ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

হলি আর্টিজানে হামলার মাস্টার মাইন্ড জঙ্গী সাগরকে খুঁজছে পুলিশ

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

হলি আর্টিজানে হামলার মাস্টার মাইন্ড জঙ্গী সাগরকে খুঁজছে পুলিশ

শংকর কুমার দে ॥ গুলশান হলি আর্টিজান জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড বলে পরিচিত গ্রেনেড-বোমা তৈরিতে বিশেষজ্ঞ ভয়ঙ্কর প্রকৃতির দুর্ধর্ষ জঙ্গী হাদিসুর রহমান সাগর ওরফে মশিউর রহমানকে হন্যে হয়ে খোঁজ করছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। দুর্ধর্ষ জঙ্গী সাগর কোথায় আত্মগোপন করে আছে সন্ধান পেতে তার স্ত্রী খাদিজাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। ১৫ দিন আগে গত ৮ অক্টোবর পুলিশ যশোরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোড মসজিদের পেছনের চার তলা ভবন ঘেরাও করে রাখার পরদিন দোতলার একটি ফ্ল্যাট থেকে আত্মসমর্পণ করাতে বাধ্য করা হয় শিশু সন্তানসহ সাগরের স্ত্রী খাদিজাকে। পুরনো জঙ্গী সংগঠন জেএমবি থেকে নব্য জেএমবিতে আসা এ ভয়ঙ্কর প্রকৃতির জঙ্গী সাগরই নাকি এখন নতুন করে জঙ্গী হামলার ছক কষছে এমন তথ্য পাওয়ার পর তার খোঁজে মাঠে নেমেছে টিসিসিটি, পুলিশ ও গোয়েন্দারা। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, সোমবার যশোরের আদালত থেকে সেখানকার পুলিশ সাগরের স্ত্রী খাদিজাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করার পর তথ্য বিনিময় করাসহ তাকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদে জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। খাদিজাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার উদেশ্য হচ্ছে তার স্বামী সাগরের সন্ধান লাভ এবং জঙ্গী সংগঠনের তৎপরতা সম্পর্কে বিশদ তথ্য ভা-ার সমৃদ্ধকরণ। খাদিজা ১৭ দিন আগে যশোরে আত্মসমর্পণ করার পর সেখানে পুলিশ তার স্বামী সাগর ও চার-পাঁচ জঙ্গীর নামে একটি মামলা দায়ের করে, যাদের খোঁজা হচ্ছে। নব্য জেএমবির অন্যতম শূরা সদস্য হাদিসুর রহমান ওরফে সাগর বিচ্ছিন্নভাবে হামলা চালাতে পারেÑ এমন আশঙ্কা রয়েছে গোয়েন্দাদের মধ্যে। এজন্য ইতোমধ্যে কয়েক সহযোগীও তৈরি করেছে সাগর। নব্য জেএমবির দক্ষিণাঞ্চলে কার্যক্রম চালানো সাগর অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। নিজের অবস্থান সম্পর্কে কোন তথ্য জানায় না সে। এমনকি নিজের দলের কাউকেও অবস্থান সম্পর্কে সঠিক তথ্য দেয় না। ঘনঘন অবস্থান পরিবর্তন করা এ জঙ্গী নেতা এখনও রয়েছে গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের বাইরে। তাকে ধরতে ইতোমধ্যে একাধিক অভিযান চালিয়েও কোন ফল পাওয়া যায়নি। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের এক কর্মকর্তা জানান, হাদিসুর রহমান সাগর মাঝারি মানের শিক্ষিত। পুরনো জেএমবি থেকে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয় সে। একপর্যায়ে নব্য জেএমবির শূরা সদস্য মনোনীত হয়। তবে নব্য জেএমবির বর্তমান প্রধান আইয়ুব বাচ্চু, শূরা সদস্য রাজিবুল ইসলাম ওরফে আর্চার ও হারিকেনের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে সাগরের। বিশেষ করে কিছুদিন আগে গ্রেফতার হওয়া নব্য জেএমবি প্রধান পরিচিত আইয়ুব বাচ্চুর সঙ্গে দ্বন্দ্ব চলছে সাগরের। একের পর এক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জঙ্গীবিরোধী অভিযানের ফলে নব্য জেএমবির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা বিবেচনা করে শূরা কমিটির বৈঠক করা সম্ভব হচ্ছে না। তাই অন্য শীর্ষ নেতাদের পাশ কাটিয়ে নিজেই এককভাবে হামলার পরিকল্পনা করছেন সাগর। সাগরের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন মামুন নামে এক জঙ্গী। সাগরের সন্ধানে ইতোমধ্যে কুষ্টিয়া ও ঝিনাইদহে একাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ধূর্ত প্রকৃতির সাগরকে ফাঁদে ফেলা সম্ভব হয়নি। সাগর জঙ্গী হামলা চালানোর মতো পরিকল্পনা নিয়েই