ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

গল্প ॥ টুপিটুন

প্রকাশিত: ০৫:১২, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

গল্প ॥ টুপিটুন

সামিহার বিছানাজুড়ে উপহারের প্যাকেট ছড়িয়ে আছে। সে একটা একটা করে রঙিন প্যাকেটগুলো খুলে দেখছে। আজ তার জন্মদিন ছিল। জন্মদিনে পাওয়া উপহারগুলোই খুলে দেখছে সে। সামিহা অনেক সুন্দর সুন্দর উপহার পেয়েছে। স্কুলব্যাগ, কলমদানি, ঘড়ি, নানারকম খেলনা, আরও কত কী! একটা রঙিন কাগজে মোড়ানো বক্স খুলে একটা সুন্দর কোঁকড়া চুলের পুতুল পাওয়া গেল। সামিহা সেটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে বলল, বাহ! সুন্দর তো পুতুলটা! তারপর সেটা একপাশে রেখে দিয়ে আবার বাকি উপহারগুলো খুলতে লাগল সে। উপহারগুলো দেখতে দেখতে এলোমেলো বিছানায়ই ঘুমিয়ে পড়ল সামিহা। আম্মু এসে বিছানাটা পরিষ্কার করে গায়ে একটা চাদর টেনে দিয়ে গেলেন। ক্লান্ত সামিহা অবশ্য সেসব কিছুই টের পেল না। সকালে যখন তার ঘুম ভাঙল, তখন সে দেখল বিছানার পাশে সুন্দর করে সব উপহার সাজিয়ে রাখা। আম্মু দরজার ওপাশ থেকে উঁকি দিয়ে বললেন, ঘুম ভেঙেছে? নাস্তা করতে আয়। আর ঘরটা কী করে রেখেছিলি কালকে? গুছিয়ে দিয়েছি দ্যাখ, আবার নোংরা করবি না কিন্তু। সামিহা আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠল। হাতমুখ ধুয়ে নাস্তা করে গতকাল উপহার পাওয়া কিছু খেলনা নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসল। ভাগ্যিস আজকে স্কুল ছুটি! নাহলে এগুলো নিয়ে সে সকাল সকাল খেলতে বসতে পারত না। বারান্দায় বসে সামিহার একটা টবের দিকে চোখ পড়ল। টবে একটা সুন্দর ঝাঁকড়া গাছ। ছোট ছোট বেগুনি ফুল। গতকাল তার জন্মদিনে ছোট মামা এনেছিল। সামিহা আপন মনেই প্রশ্ন করল, এটা কী গাছ? আগে দেখিনি তো! কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে মিনমিনে গলায় কে যেন বলে উঠল, এই গাছটার নাম পানিকা। সামিহা এদিক-ওদিক তাকাল। কই? কোথাও কেউ নেই তো! আম্মু কি তার সঙ্গে দুষ্টুমি করছে? সে বারান্দা থেকে উঠে ঘরে এল। নাহ! আম্মুও তো নেই আশপাশে। তাহলে কে বলল কথাটা? সামিহা ভাবল, সে হয়ত ভুল শুনেছে। ব্যাপারটা মাথায় না নিয়ে আবার বারান্দায় গিয়ে বসল সে। বেগুনি ফুলের গাছটার পাশেই আরেকটা গাছের চারা। একটু লতানো গাছটা, পাতাগুলো খুব একটা বড় না। এটাও ছোট মামাই এনেছে। সামিহা গাছটার দিকে তাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বলল, ধ্যাত! আমি কোন গাছই চিনি না! কথাটা বলতেই আবার সেই মিনমিনে কণ্ঠটা বলল, এটা অপরাজিতা। নীল ফুল ফোটে। সামিহা এবার সত্যি চমকে উঠল। সে তো ভুল শুনছে না। কে বলছে তাহলে কথাগুলো? এদিক-ওদিক তাকিয়ে কাউকে না দেখে সে এবার জিজ্ঞেস করল, কে কথা বলে? মিনিমিনে গলাটা বলল, আমি টুপিটুন। অনেক দূরের একটা গ্রহ থেকে এসেছি। সামিহা জিজ্ঞেস করল, কিন্তু তুমি কোথায়? কণ্ঠটা বলল, আমি তোমার কোঁকড়া চুলের পুতুলের মধ্যে। এ পুতুলটার মধ্যে আমার সিস্টেম ইনস্টল করে দেয়া হয়েছে। সামিহা এবার পাশে পড়ে থাকা পুতুলটার দিকে তাকাল। খুব সাধারণ একটা পুতুল। সামিহা একটু ভয়ে ভয়ে সেটাকে হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে সেটার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি হাঁটাচলা করতে পার? পুতুলের ভেতর থেকে টুপিটুন বলল, হ্যাঁ, পারি। কিন্তু আমি হাঁটাচলা করলে তো কেউ দেখে ফেলতে পারে। সেটা আমার গবেষণার জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। সামিহা অবাক হয়ে বলল, গবেষণা? কিসের গবেষণা? তুমি কি এলিয়েন? ভিনগ্রহ থেকে এসে মানুষের ওপর গবেষণা করছ? টুপিটুন একটা যান্ত্রিক হাসি হাসল। তারপর বলল, না। আমি একটা