ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

উৎপাদক ও রফতানিকারকের দেশে

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৯ অক্টোবর ২০১৭

উৎপাদক ও রফতানিকারকের দেশে

॥ এক ॥ আমদানি, উৎপাদন ও রফতানির পুরো বিষয়টি শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্রিক। মূলত বাংলাদেশ কৃষিভিত্তিক দেশ। কৃষিপণ্যের আড়তদারীর বাইরে আমরা বাণিজ্য বুঝতাম না। শিল্প কল কারখানাতো আমাদের ছিলই না। ট্রেডিং ছিল আমাদের মূল ব্যবসা। কাপড় কাঁচা সাবান থেকে শুরু করে সকল পণ্য আমরা আমদানিই করেছি। এরই মাঝে আমরা পৌঁছে গেছি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সময়কালে। এখন আমাদের সময় হয়েছে আমদানিকারক থেকে উৎপাদক ও রফতানিকারকের দেশে পরিণত হবার। সারা দুনিয়া এখন শিল্প বিপ্লবের চতুর্থ স্তর বা ডিজিটাল শিল্প বিপ্লব এর কথা বলছে। গত কয়েক বছর যাবতই বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম বলে আসছে যে, শিল্প বিপ্লবের চতুর্থ স্তরটা একদমই ভিন্ন মাত্রা নিয়ে এসেছে। তারা মনে করেন যে, ১৭৮৪ সালে আবিষ্কৃত বাষ্পীয় ইঞ্জিন, ১৮৭০ সালের বিদ্যুত, ৬৯ সালের ইন্টারনেট ও ৯১ সালের ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এর ওপর ভর করে শিল্প বিপ্লবের চারটি স্তর বিকশিত হয়েছে। তাদের ধারণা মতে মানুষ তার হাতে যখনই যে হাতিয়ার বা প্রযুক্তি পেয়েছে তার ওপর ভর করেই শিল্প বিপ্লবের চাকাকে সামনে নিচ্ছে। The First Industrial Revolution used water and steam power to mechani“e production. The Second used electric power to create mass production. The Third used electronics and information technology to automate production. Now a Fourth Industrial Revolution is building on the Third, the digital revolution that has been occurring since the middle of the last century. It is characteri“ed by a fusion of technologies that is blurring the lines between the physical, digital and biological spheres. There are three reasons why today‘s transformations represent not merely a prolongation of the Third Industrial Revolution but rather the arrival of a Fourth and distinct one: velocity, scope, and systems impact. The speed of current breakthroughs has no historical precedent. When compared with previous industrial revolutions, the Fourth is evolving at an expotential rather than a linear pace. Moreover, it is disrupting almost every industry in every country. And the breadth and depth of these changes herald the transformation of entire systems of production, management, and governance.Ó (https:/www.weforum.org/agenda/2016/01/the-fourth-industrial-revolution-what-it-means-and-how-to-respond) কিন্তু আমাদের অংশগ্রহণ এই চারস্তরের শিল্প বিপ্লবের কোথাও কি আছে? প্রথম-দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্তরে তো আমরা নেই। ১৯৬৯ সালের ইন্টারনেট বা ৯১ সালে ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব এর স্তরটাতে আমরা যুক্ত হই ২০০৬ সালে। ২০০৮ সালে আমাদের দেশে মাত্র ১২ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল। ফলে আমরা শিল্প কল কারখানার উৎপাদকের জায়গাতে যেতেই পারছি না। ’১৭ সালে ইন্টারনেটের বিদ্যমান অবস্থাটি অবশ্য আশাব্যঞ্জক। প্রায় সাড়ে সাত কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আমাদের। তবে ইন্টারনেটকে শিল্প-কল-কারখানা-শিক্ষা ও সরকারের জন্য ব্যবহারের