কাজ করছে। তার অবস্থান চিহ্নিত করতে কাজ করছে বলে সিটিটিসি কর্মকর্তার দাবি। জঙ্গী তদন্তকারী সংস্থা সিটিটিসি সূত্র জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী আসলাম হোসেন ওরফে রাশেদ ওরফে র‌্যাশ ওরফে আবু জাররারকে গ্রেফতারের পর আরেক মাস্টারমাইন্ড হাদিসুর রহমান সাগরকে খুঁজছে পুলিশ। ভয়াবহ ওই জঙ্গী হামলার পরিকল্পনাকারী অন্যতমদের মধ্যে একমাত্র সাগরই এখন পলাতক। হাদিসুর রহমান সাগর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত জঙ্গীনেতা নুরুল ইসলাম মারজানের ভগ্নিপতি। রাশেদসহ গ্রেফতার হওয়া শীর্ষ জঙ্গীদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে সাগরের সম্পর্কে বিস্তর তথ্য পেলেও ঘন ঘন অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে তাকে এখনও ধরতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। জঙ্গী সাগর অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। সে নিজের অবস্থান সম্পর্কে সংগঠনের কাউকে কোন সঠিক তথ্য দেয় না। যোগাযোগ রক্ষার এ্যাপস ব্যবহারেও বিশ্বাসী নয় সে। তাই সাংগঠনিক কাজে সবার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে। ঘনঘন অবস্থান পরিবর্তন করার কারণে এ জঙ্গীনেতা এখনও গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের বাইরে রয়েছে। সাগরের অন্যতম সহযোগী শরিফুল ইসলাম খালিদসহ কয়েকজন শিবিরের সাবেক কর্মী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এ এফ এম রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে কুপিয়ে হত্যায় জড়িত খালিদের হাত ধরে নব্য জেএমবিতে আসে রাশেদ। রাশেদ গ্রেফতার হওয়ার পর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, রাজশাহীতে সাগরের সহযোগী হিসেবে যারা জেএমবিতে এসেছে তাদের অনেকে শিবিরের কর্মী। নব্য জেএববির মধ্যে এখন শিবিরপন্থীরা ঢুকে পড়েছে। তারাই মূলত এখন লিড দিচ্ছে। কে এই হাদিসুর রহমান সাগর? ধূর্ত এই জঙ্গীর প্রকৃত নাম হাদিসুর রহমান ওরফে মশিউর রহমান। সাগর তার সাংগঠনিক নাম। তার গ্রামের বাড়ি নওগাঁ জেলায়। গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মাস্টারমাইন্ড নুরুল ইসলাম মারজানের ভগ্নিপতি এ সাগর। সাগরের হাত ধরেই মারজান জঙ্গী সংগঠনে যোগ দেয়। মারজানের বোন খাদিজাও জঙ্গী সংগঠনে যোগ দেয় সাগরের হাত ধরেই। মারজানের বাড়ি পাবনায় হলেও তারা কুষ্টিয়ার সীমান্ত এলাকায় থাকত। সেই সুবাদে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী ও ঝিনাইদহে তার যাতায়াত ছিল। গুলশান হামলার আগে ঝিনাইদহে থাকা জঙ্গীদের আস্তানায় গিয়েছিল সাগর। গ্রেফতারকৃত জঙ্গী সোহেল মাহফুজ, রাজীব গান্ধী ও রাশেদকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, সাগর পুরনো জেএমবির সদস্য ছিল। ২০১৪ সালে সে নব্য জেএমবিতে যোগ দেয়। একপর্যায়ে নব্য জেএমবির শূরা সদস্য মনোনীত হয়। দায়িত্ব ছিল উত্তরাঞ্চলে। ভারতের সীমান্ত এলাকা দিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক সরবরাহের কাজ করত সে। গুলশান হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো রাশেদ ও ছোট মিজানের কাছে দেয় সাগরই। ১৫ দিন আগে যশোরের ঘোপ নওয়াপাড়া রোড মসজিদের পেছনের চার তলা ভবনের দোতলার একটি ফ্ল্যাটে স্ত্রী সন্তানসহ সাগর অবস্থান করছে এমন তথ্যের ভিত্তিতে বাড়ি ঘেরাও করে অভিযান চালানোর পর শিশু সন্তানসহ খাদিজাকে পাওয়া যায়। খাদিজার শর্তানুযায়ী তার মা ও বাবা আসলে আত্মসমর্পণে রাজি হওয়ায় মা-বাবাকে এনে তাকে আত্মসমর্পণ করানো হয়। কিন্তু অভিযানের আগেই সটকে পড়ে কয়েকজন দুর্ধর্ষ জঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে সাগর। এখন সাগরকে খুঁজে পেতে তার স্ত্রী খাদিজাকে যশোরের পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। প্রয়োজনে জঙ্গী তদন্তকারী সংস্থা সিটিটিসি খাদিজাকে ঢাকায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে বলে সিটিটিসি কর্মকর্তার দাবি।
×