ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সব বাধা বিপত্তি পেরিয়ে তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী

সবার মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে চানদৃষ্টি প্রতিবন্ধী রত্না

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

সবার মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে চানদৃষ্টি প্রতিবন্ধী রত্না

সোহেল তানভীর ॥ ‘আমার বয়সী অন্য সবাই বই পড়ত। কিন্তু আমি অন্ধ বলে তা পারতাম না। চতুর্থ শ্রেণীতে থাকতেই আমি দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলি। তখন আমি মায়ের কাছে শুনে শুনে শিখতাম আর তা নিয়েই মগ্ন থাকতাম। আমার আগ্রহ দেখে একপর্যায়ে মা আমাকে একটা মোবাইল কিনে দেয়। আর সেই মোবাইলে কেউ বই বা ক্লাস লেকচার রেকর্ড করে দিলে তা শুনেই চলেছে আমার পড়াশোনা। রেকর্ড আর ব্রেইলি পদ্ধতিতে পড়াশোনা করেই আজকে আমি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছি।’ কথাগুলো- জীবন যুদ্ধে হার না মানা আত্মপ্রত্যয়ী তরুণী রত্না বিশ্বাসের। দৃষ্টিশক্তিহীনতা কিংবা আর্থিক অনটন কোন বাধাই দমিয়ে রাখতে পারেনি রত্নাকে। নিজের প্রচেষ্টা আর মায়ের সহযোগিতায় তিনি এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে (আইইআর) চতুর্থ বর্ষে পড়ছেন। পৃথিবীর আলো তার চোখে না পৌঁছলেও জ্ঞানের আলো ঠিকই পৌঁছে গেছে তার মনের ভেতরে। আর ভবিষ্যতে সেই আলো তিনি ছড়িয়ে দিতে চান সবার মাঝে। তাই স্বপ্ন দেখেন শিক্ষক হবার। রত্নার মতো এরকম ১৮২ জন ‘বিকল্প সক্ষম ব্যক্তি’ (ডিফারেন্টলি এ্যাবল পিপল) ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে অধ্যয়ন করছেন। প্রত্যেকের রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন স্বপ্ন। এদের মধ্যে নারী শিক্ষার্থী রয়েছেন ৬১ জন। এদের মধ্যে কেউ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী, কেউ শারীরিক, কেউবা মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী। তবে এদের প্রত্যেকের জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। সেই গল্প সংগ্রামের আর হার না মানার। এদের প্রায় সবাই গরিব ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছেন। সব ধরনের বাধার পাহাড় পেরিয়ে তারা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করছেন। ইংরেজী, আইন, অর্থনীতির মতো বিভাগে পড়ছেন তারা। তবে বিশ^বিদ্যালয়ে এদের জন্য বিশেষ কোন সুযোগ না থাকায় এবং নানান ধরনের প্রতিবন্ধকতার জন্য সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে ধারাবাহিকভাবে এই সংখ্যা ব্যাপকহারে কমেছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন থেকে পাওয়া তথ্য মতে, গত ২০১৪-১৫ সেশনে ভর্তি হন ৭৬ জন বিকল্প সক্ষম ব্যক্তি। ২০১৫-১৬ সেশনে তা কমে দাঁড়ায় ২৪ জনে। ২০১৬-১৭ সেশনে আরও কমে তা গিয়ে দাঁড়ায় ১২ জন। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে দেখা গেছে, বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে ভর্তির জন্য বাংলা, ইংরেজিতে আলাদাভাবে শর্ত পূরণ করতে হয়। গত কয়েক বছর আগে এমনটা ছিল না তাদের জন্য। তখন কেবল পাস করলেই তাদের জন্য বরাদ্দ ১% কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়ে যেতেন। কিন্তু এখন পাস করার সঙ্গে সঙ্গে শর্ত পূরণ করতে হচ্ছে। ফলে এদের পরিসংখ্যানটা আগের তুলনায় ব্যাপক হারে কমে যাচ্ছে। অন্য শিক্ষার্থীরা ভর্তি পরীক্ষায় যুদ্ধ করে আসেন। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভর্তি পরীক্ষায় যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক, অর্থনৈতিক, শারীরিক ও মানসিক বাধার সঙ্গেও যুদ্ধ করতে হয়। বিশ^বিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এরা নিয়মিত ক্লাস করেন এবং স্ব স্ব বিভাগের সেমিনার থেকে নিয়মিত বই পড়েন। ফলস্বরূপ তাই বিভাগেও ভাল ফল করছেন। এদের অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জীবনে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এবং জীবনের সঙ্গে সংগ্রাম করে তারা বিশ^বিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত এসেছেন। তাই যেকোন প্রকারেই হোক তাদের লক্ষ্যে তারা অবশ্যই পৌঁছবেন। ভাল চাকরি-বাকরি করে দেশের সেবা করাই তাদের লক্ষ্য। তারা আরও জানান, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার আগে সবাই মনে করতেন সারাজীবন অন্যের ওপর নির্ভর করে তাদের চলতে হবে। অন্যরা তাদের ভরণপোষণ করবেন। তাই তাদের নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রপ আর অবজ্ঞা করত বন্ধু-বান্ধব, সমাজ এমনকি পরিবারের অনেকে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার পরে তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন হয়েছে। এখন তাদের শ্রদ্ধা করে এবং তাদের নিয়ে পরিবার ও সমাজের রয়েছে অনেক বড় স্বপ্ন। নানা সমস্যায় রয়েছেন প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা ॥ কোটা পদ্ধতিতে এদের জন্য ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে বিশেষ কোন সুবিধা নেই। তাছাড়া, ক্লাসে আসতে রাস্তায় অনেক সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। বিশ^বিদ্যালয়ে রাস্তাগুলো উঁচু-নিচু, অনেক জায়গায় রয়েছে বড় বড় গর্ত। তাছাড়া যেখানে সেখানে রয়েছে ময়লার স্তূপ। এছাড়াও বিশ^বিদ্যালয়ের অনেক ভবনে নেই কোন রেলিং সিস্টেম। ফলে ক্লাসে যেতে হলে আরও দুই জনের সাহায্য নিতে হচ্ছে। পরীক্ষার সময় যেন এই ভোগান্তি আরও বেড়ে যায়। তবে বিশ^বিদ্যালয়ে নতুন নতুন যে ভবন নির্মিত হচ্ছে সেখানে প্রতিবন্ধীদের সুবিধার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানান কর্তৃপক্ষ। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা জানান, ভর্তির পর তাদের কোন খোঁজ-খবর রাখে না কর্তৃপক্ষ। আর্থিক কোন সহযোগিতাও পান না তারা। আর্থিক সমস্যাসহ অনেক সমস্যাই এখন তাদের বাধা। এছাড়া চলাচল, সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে ক্লাস করা তাদের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবন্ধীদের বন্ধু ডিইউপিডিএফ ॥ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের যাবতীয় কাজে সহযোগিতা করার জন্য ২০০৮ সালে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় পিডিএফ। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য কাজ করছে ডিইউপিডিএফ। সংগঠনটিতে বর্তমানে রয়েছেন ১৮০ জন সদস্য। সংগঠনটি প্রতিবন্ধীদের নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে নিয়ে যাওয়া, ক্লাস লেকচার রেকর্ড করে দেয়া, শ্রুতি লেখক হিসেবে তাদের হয়ে পরীক্ষা দেয়াসহ প্রতিবন্ধীদের যেকোন প্রয়োজনে সার্বক্ষণিক কাজ করছে সংগঠনটি। এছাড়া প্রতিবন্ধীদের হলে তুলে দেয়া, পরীক্ষা সংক্রান্ত যেকোন কাজে সহযোগিতা করা ও বিভাগে যেকোন সমস্যায় সহযোগিতা করছে সংগঠনটি। সংগঠনটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান শাকিল জনকণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিবন্ধীরা আমাদেরই ভাই। এদের দেখাশোনার দায়িত্ব আমাদেরই। আমাদের একটু সহযোগিতায় শিক্ষিত হয়ে এরা যদি দেশকে কিছু দিতে পারে তাহলে সেটাই হবে আমাদের স্বার্থকতা।’ মায়ের কষ্ট আর পরিশ্রমের ফলে রত্না আজ ঢাবির শিক্ষার্থী ॥ বাবা-মায়ের আদরের সন্তান রত্না। ছোট বেলা থেকে পরিবারে হেসে খেলে বড় হয়েছেন। বাবা কৃষিকাজ করে তার পড়াশোনার খরচ চালাতেন। কিন্তু অল্প বয়সে বাবার মৃত্যু হয়। সংসারে নেমে আসে দুর্দিন। ঠিকমতো খেয়ে পরে বেঁচে থাকাই তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। মা অন্যের জমিতে কাজ করে সংসারের হাল ধরেন। এদিকে, চতুর্থ শ্রেণীতে থাকতে রত্নার চোখ দুটো নষ্ট হয়ে যায়। আজীবনের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারায়। কিন্তু তার মনোবল ভেঙ্গে যায়নি। অদম্য সাহস আর আগ্রহ ছিল পড়াশোনায়। নিজের অদম্য সাহসকে পুঁজি করে আর মায়ের সহযোগিতায় একে একে প্রাইমারী, এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় সফলতার সঙ্গে অতিক্রম করেন। কিন্তু এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। স্কুল-কলেজে থাকতেই বিয়ে হয়ে যায় তার বান্ধবীদের। আত্মীয়-স্বজনরা রত্নার বিয়ের জন্য মা লতা সরকারকে তাড়া দেয়। লতা কিছুটা পড়াশোনা করেছেন। বাল্য বিবাহ সম্পর্কে ছিলেন সচেতন। তাই তিনি ছিলেন অনড়। যেকোন মূল্যে মেয়েকে তিনি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াবেন। কেঁদে কেঁদে রত্না বলেন, ‘আমার মা জীবনে কোন দিন সুখ করতে পারে নাই। আমার মায়ের জ¦র থাকলেও তিনি একটু বসে থাকতে পারতেন না। তিনি মাঠে রোদে পুড়ে কাজ করেছেন আমার মুখে খাবার তুলে দেয়ার জন্য।’ অবশেষে সফল হন লতা সরকার। ২০১৪ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেন রত্না। হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সঙ্গে ভর্তিযুদ্ধে উত্তীর্ণ হয়ে রত্না এখন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। প্রতিবন্ধিত্ব আর আর্থিক সমস্যাকে জয় করে রত্নার স্বপ্ন এখন শিক্ষক হবার। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললেও হারায়নি তার মনোবল। আর তাই অন্যের ঘাড়ে বোঝ না হয়ে থেকে এগিয়ে গিয়েছেন দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে। জগতের আলো তার চোখে না পৌঁছলেও জ্ঞানের আলো ঠিকই পৌঁছে গেছে তার মনের ভেতরে। আর ভবিষ্যতে সেই আলো তিনি ছড়িয়ে দিতে চান সবার মাঝে। স্বপ্ন দেখেন শিক্ষক হওয়ার। তবে রত্নার মনে সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা কাজ করে বলে জানালেন তিনি। তিনি বলেন, আমি অন্ধ আমি কি শিক্ষক হতে পারব? চাকরির বাজারে কি আমার জায়গা হবে? সমাজ কি আমাকে শিক্ষক হিসেবে মেনে নেবে? বন্ধুদের রেকর্ড করে দেয়া একটি বইয়ের রেকর্ড শুনতে শুনতে রত্না বলেন, জীবন যুদ্ধে যখন নেমেছি তখন জীবনের বাকিটা পথও যুদ্ধ করে সফলতা ছিনিয়ে আনতে চাই। শিক্ষক হয়ে জ্ঞানের আলো ছড়াতে চাই মানুষের মাঝে। জীবনযুদ্ধে জয়ী অদম্য তরুণ সুরমান আলী ॥ সুরমান আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। নাটোরের বড়াই গ্রাম উপজেলার মেরিগাছা গ্রামের তরুণ সুরমান আলীর শৈশব ছিল না আর দশটা শিশুর মতো। যখন তিনি মায়ের কোলে তখন তার চোখে ধরা পড়ে ছানি সমস্যা। যার ফলে খুব অল্প বয়সে চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন তিনি। জনকণ্ঠকে দেয়া সাক্ষাতকারে সুরমান বলেন, ছোট থেকেই আমার চোখে ছানি। চারবার অপারেশন হয়েছে। কিন্তু সারেনি। ডাক্তার বলছে সারবে, কিন্তু যে জন্ম থেকে অন্ধ তার চোখ সারবে না। দৃষ্টিশক্তিহীনতা রুখতে পারেনি সুরমান আলীর মনের দেখার ক্ষমতাকে। জগতের আলো তার চোখে না পৌঁছলেও জ্ঞানের আলো ঠিকই পৌঁছে গেছে তার মনের ভেতরে। আর ভবিষ্যতে সে আলোই তিনি ছড়িয়ে দিতে চান সবার মাঝে। স্বপ্ন দেখেন শিক্ষক হওয়ার। দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেললেও হারায়নি তার মনোবল।
×