ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাখাইনে নির্যাতন বন্ধ হলেও অনুপ্রবেশ থামছে না

প্রকাশিত: ০৪:৪২, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

রাখাইনে নির্যাতন বন্ধ হলেও অনুপ্রবেশ থামছে না

হাসান নাসির/এইচএম এরশাদ ॥ রোহিঙ্গাদের ফেরাতে দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপাক্ষিক আলোচনায় অগ্রগতির প্রেক্ষিতে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে এখন নানামুখী ভাবনা। আশ্রিত রোহিঙ্গারা নাগরিকত্ব এবং সমান অধিকার পেতে যাচ্ছে কিনা, আর তেমন সুযোগ নিশ্চিত না হলে তাদের ফিরে যাওয়ার আগ্রহ রয়েছে কিনা সেটাই এখন আলোচনার বিষয়। কেননা, শুরু থেকেই রোহিঙ্গারা বলে আসছে যে, অধিকার নিশ্চিত না হলে তারা বাংলাদেশেই থেকে যেতে চায়। অনুপ্রবেশ করা প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে ঢুকেছে রাখাইনে সক্রিয় বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরাও। তাছাড়া দেশে সক্রিয় কিছু গোষ্ঠীর ইন্ধনও রয়েছে। এদিকে, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত উত্তর রাখাইনে কোন ধরনের নির্যাতন বা লুটপাট যেন না চলে সেজন্য স্থানীয়দের সতর্ক করে দিয়েছে প্রশাসন। রাখাইন রাজ্য থেকে আংশিক সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণাও দিয়েছে দেশটির সরকার। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন ভালর দিকে। কিন্তু এর মধ্যেও বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এ অবস্থায় উখিয়া এবং টেকনাফের স্থায়ী বাসিন্দাদের দাবিÑ সীমান্তে কড়াকড়ি আরোপ করা হোক। কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় দায়িত্ব পালনরত বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, মিয়ানমারের রাখাইনে নির্যাতন বন্ধ হলেও প্রতিদিনই বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঘটে চলেছে। আগের মতো না হলেও এখনকার আগমনকে দেখা হচ্ছে বেশ পরিকল্পিত হিসেবে। এখন তারা আসছে পরিবার নিয়ে গ্রুপে গ্রুপে, যাদের অনেক স্বজন পূর্বেই এসেছে। সীমান্তে সতর্কাবস্থা তেমন না থাকায় বিনা বাধায় তারা আসতে পারছে। অতি সম্প্রতি বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফরে ফলপ্রসূ আলোচনা এবং যুক্ত বিবৃতির পর রাখাইনে নিপীড়ন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সীমান্তে এখন কড়াকড়ি এবং নজরদারি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করছে স্থানীয়রা। স্থানীয় অধিবাসীদের অভিযোগ, এখন যারা আসছে তারা নির্যাতিত নয়। অতীতের অভিজ্ঞতা বলছে, মিয়ানমার থেকে যত রোহিঙ্গা আসে তার অর্ধেকও ফেরত যায় না। এবার প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার সরকার যুক্ত করতে চাইছে নাগরিকত্বের প্রমাণসহ নানা শর্ত। যদি তাই হয় তবে প্রত্যাবাসিত অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা হবে পূর্বের চেয়েও অনেক কম। ভেতরে প্রবেশের সুযোগ দিয়ে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে ফেরত পাঠানোর চেয়ে বরং অনুপ্রবেশ ঠেকানো জরুরী হয়ে পড়েছে। রাখাইনে নির্যাতন বন্ধে প্রশাসনের নির্দেশ জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার চাপ এবং বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের মিয়ানমার সফরের পর পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে যাচ্ছে, এমনই প্রতীয়মান। নির্যাতন বন্ধ হয়েছে রাখাইনে। অভিযান বন্ধ হলেও এতদিন ধরে সেনা ইন্ধনে উগ্রবাদীদের তৎপরতা ঠিকই চলে আসছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে