তৈরি করা হয়। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব জায়গায় ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। এতে সহজেই আসক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে নারী নির্যাতনসহ নৃশংসতা বাড়ছে। খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, চুরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তারা। মাদকাসক্ত সন্তান তার মা-বাবাকে হত্যা করছে, মাদকাসক্ত বাবা-মার হাত ধরে নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দেয়ার ঘটনাও এখন ঘটছে। এটা দেশের জন্য এখন বড় বিপদ। বাংলাদেশে ইয়াবার চালান আসা ঠেকাতে শীঘ্রই নাফ নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে।
×