ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

টক অব দ্য কান্ট্রি

একশ্রেণীর পুলিশের অপকর্মে ক্ষুন্ন হচ্ছে বাহিনীর ভাবমূর্তি

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

একশ্রেণীর পুলিশের অপকর্মে ক্ষুন্ন হচ্ছে বাহিনীর ভাবমূর্তি

শংকর কুমার দে ॥ ‘রক্ষকই যখন ভক্ষক’ একশ্রেণীর অসৎ, দুর্নীতিবাজ পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে একের পর এক অভিযোগের ঘটনায় গোটা বাহিনীর ভাবমূর্তি অনেকটাই ক্ষুন্ন। পুলিশের সদস্য বৃদ্ধির সঙ্গে অপরাধ প্রবণতাও বৃদ্ধি পাওয়ার ঘটনা এখন উদ্বেগজনক। বৃহস্পতিবার টেকনাফের এক ব্যবসায়ীকে অপহরণের পর মুক্তিপণের ১৭ লাখ টাকাসহ সেনাবাহিনীর হাতে আটক জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ৭ সদস্যকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানোর ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। পুলিশ বাহিনীর একশ্রেণীর অসৎ ও দুর্নীতিবাজ সদস্যের বিরুদ্ধে খুন থেকে শুরু করে গ্রেফতারবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানিসহ সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা ঘটছে। পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেলসহ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা পুলিশের বিরুদ্ধে এমন ব্যাপক ধরনের নানা অপরাধের তদন্ত করতে হিমশিম খাচ্ছেন বলে পুলিশ কর্মকর্তাদেরই দাবি। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় দুই লাখ ছাড়িয়ে যাবে। ২০১১ থেকে ’১৬ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে লক্ষাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। অর্ধ লক্ষাধিক পুলিশের বিরুদ্ধে গুরুদন্ড ও লঘুদন্ড কিংবা দুই ধরনের দ- দেয়া হয়েছে। শর্ষের মধ্যে ভূত যে পুলিশ দিয়ে অপরাধ দমন করা হবে সেই পুলিশেরই একাংশ বিপথগামী হয়ে জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধে। পুলিশ সদর দফতরের সিকিউরিটি সেল ও ডিসিপ্লিনারি বিভাগে জমা পড়া অভিযোগগুলো তদন্তাধীন। ‘জনগণের বন্ধু’ বলে দাবিদার পুলিশের এমন বেপরোয়া কর্মকা-ে খোদ বাহিনীতেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য পৃথক কোন তদন্ত সংস্থা নেই। এ কারণে অনেকক্ষেত্রেই তদ্বির করে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অভিযোগ থেকে পার পেয়ে যাওয়ার অভিযোগ অন্তহীন। অপরাধ দমনই যাদের কর্তব্য সেই পুলিশ নিজেরাই যেভাবে একের পর এক অপরাধে জড়াচ্ছে তা নিঃসন্দেহে উদ্বেগজনক। চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ব্যবসা, শ্লীলতাহানি সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে পুলিশ সদস্যের নাম। কনস্টেবল থেকে পদস্থ কর্মকর্তা, বাদ নেই কেউ-ই। কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের কর্মকান্ড পেশাদার অপরাধীদেরও হার মানাচ্ছে। অপরাধীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হলেও কমছে না অপরাধপ্রবণতা। আর কতিপয় সদস্যের অপকর্মের দায় নিতে হচ্ছে গোটা পুলিশ বাহিনীকে। পুলিশ সদর দফতরের এক পরিসংখ্যান থেকে জানা গেছে, ২০১১ থেকে ১৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত ৬ বছরে নানা অপরাধে ৭৬ হাজার ৪২৬ পুলিশকে অর্থদ-, তিরস্কার, বদলি, বরখাস্ত, বাধ্যতামূলক অবসর ও চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। শাস্তি পাওয়াদের মধ্যে ৭৬ হাজার ৯৯ কনস্টেবল থেকে উপপরিদর্শক পদমর্যাদার। আর পরিদর্শক থেকে তদুর্ধ পর্যায়ের কর্মকর্তা ৩২৭। অপরাধে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারিসহ বিভাগীয় মামলায় বিচারে সাজা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু অপরাধে জড়ানোর হার কমছে না। মাঠ পর্যায়ে কতিপয় পুলিশ সদস্য ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণের মতো অপরাধ করছে। তাছাড়া অপরাধী গ্রেফতারে সোর্স হিসেবে যাদের রাখা হয় তাদের ব্যবহার করে পুলিশ সদস্য অপরাধ ঘটাচ্ছে। গত বুধবার ভোরে টেকনাফে ব্যবসায়ী আব্দুল গফুরকে জিম্মি করে ১৭ লাখ টাকা আদায় করার পর একটি মাইক্রোবাসে কক্সবাজারে যাওয়ার পথে চেকপোস্টে তল্লাশির সময় ১৭ লাখ টাকাসহ ৭ ডিবি পুলিশকে আটক করে সেনা সদস্যরা। এ সময় ডিবি পুলিশের এক এসআই পালিয়ে যায়। উদ্ধার করা টাকা ওই ব্যবসায়ীকে ফেরত দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার টেকনাফের ব্যবসায়ী আব্দুল গফুরকে অপহরণের পর মুক্তিপণের ১৭ লাখ টাকাসহ সেনাবাহিনীর হাতে আটক জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) ৭ সদস্যকে পরে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানোর ঘটনাটি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। অভিযুক্ত ডিবি পুলিশের সদস্যরা হলো এসআই মনিরুজ্জামান, এসআই আবুল কালাম আজাদ, এসআই ফিরোজ, এএসআই মোস্তফা, এএসআই আলাউদ্দিন, সিপাহী আলামিন ও সিপাহী মোস্তফা আজম। এখন সবাই কক্সবাজার কারাগারে। এ ঘটনায় জেলা পুলিশের ৭ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এ ঘটনার মাত্র দুই দিনের ব্যবধানে ফরিদপুরের পুলিশ সুপার সুভাষ সাহার বিরুদ্ধে ঘুষের মাধ্যমে আদায় করা ৮ কোটি টাকার এফডিআর পাওয়ার পর তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে এই ধরনের অপরাধপ্রবণতায় জড়িয়ে পড়ার ঘটনা খোদ পুলিশ প্রশাসনেই তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ১০ হাজার এবং ডিসেম্বরে ১০ হাজার নিয়োগ দেয়ায় এখন পুলিশ সদস্যের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭৭ হাজার। চলতি বছর পুলিশ বাহিনীতে আরও ৪০ হাজার নিয়োগ দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। এতে ২০১৭ সালেই পুলিশ বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ২ লাখ ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একের পর এক জঙ্গী ও সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান, মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানোর অধিকারী পুলিশ বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগে পুলিশ বাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। পুলিশের সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের পর তদন্ত কমিটি হয়, তদন্ত হয়। কিন্তু অধিকাংশ তদন্ত প্রতিবেদনই থেকে যায় আড়ালে। শাস্তিও হয় না তেমন একটা। প্রত্যাহার, সাময়িক বরখাস্ত, বদলি এর মধ্যেই আটকে থাকে। একশ্রেণীর অসাধু পুলিশ সদস্যের নানা অপকর্ম, অনিয়ম ও অপরাধের কারণে সরকারী সংস্থাটি এখন নানা প্রশ্নের মুখে। পুলিশের অপরাধ প্রমাণের পরে মাঝেমধ্যে শাস্তি হলেও থেমে নেই পুলিশের অপরাধমূলক কর্মকা-। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় প্রতিদিনই চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসা, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, নির্যাতন, আটক করে ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়াসহ প্রচুর অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এ অভিযোগের মাত্রা বেড়েই চলেছে। কিছু কিছু অভিযোগ পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নজরে এলেও অনেক ঘটনাই থেকে যায় লোকচক্ষুর আড়ালে। রাজনৈতিক তদ্বিরে নিয়োগ, বদলি পদোন্নতির কারণে অনেক পুলিশ সদস্যই তাদের উর্ধতন কর্মকর্তাদের পর্যন্ত পাত্তা দিচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে। ভুক্তভোগী অভিযোগকারীরা বলছেন, পুলিশ এখন বেপরোয়া। গত বছর ব্যাংক কর্মকর্তা ও সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তাকে নির্যাতনের দায়ে মোহাম্মদপুর ও যাত্রাবাড়ী থানার দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্তের ৩ দিনের মাথায় এবার ধর্ষণের অভিযোগে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জসহ ৫ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আদালতে মামলার জন্য অভিযোগ এসেছে। ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অবনী শংকরসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঢাকার একটি আদালতে মামলা দায়ের করা হয়েছে। গত বছরের ৯ জানুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বী টহল পুলিশের নির্যাতনের শিকার হন। রাব্বী অভিযোগ করেন, মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ শিকদারসহ পুলিশ ও আনসারের পাঁচ সদস্য তাকে আটকের পর ৫ লাখ টাকা দাবি করে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। এর ৫ দিন পর ১৫ জানুয়ারি ভোরে রাজধানীর মীর হাজীরবাগে কর্তব্যরত সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা বিকাশ চন্দ্র দাসকে পিটিয়ে আহত করে পুলিশ। যাত্রাবাড়ী থানার এসআই আরশাদ হোসেন আকাশের নেতৃত্বে ৫ থেকে ৬ পুলিশ বিকাশকে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে মারধর করে বলে অভিযোগ করেন বিকাশ চন্দ্র দাস। পুলিশের প্রহারে আহত এ দুজন বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। একই দিন গভীর রাতে কমলাপুর রেল স্টেশনে ওভারব্রিজের ওপর এক হিজড়াকে যৌন হয়রানি ও মারধর করার অভিযোগ ওঠে। কমলাপুর রেল পুলিশের কয়েক সদস্যের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনেন হান্নান ওরফে টোকাই হান্নান নামে এক হিজড়া। গত বছরে সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন হত্যার ঘটনায় জালালাবাদ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আলমগীর হোসেনকে প্রত্যাহার এবং উপপরিদর্শক আমিনুল ইসলাম ও জাকির হোসেনকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। তদন্তে পুলিশের গাফিলতির প্রমাণ মিলেছে বলে জানা যায়। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তাকে নির্যাতন করার অভিযোগে যাত্রাবাড়ী থানার এসআই আরশাদ হোসেন আকাশকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা গোলাম রাব্বীকে মারধর, হত্যার হুমকি ও চাঁদার দাবিতে মোহাম্মদপুর থানার এসআই মাসুদ শিকদারকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমরা স্বীকার করি অল্প কিছু পুলিশের অপেশাদার আচরণ ও নৈতিক স্খলন পুরো বাহিনীর বড় বড় অর্জনকে ম্লান করে দিচ্ছে। আমরা বলছি শৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর অবস্থানে রয়েছে পুলিশ। ব্যক্তি পুলিশের দায় বাংলাদেশ পুলিশ কখনও নেবে না। পুলিশের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অনুসন্ধান করে বিভাগীয় কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়ে থাকে। কোন পুলিশ কর্মকর্তা বা সদস্যের অপরাধ বা অভিযোগের দায় গোটা বাহিনী বহন করবে না। পুলিশ বাহিনীর কোন সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে কর্তৃপক্ষ তা কোন অবস্থাতেই হালকা করে দেখে না। গত ৫ বছরে মোট ৭০৯ পুলিশের বিরুদ্ধে বিচার বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এদের মধ্যে ২৯৩ পুলিশ সদস্য বিচার বিভাগীয় শাস্তির বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে আপীল করে দন্ড থেকে অব্যাহতি পেয়েছে। শৃঙ্খলার বিষয়ে পুলিশকে একটুও ছাড় দেয়া হয় না। জঙ্গীবাদ দমনে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ছাড়া সকল ক্ষেত্রেই পুলিশ সফল হওয়ার দৃষ্টান্ত স্থাপনসহ দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়ানোর উদাহরণও আছে।
×