গতিটা পশ্চিমা বা শিল্পোন্নত দেশের চাইতে বহুগুণ কম। ’৭১ সালে দেশটি স্বাধীন হবার পর এই দেশটাতে যত শিল্প কল কারখানা ছিল তার সবই জাতীয়করণ করা হয়েছিল, যার অন্যতম কারণ ছিল যে, সেইসব কারখানার মালিকেরা কেউ বাংলাদেশের অধিবাসী ছিল না। সেক্টর কর্পোরেশনগুলোর জন্ম হয়েছিল সেজন্য। সেই সময়ে আমরা কাপড় কাচার সাবানও নিজেরা বানাতে পারতাম না। তবে বিগত দিনগুলোতে ধীরে ধীরে আমরা শিল্প কল কারখানার দিকে এগিয়ে আসছি। আমাদের নিত্যপণ্যের উৎপাদনে আমরা বেশ অগ্রসর। ওষুধ, পোশাকসহ অনেক ক্ষেত্রে আমাদের অর্জন প্রশংসনীয়। কম্পিউটার বিষয়টা আরও ভিন্ন মাত্রার। সেই ৬৪ সালে বাংলাদেশে কম্পিউটার আসে বাইরে থেকে। সেই থেকেই কম্পিউটারের সকল কিছু আমরা আমদানিই করে আসছি। অন্যদিকে সুইডেনের ভলবো কোম্পানীর জন্য আমরা সফটওয়্যার বানিয়ে দিলেও নিজের দেশের সফটওয়্যারের বাজারটা প্রায় সকল ক্ষেত্রেই বিদেশীদের হাতে চলে গেছে। বিশেষ করে সরকারের বড় বড় কাজ ও ডিজিটাল রূপান্তরের কাজগুলো আমরা নিজেরা করার সুযোগ পাই না। এই ধারাবাহিকতায় ব্যতিক্রম ঘটান দেশের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। ‘আমরা বাংলাদেশে কম্পিউটার বানাবো এবং সেই কম্পিউটার বিদেশে রফতানি করব।’ স্বপ্ন, ইচ্ছা, নির্দেশনা বা আদেশ যাই বলি না কেন, এটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য। ৬ আগস্ট ২০১৫ ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের বৈঠকে তিনি এই ঘোষণা প্রদান করেন। এমন স্বপ্নটা তিনি ২০১১ সালেও দেখেছিলেন, যখন তিনি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য দোয়েল ল্যাপটপের উদ্বোধন করেন। পরনির্ভরশীল একটি দেশকে স্বনির্ভর করার এমন অদম্য ইচ্ছা বাংলাদেশের আর একজন মাত্র সরকার প্রধানের ছিল- তিনি তাঁরই পিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। দুর্ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধু সেই সময় পাননি যাতে তিনি বাংলাদেশকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশে পরিণত করতে পারেন। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে বঙ্গবন্ধুকে হারানোর একুশ বছর পর তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা সরকার পরিচালনার দায়িত্ব পালন করা শুরু করেন। শুধু কম্পিউটার বানাবার স্বপ্নের কথা কেন বলব, তথ্যপ্রযুক্তির সকল খাতে সমৃদ্ধি বা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন কিংবা নিজের টাকায় পদ্মা সেতু বানানোর যেসব দুঃসাহসী কাজ তিনি করে চলেছেন তাতে তার দেখানো পথেই বাংলাদেশের ভবিষ্যত রচিত হবে- এটি বলতে এখন আর কোন দ্বিধা থাকার কথা নয়। ২০১৫ সালের ৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত পুনর্গঠন করা ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের প্রথম সভায় তিনি কম্পিউটার বানানোর ও রফতানির কথা বলেন। যেহেতু আমি সেই সভাতে উপস্থিত ছিলাম, সেহেতু এর প্রেক্ষিতটির বিবরণও আমি দিতে পারি। সেদিন অনেক সময় ধরে তথ্যপ্রযুক্তির সামগ্রিক বিষয় নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা হচ্ছিল। চমৎকার এজেন্ডা ছিল সভার। এজেন্ডার বিপরীতে প্রধানমন্ত্রী বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্তও দিচ্ছিলেন। সভা প্রায় শেষ স্তরে ছিল। আমি তার অনুমতি নিয়ে বিবিধ আলোচ্যসূচীতে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করার সুযোগ পাই। তাকে জানাই যে, আমরা শিক্ষার ডিজিটাল রূপান্তরের কথা বলছি। প্রধানমন্ত্রী আপনি নিজে প্রত্যাশা করেন যে, আমাদের সকল ছাত্র ছাত্রী ল্যাপটপ হাতে নিয়ে স্কুলে যাবে। আপনি যদি সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপায়িত করতে চান তবে এখনকার পরিস্থিতিতে আপনাকে কমপক্ষে ৪ কোটি ডিজিটাল ডিভাইস আমদানি করতে হবে। প্রতিটি ল্যাপটপের দাম যদি ৩০ হাজার টাকা করেও হিসাব করেন তবে একটু ভেবে দেখুন এর ফলে আমরা কি পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা এই খাতে বিদেশে পাঠাবো। আমাদের উচিত আমদানিকারক থেকে উৎপাদক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করা। আমার প্রস্তাবনার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী কোন মন্তব্য করার আগেই অনেকে বললেন, বাইরে থেকে আমদানি করলে কম্পিউটারের দাম কম পড়ে। আমরা দোয়েল করে ব্যর্থ হয়েছি সেটিও অনেকে বললেন। আমাদের দক্ষতা নেই। মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেই। প্রধানমন্ত্রী সবাইকে উজ্জীবিত করে তখন বলেন যে, আমরা কম্পিউটার বানাব এবং রফতানিও করব। তিনি সেই দিনই টেশিসের দায়িত্ব আমার হাতে দেবার নির্দেশও দিলেন। ঘটনাচক্রে বিষয়টি সেই সভার মিনিটস-এ আসেনি। তবে প্রধানমন্ত্রীর এই স্বপ্নটি আমার মতো আরও অনেকের কাছে একটি প্রয়োজনীয় ও বাস্তবিক উদ্যোগ বলে মনে হয়। আশির দশক থেকে এখন অবধি বাংলাদেশী ব্রান্ডের কিছু কম্পিউটারের খবর আমরা জানি। কয়েকটির কথা আমি স্মরণ করতে পারি। বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক মহাসচিব মুনিম হোসেন রানার এক্সেস পিসি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সাবেক সভাপতি সবুর খানের ডেফোডিল পিসি, বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতির সদ্য সাবেক সভাপতি জনাব এ এইচ এম মাহফুজুল আরিফের সিএসএম, ফ্লোরা লিমিটেডের ফ্লোরা পিসি ও আনন্দ কম্পিউটার্সের আনন্দ পিসিসহ অনেকেই নানা নামে ক্লোন পিসি বাজারজাত করেছেন। বেসরকারী ক্রেতাদের ডেস্কটপ পিসির বাজারটা প্রধানত ক্লোন পিসির দখলে। যদিও আমাদের নিজস্ব একটি ব্রান্ড গড়ে ওঠেনি, তথাপি ডেস্কটপ পিসির জগতে আমাদের নিজেদের হাতে সংযোজন করা পিসির দাপটই প্রধান। কেবলমাত্র সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো গুণগত মানের নামে ব্রান্ড পিসি কিনে থাকে। এই হীনম্মন্যতার জন্য কোন দেশীয় ব্র্যান্ড বিকশিত হতে পারেনি। তবে বেসরকারী খাতে ব্র্যান্ড ডেস্কটপ পিসি কেউ কিনেই না। ল্যাপটপ যখন জনপ্রিয় হতে থাকে তখন ডেস্কটপ পিসির এই বাজারটি সঙ্কুচিত হতে থাকে। ল্যাপটপের কোন ক্লোন দেশে তৈরি হচ্ছিল না। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে সরকারের টেলিফোন শিল্প সংস্থার দোয়েল ল্যাপটপ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দোয়েল তার প্রথম চালানে বদনাম কামাই করে। পণ্যের গুণগতমান নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে। এর বাইরেও দোয়েলের ব্যবস্থাপনা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন দেখা দেয়। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ দোয়েল ল্যাপটপ কিনে অনেক ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ল্যাপটপের চাইতেও ভালভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। কিন্তু সেই যে একবার বদনাম কামাই করা হলো তার ফলে দোয়েল বেসরকারী ক্রেতাদের কাছে কোন আকর্ষণই তৈরি করতে পারেনি। অন্যদিকে সরকারী কেনাকাটায় প্রথমেই বলা হয়ে থাকে যে, আন্তর্জাতিকভাবে বিখ্যাত ব্র্যান্ড হতে হবে। দোয়েল সেই সীমা অতিক্রম করতে পারে না- কারণ সেটি আন্তর্জাতিক খ্যাতি যোগাড় করতে পারেনি। বাজারজাতকরণে এই প্রতিষ্ঠানটির চরম দুর্বলতাও এজন্য চরমভাবে দায়ী। এই বিষয়টি আমরা অন্য কোন সময়ে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করতে পারি। (চলবে)
×