ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ইউরোপে নয়া নেতৃত্ব

প্রকাশিত: ০৩:৫১, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

ইউরোপে নয়া নেতৃত্ব

ইউরোপকে কে নেতৃত্ব দিচ্ছে? এ বছরের শুরুতে এ প্রশ্নের জবাব পেতে কাউকে বেগ পেতে হতো না। জার্মান চ্যান্সেলর এ্যাঙ্গেলা মার্কেল অপ্রতিরোধ্যভাবে চতুর্থ নির্বাচনী বিজয়ের দিকে ধীরে ধীরে নিজেকে তৈরি করেছিলেন। ব্রিটেন তো ইউরোপের বাইরে চলেই গেছে। ইতালির অবস্থা নিম্নগামী। আর স্থবির ফ্রান্সকে এই আশঙ্কা গ্রাস করেছিল যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো সে দেশের লা পেনের উত্থান ঘটতে পারে। কিন্তু সম্প্রতি সেই হিসাব কিতাব সব পাল্টে গেছে। গত ২৪ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে এ্যাঙ্গেলা মার্কেল বিজয়ী হয়েছেন বটে। তবে তার ভোট ও আসন সংখ্যা এত কমে গেছে যে তার নেতৃত্বের বিশালত্ব খর্ব হয়েছে। জার্মানির সামনে এখন কয়েক মাসব্যাপী ত্রিমুখী কোয়ালিশনের জটিল আলোচনা অপেক্ষা করছে। প্রায় ৬০ লাখ ভোটার বিদেশী বিদ্বেষী একটি ডানপন্থী দলকে ভোট দিয়েছে। তাদের অনেকেই দিয়েছে মার্কেলের শরণার্থী নীতির প্রতিবাদে। ফলে পার্লামেন্টে যে দলটির কোন আসন ছিল না সেই অলটারনেটিভ ফর জার্মানি বা এএফডি পার্টি তৃতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। অথচ বাইন নদীর তীরে ঘটছে আরেক ঘটনা। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রনের উচ্চাভিলাষ এখন আকাশচুম্বী হয়ে উঠছে। পার্লামেন্টে তার নিজস্ব নতুন দলের এখন দোর্দ- আধিপত্য। সম্প্রতি তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে এমন এক ভাষণ দিয়েছেন যা তাকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে এসেছে। তবে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের মঞ্চে ফ্রান্সকে মধ্যমণির আসনে পুনর্প্রতিষ্ঠিত করতে পারবেন কিনা সেটা শুধু তার ইউরোপ সংক্রান্ত পরিকল্পনার ওপরই নির্ভর করছে না, স্বদেশ ফ্রান্সে সংস্কার নীতি বাস্তবায়নে তিনি সফল হচ্ছেন কিনা তার ওপরও নির্ভর করছে। বলাবাহুল্য দীর্ঘদিন ধরেই ফ্রান্সকে এমন এক দেশ হিসেবে দেখা যাচ্ছে সেখানে সংস্কার কোনভাবেই সম্ভব নয়। ইউরোপ নিয়ে ম্যাক্রনের ভাষণ দিয়েই শুরু করা যাক। সেই ভাষণে নানা ধ্যান-ধারণা ব্যক্ত হয়েছিল। অভিন্ন সামরিক বাজেটের কথা বলা হয়েছিল। র‌্যাডিকেল সব প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের জন্য একটি সংস্থা গঠনের কথা বলা হয়েছিল। তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নের রক্ষা করার কথা বলেছেন। বলেছেন, যে ইইউর মধ্যেই আছে সেই অভিন্ন ভবিষ্যত যা আমাদের এই মহাদেশের জনগণ আমাদের হাতে ন্যস্ত করেছেন। অন্যদিকে এ্যাঙ্গেলা মার্কেল নির্বাচনে আশানুরূপ বিজয় না পাওয়ায় ইউরোপ নিয়ে তার আগের সেই সুদৃঢ় কণ্ঠ এবার শোনা যায়নি। তিনি বলেছেন, ইউরোপ নিয়ে খুব বেশি প্রত্যাশা যেন না করা হয়। তিনি বলেন, কোন্টা কাজ করবে এবং কোন্টা করবে না তা বলার দিন আজ নয়।’ কাজেই ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভবিষ্যতটা ফ্রান্সের এক তরুণ সাহসী প্রেসিডেন্ট (ইমানুয়েল ম্যাক্রোন) যার উচ্চাভিলাষ ফ্রান্সের সীমান্ত ছাড়িয়েও সুদূরে বিস্তৃত এবং জার্মানির একজন সতর্ক চ্যান্সেলর যার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘনিয়ে এসেছে এই দুইয়ের মধ্যবর্তী কোন এক জায়গায় নিহিত। তথাপি ম্যাক্রন শেষ পর্যন্ত ইউরোপকে নেতৃত্ব দিতে পারবেন কিনা, আরও উদ্যমী মুক্তদ্বার ও আত্মবিশ্বাসী ইউরোপ গড়ে তুলতে পারবেন কিনা, সেট তার ধ্যান-ধারণার সাফল্যের ওপর নির্ভর করছে। সে আশাগুলোর সাফল্য নির্ভর করছে স্বদেশে তার