ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিলুপ্তপ্রায় দেশীয় ধান রক্ষার অনন্য উদ্যোগ

৫২ জাতের হারানো ধানের সংগ্রহশালা

প্রকাশিত: ০৪:০১, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

৫২ জাতের হারানো ধানের সংগ্রহশালা

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ একটা সময় ছিল যখন রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে শুধু চাষ হতো দেশীয় বিভিন্ন জাতের ধান। এখন এসব বিলুপ্ত। তবে বিলুপ্ত এসব দেশীয় ধান রক্ষা করে চলেছেন রাজশাহীর তানোর উপজেলার নিভৃত পল্লীর কৃষক ইউসুফ মোল্লা। দীর্ঘদিন ধরে বিলুপ্ত দেশীয় ধান রক্ষা করে চলেছেন তিনি। এবার তার ক্ষেতে চাষ করেছেন বিলুপ্তপ্রায় ৫২ জাতের ধান। ‘রাঁধুনি পাগল, পাঙ্গাস, ঝিঙ্গাশাইল, কালজিরা, সুবাশ, বাশমতি, চিনি শঙ্কর, বাদশাভোগ, এক ধানে দুই চাল, বিন্নি- এসব ধানের নাম এখন আর অনেকের মনে নেই। নতুন প্রজন্ম তো দূরের কথা প্রবীণদের অনেকের মনের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে নামগুলো। তবে এসব ধান অনেক সযত্নে আগলে রেখেছেন কৃষক ইউসুফ মোল্লা। চলতি মৌসুমে তিনি বীজের পরিধি বাড়াতে ৫২ জাতের ধান চাষ করছেন। ইউসুফ মোল্লা রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের কৃষক পরিবারের সন্তান। নিছক শখের বসে নয়, ভালবেসে তিনি রক্ষা করে চলেছেন হারিয়ে যাওয়া ধানের জাত। ৩০ বছর ধরে চলছে তার ধান রক্ষার সংগ্রাম। ছোট ছোট প্লটে চাষ করে তিনিই বাঁচিয়ে রেখেছেন প্রায় ৬০ প্রজাতির ধান। এসব ধান বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে প্রায় বিলুপ্ত। নতুন দিনের মানুষ সেসব ধানের কথা ভুলে গেলেও বরেন্দ্রভূমির কৃষক ইউসুফ মোল্লা বাঁচিয়ে রেখেছেন সেসব ধানের ঐতিহ্য। এসব ধানের বেশির ভাগই খরা ও বালাইসহিষ্ণু। চাষ করতে রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক ব্যবহার করতে হয় না বললেই চলে। তাই নিজের মতো করেই নিজ গ্রামে এসব ধানের সংগ্রহশালাও গড়ে তুলেছেন ইউসুফ মোল্লা। কৃষক ইউসুফ মোল্লা জানান, ব্যক্তি উদ্যোগে এসব বিলুপ্ত ধানের বীজ দীর্ঘদিন ধরে সংরক্ষরণ করে রাখছেন তিনি। ২০১২ সাল থেকে রাজশাহী, বগুড়া, দিনাজপুরসহ সারাদেশে প্রায় ৩০০ কৃষককে তিনি এসব বীজ শর্তসাপেক্ষে সরবরাহ করেছেন। এছাড়া ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ঢাকায় একশোর বেশি ও রাজশাহী গবেষণা গারে প্রায় ৬৫ জাতের ধান বীজ সরবরাহ করেছেন এ কৃষক। ধানের ঐতিহ্য রক্ষায় ইউসুফ মোল্লা আদর্শ কৃষক হিসেবে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। তার প্রচেষ্টায় বিলুপ্তি প্রায় ২০০ বেশি ধানের বীজ সংরক্ষণে আছে। ইউসুফ মোল্লা জানান, পরিবেশবান্ধব সুগন্ধি এসব ধান অল্পদিনেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে থেকে হারিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরেই তিনি গত ৩০ বছর ধরে বীজ সংগ্রহের কাজ করছেন। এখন পর্যন্ত ২০০ বেশি বিভিন্ন জাতের ধান বীজ তিনি সংগ্রহ করেছেন। ২০১২ সাল থেকে ৫০টি করে জাতের ধান তিনি অল্প করে আবাদ করেন। সেই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগ্রহী কৃষকদের মাঝে বিতারণ করছেন। তিনি আরও জানান, তিনি যেসব কৃষকদের এসব হারানো ধানের বীজ সরবরাহ করছেন তা শর্তসাপেক্ষে। তা হলো বীজের বদলে বীজ। একজন কৃষক তার কাছে ৫ কেজি বীজ নিলে ধান উৎপাদনের পরে সে আবার ৫ কেজি বীজ ফেরত দিবে। কৃষক ইউসুফ মোল্লা জানান, তার সংগ্রহে থাকা ১০০ প্রজাতির বেশি বীজ গাজীপুর ধান গবেষণা কেন্দ্র ও রাজশাহী ধান গবেষণা কেন্দ্রে ৬৫ রকম বীজ দেয়া হয়েছে। তারা সেগুলোর বিস্তার করা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি আরও জানান, তার এমন উদ্যোগে উৎসাহ জোগাচ্ছেন স্থানীয় কৃষি সম্প্রসারণ ও বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)। তানোর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বলেন, কৃষক ইউসুফ মোল্লা উদ্যোগে বিলুপ্ত হওয়া ধান সম্পর্কে নতুন প্রজন্মরা জানতে পারবে। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তারা জানান, একসময় দেশে ১০ হাজার প্রজাতির ধান ছিল। এখন আছে এক হাজার। তাই ইউসুফ মোল্লা যেভাবে বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে বিলুপ্ত ধানের বীজ সংরক্ষণ করে চলেছেন, তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক দেব দুলাল ঢালী বলেন, বিলুপ্ত ধানের সংগ্রহ ইউসুফ মোল্লার অনন্য অবদান। নানা কারণে দেশীয় এসব ধানের জাত বিলুপ্ত হলেও স্বল্প পরিসরে যেভাবে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছেন ইউসুফ মোল্লা তা নিঃসন্দেহে বিরল।
×