রোবট। আমি মানুষের ওপর গবেষণা করতে আসিনি। আমি এসেছি পৃথিবীর গাছপালার ওপর গবেষণা করতে। এ গাছগুলো কেন আমাদের গ্রহে হয় না, কী করলে আমরা ওখানে এসব গাছপালা বাঁচিয়ে রাখতে পারি- এ বিষয়ে গবেষণা করতে এসেছি। সামিহা বলল, ও আচ্ছা! কিন্তু তুমি এ গাছগুলোর বাংলা নামও জানো? টুপিটুন বলল, হ্যাঁ। আমার মেমরিতে পৃথিবীতে ব্যবহৃত ১০৬টা ভাষা ইনস্টল করা আছে। আমি এই ১০৬টা ভাষাই জানি। আর পৃথিবীর গাছপালাগুলো সম্পর্কে সব তথ্যই আমি জানছি। যেকোন গাছ দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমি সেটাকে স্ক্যান করে সেটার সব তথ্য জেনে নিতে পারি। তারপর সেই তথ্য আমার মেমরিতে সেইভ করে রাখি। সামিহা বলল, মজার ব্যাপার তো! তাহলে তো তুমি আমাকে অনেক গাছ চিনাতে পারবে টুপিটুন! টুপিটুন বলল, হ্যাঁ। যতদিন আমি এখানে থাকব, ততদিন আমি তোমাকে অনেক গাছ চিনাব। শোনো সামিহা, তোমরা বেশি করে গাছ লাগাবে। গাছ আছে বলেই পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে আছে। আর গাছ নেই বলে আমাদের গ্রহে অনেক প্রাণীর অস্তিত্ব নেই। ওখানে এত সুন্দর বাতাস বয় না, এত সুন্দর ফুলও ফোটে না। শুধু ধু ধু মরুভূমি আর প্রচণ্ড গরম। তাই আমাদের গাছ লাগাতে হবে। সেজন্য আমাকে গাছ সম্পর্কে জানতে পাঠানো হয়েছে। সামিহা বলল, ও আচ্ছা। তুমি কতগুলো গাছ সম্পর্কে জানলে? টুপিটুন বলল, অ্যামাজন জঙ্গলের সব গাছের তথ্য নিয়ে এসেছি। আফ্রিকা, আমেরিকার গাছগুলোর তথ্যও নিয়ে এসেছি। বাকিগুলো এক এক করে নিচ্ছি। সামিহা বেশ মজা পেল। তার কয়েকটা দিন কেটে গেল টুপিটুনের সঙ্গে। টুপিটুনকে সে পার্কে নিয়ে গেল নানা ধরনের গাছ দেখাতে। টুপিটুনের কাছ থেকে নতুন নতুন গাছ চিনে আর গাছের সম্পর্কে অনেক মজার মজার তথ্য জেনে সামিহার আনন্দে দিন কাটতে লাগল। সেদিন স্কুল থেকে ফিরে প্রতিদিনের মতো সামিহা তার কোঁকড়া চুলের পুতুলটা হাতে নিল। চোখ বড় বড় করে বলল, টুপিটুন, আজকে আমরা বোটানিক্যাল গার্ডেনে যাব। ওখানে অনেক গাছ, জানো! টুপিটুন কোন কথা বলল না। সামিহা বলল, কী হলো? কিছু বলছ না যে? টুপিটুন এবারও কোন উত্তর দিল না। সামিহা অনেকক্ষণ টুপিটুনকে ডাকাডাকি করল, অনেক কথা বলল। টুপিটুন কোন উত্তর দিল না। সামিহা খুব মন খারাপ করে বারান্দায় গিয়ে অপরাজিতা গাছটার পাশে বসল। গাছটায় আজকে প্রথম ফুল ফুটেছে। টুপিটুন যেমন বলেছিল, তেমন নীল ফুল। টুপিটুন আর সামিহা প্রতিদিন অপেক্ষা করে থেকেছে এই গাছটায় ফুল ফোটার জন্য। আজকে গাছটায় ফুল ফুটেছে। কোথায় সামিহা আর টুপিটুন অনেক আনন্দ করবে, টুপিটুনটা কোন কথাই বলছে না! টুপিটুন কি ঘুমাচ্ছে? কখন তার ঘুম ভাঙবে? সামিহা অপেক্ষা করতে লাগল। সে টুপিটুনকে কোলে নিয়ে অপরাজিতা ফুলটার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। তার জানা হলো না, টুপিটুনের এই দেশের সব গাছপালা সম্পর্কে জানা শেষ। তাই তার গ্রহের সেন্ট্রাল কন্ট্রোল ইউনিট থেকে তাকে ইনএক্টিভ করে দেয়া হয়েছে। তার সিস্টেম ইনস্টল করে দেয়া হয়েছে জাপানের এক ছোট্ট শহরের একটা পুতুলের মধ্যে। টুপিটুন সামিহার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় পায়নি। তাকে সেই সময় দেয়া হয়নি। তাদের গ্রহের সবাই জানে তাদের রোবটগুলো অনেক উন্নত, কিন্তু জানে না টুপিটুন নামের রোবটটার অনুভূতি নামক জিনিসটাও আছে। তারা জানে না, জাপানের ছোট্ট শহরের ছোট্ট পুতুলটার মধ্যে ইনস্টল করা টুপিটুনের মন আছে, আর সেই মন পড়ে আছে ঢাকার একটা ছোট্ট বারান্দায়; একটা ছোট্ট মেয়ের কাছে, একটা নীল অপরাজিতা গাছের কাছে। ভিকারুননিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজ, একাদশ শ্রেণি (ইংরেজি ভার্সন) অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×