নীতির বাস্তবায়নে ম্যাক্রন সফল হতে পারছেন কিনা! ফ্রান্স যদি ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তির উৎস হওয়ার চাইতে, সংস্থার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রতি হুমকি হিসেবে বয়ে যায়, তাহলে দেশটির প্রেসিডেন্টের গুরুত্ব জার্মান চ্যান্সেলরের পরেই স্থান পেতে পারে। তার আগে কখনই নয়। ম্যাক্রনের অভ্যন্তরীণ নীতি হয়ত দুর্বলভাবে যাত্রা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে তার মেক আপের পেছনে খরচ, জনপ্রিয়তা কমে যাওয়া এবং ক্ষমতা সম্পর্কে অহংবোধ নিয়ে সংবাদ শিরোনাম হয়েছে। ফরাসীরা অতি খুঁতখুঁতে স্বভাবের। যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য তারা ম্যাক্রনকে নির্বাচিত করেছিল সেগুলোর বৈধতা নিয়ে ইতোমধ্যে তাদের নিজেদের মধ্যে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ফ্রান্স সংস্কারের ব্যাপারে একটা নির্দিষ্ট প্যাটার্ন ধরে চলে। রাজপথে প্রতিবাদ ওঠে। সরকার তখন পিছু হটে। একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়। তবে এটা নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, ম্যাক্রন সম্ভবত এই প্যাটার্ন বা ধারাকে ভাঙতে চলেছেন। এবারের গ্রীকে একটা অসাধারণ ঘটনা ঘটেছে, যদিও খুব কমজনই তা লক্ষ্য করেছেন। বেশিরভাগ ফরাসী যখন সৈকতে অবকাশ যাপন করছিল, সে সময় ম্যাক্রন ট্রেড ইউনিয়নগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসে একটা সুদূরপ্রসারী ও উদার শ্রম সংস্কার নিয়ে মতৈক্যে পৌঁছান। ২২ সেপ্টেম্বর তিনি তাতে স্বাক্ষর দিয়ে আইনে পরিণত করেন। এ নিয়ে হৈচৈ তেমন একটা হয়নি বললেই চলে। ফ্রান্সের জঙ্গী ইউনিয়নগুলো কিংবা তাদের সমর্থক চরম বামপন্থীরা রাজপথে বিক্ষোভ করার মতো জনসমর্থন এ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারেনি। পুরোপুরি ৫৯ শতাংশ ফরাসী জানিয়েছে যে তারা শ্রম আইন সংস্কার সমর্থন করে। রাজপথ উত্তপ্ত হওয়ার মতো ইস্যু অবশ্য সামনে রয়েছে যেমনÑ অবসর ভাতা, কর ও শিক্ষা খাতে সরকারী ব্যয়। তবে বিস্ময়কর ব্যাপার হলো ম্যাক্রন তার প্রথম বড় ধরনের পরীক্ষায় ইতোমধ্যে উত্তীর্ণ হয়েছেন। নানা দিক দিয়েই ৩৯ বছর বয়স্ক ম্যাক্রনের স্বরূপটা এখনও ঠিকমতো উন্মোচিত হয়নি। বাহ্যিকভাবে দেখতে তাকে উদ্ধত ও অহঙ্কারী মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলোর আড়ালে এমন এক নেতার আবির্ভাব ঘটতে চলেছে যিনি একই সঙ্গে সাহসী শৃঙ্খলাপরায়ণ ও চিন্তাশীল। সাহসী, কারণ তিনি ইতোমধ্যে শ্রমআইন সংস্কারের মতো এক জটিল ও অতি চ্যালেঞ্জপূর্ণ কাজটা সম্পন্ন করে ফেলেছেন। কোন বিরোধিতার তোয়াক্কা করেননি। পূর্বসূরি ফ্রাসোঁয়া ওঁলাদ যে কাজটা করতে গিয়ে অভিযোগ আর সমালোচনার মুখে বার বার পিছু হোঁটেছেন, ম্যাক্রন সে কাজে হাত দিতে ভয় পাননি। সমালোচনার পরোয়া করেননি। গত বেশ কয়েক বছর ধরে ফ্রান্স জার্মানির এক দুর্বল অংশীদার ছিল। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এ্যাঙ্গেলা মার্কেল ইউরোপকে নেতৃত্বদানের একক ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছিলেন। বরং বলা চলে যে পরিস্থিতিই তাকে সেদিকে ঠেলে দিয়েছিল যা তিনি চানওনি, উপভোগও করেননি। এখন ম্যাক্রন স্বদেশে শ্রম আইন সংস্কারের মতো একটা দুরূহ কাজ সাফল্যের সঙ্গে সম্পাদন করে যে বলিষ্ঠতা ও কুশলতার পরিচয় দিয়েছেন তা থেকেই প্রমাণ হয় যে, বর্তমানে ¤্রয়িমাণ হয়ে পড়া এ্যাঙ্গেলা মার্কেলের জায়গায় তিনিই ইউরোপীয় ইউনিয়ন তথা ইউরোপকে নেতৃত্ব দেয়ার যোগ্যতা রাখেন। এ অবস্থায় ইউরোপীয় ইউনিয়নে জার্মানির দাপট কমে গিয়ে এক নতুন ভারসাম্য গড়ে উঠতে পারে। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×