এ ধরনের তৎপরতা বন্ধ। নানামুখী চাপে প্রশাসনও এখন সতর্ক। রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিতরণ করা হচ্ছে স্থায়ী বসতি কার্ড (এনএসভি)। যদিও এতে নাগরিকত্বের ঘরটিতে বাংলাদেশী উল্লেখ রয়েছে বলে তথ্য রয়েছে। রোহিঙ্গাদের দুরবস্থা দেখতে যেতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার কর্মীদের যেভাবে বাধা প্রদান করা হচ্ছিল স্থানীয় উগ্রবাদীদের পক্ষ থেকে সে বিষয়েও সতর্কতা জারি হয়েছে। ফলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও সাহায্য সংস্থাগুলোর জন্য রাখাইনে তৎপরতা চালানো অচিরেই সম্ভব হবে বলে ধারণা দিয়েছে বিভিন্ন সূত্র। এর আগে বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যভিত্তিক এনজিও সংস্থা রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের (আরআই) কিছু কর্মী উত্তর রাখাইনে যেতে চাইলে তারা উগ্র মগদের বাধার মুখে পড়েন। রাখাইনে শহরের আইডিপি ক্যাম্পে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য কিছু ত্রাণ নিয়ে যায় রিলিফ ইন্টারন্যাশনালের ১০ জনের একটি দল। কিন্তু উগ্রপন্থীদের বাধার কারণে ওই এনজিও কর্মীরা ফিরে যেতে বাধ্য হন। তবে ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে বলে আভাস দিচ্ছে সংস্থাগুলো। মিয়ানমারের এক বার্মিজ মুসলমান নেতা জানান, দেশটির ১৩টি প্রদেশে বার্মিজ মুসলমানরা বসবাস করেন। শুধু রাখাইন রাজ্যে বসবাস রোহিঙ্গা মুসলিমদের। বার্মিজ মুসলমানরা দক্ষিণ এবং কেন্দ্রীয় মিয়ানমারে বাস করেন। তাদের নাগরিকত্বও রয়েছে মিয়ানমারে। নাগরিকত্ববঞ্চিত শুধু রাখাইন রাজ্যে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা। ২০১৫ সালের নির্বাচনে মুসলিমদের পক্ষ থেকে একজন নেতা দাঁড় করানোর পরিকল্পনা থাকলেও তা সম্ভব হয়নি নাগরিকত্ব এবং ভোটাধিকার বাতিল হয়ে যাওয়ায়। রাখাইন থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা আন্তর্জাতিক চাপ এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অগ্রগতির ধারায় রাখাইনের মংডু ও বুচিদং শহর থেকে কিছুসংখ্যক সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। বৃহস্পতিবার দেশটির সেনাপ্রধানের কার্যালয় এই তথ্য জানিয়েছে। সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাংয়ের কার্যালয় সূত্র জানায়, রাখাইনের মংডু ও বুচিদং শহরে ক্লিয়ারেন্স অভিযানে কিছু সেনা প্রত্যাহার করা হবে। মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচি এবং সেনাবাহিনীপ্রধানের কার্যালয় দাবি করেছে, রাখাইনে এখন আর কোন সেনা অভিযান নেই। গত ৫ সেপ্টেম্বর থেকে সেখানে অভিযান বন্ধ রয়েছে। প্রত্যাহার করে নেয়া সেনা সদস্যরা অবস্থান করবে রাখাইন প্রদেশের রাজধানী সিটওয়েতে (আকিয়াব)। বাবা-মা হারানো অনাথ শিশু ২৩ হাজার সহিংসতার মুখে নাফ নদী পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা ৬ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে রয়েছে অনেক অনাথ শিশু, যারা বাবা-মাকে খুঁজে পাচ্ছে না। শিশুগুলো জানেও না যে, তাদের পিতামাতা বেঁচে আছে কী নেই। এ ধরনের শিশুদের ব্যবস্থাপনায় গ্রহণ করতে হয়েছে বিশেষ কর্মসূচী। এ পর্যন্ত ২৩ হাজার ৪৮৭ জন অনাথ শিশু পাওয়া গেছে। মা-বাবা হারা এ শিশুগুলো রয়েছে পরিচিতদের জিম্মায়। সমাজ সেবা অধিদফতর জানিয়েছে, রোহিঙ্গা শিশুদের মানবিক সহায়তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এছাড়া সকল রোহিঙ্গার স্বাস্থ্যসেবা দিতে কাজ করছে ৩৬টি মেডিকেল টিম। কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে এ সেবা কার্যক্রম চলছে। নিবন্ধন ছাড়িয়েছে ৩ লাখ উখিয়ার কুতুপালং এবং বালুখালির স্থায়ী ও অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বায়োমেট্রিক নিবন্ধনের কাজটি এগিয়ে চলেছে সুশৃঙ্খলভাবে। শুরুর দিকে সেই ধীরগতি এখন আর নেই। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পাসপোর্ট অধিদফতরের কর্মচারীরা এ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মোট নিবন্ধিত হয়েছে ৩ লাখ ৩ হাজার ৩১৬ রোহিঙ্গা। মোট সাতটি ক্যাম্পে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে এ নিবন্ধন চলছে। প্রথমদিকে অনেকের অনীহা থাকলেও নিবন্ধন ছাড়া কোন ধরনের সহযোগিতা পাওয়া যাবে না এ বিষয়টি জানিয়ে দেয়ার পর নিবন্ধনে আগ্রহী হয়ে ওঠে তারা। তবে কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা, যারা বাংলাদেশকে অন্যত্র পালিয়ে যাওয়ার ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করতে চায় তারা নিবন্ধিত হতে আগ্রহী নয়। এদের অনেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ধরাও পড়ছে। তাছাড়া রাখাইন প্রদেশে সক্রিয় বিভিন্ন সংগঠনের কোন নেতাকর্মী যদি এই অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে থেকে থাকে তাদেরও নিবন্ধনের আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়তে পারে। উল্লেখ্য, প্রথমে মাত্র ২০ রোহিঙ্গার নিবন্ধন দিয়ে এ কার্যক্রম শুরু হয়েছিল গত ১১ সেপ্টেম্বর। তখন ধারণা করা হয়েছিল যে, এ কার্যক্রম শেষ করতে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে। ইয়াবাসহ দুই রোহিঙ্গা আটক কক্সবাজার জেলার চকরিয়া হারবাং মেম্বার বাড়িরঘাটা এলাকায় চট্টগ্রামমুখী সৌদিয়া পরিবহনের একটি বাসে তল্লাশি চালিয়ে ১ হাজার ৩৫০ পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ ২ রোহিঙ্গাকে আটক করেছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার রাতে চিরিঙ্গা হাইওয়ে পুলিশ তাদের আটক করে। ধৃত এই দুই রোহিঙ্গা যুবকের নাম আকতার কামাল ও মোঃ জুবাইর। তারা উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা। রাখাইনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে শুরু করেছে মিয়ানমার সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা ‘মিয়ানমার টাইমস’ জানিয়েছে, রাখাইন প্রদেশে বন্ধ হওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলতে শুরু করেছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে উত্তর রাখাইনের মংডু, রাচিদং ও বুচিদংয়ে ৪২৬ স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫০টিরও বেশি স্কুল খুলেছে। বাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও পর্যায়ক্রমে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকাটি আরও জানিয়েছে, রাখাইন প্রদেশের সিটওয়ে টাক্কা পিইন এলাকায় মুসলিম শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নতুন ডিপার্টমেন্ট চালু করেছে সে দেশের উচ্চশিক্ষা বিভাগ। সিটওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত এ বিভাগে ভর্তি হতে পারবে মুসলিম শিক্ষার্থীরা। দেশটিতে এ ধরনের ব্যবস্থা এটাই প্রথম। মুসলিম শিক্ষার্থীদের মিয়ানমারের শিক্ষা, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করতেই এ উদ্যোগ বলে জানিয়েছেন সে দেশের ডিপার্টমেন্ট ফর হায়ার এডুকেশনের মহাসচিব ইউ থেইন উইন। সেখানে ট্রান্সপোর্টেশন এবং আবাসন সুবিধাও থাকবে ছাত্রদের জন্য। রোহিঙ্গা নেতাদের অভিমত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে বহু রোহিঙ্গার আগ্রহ আছে বলে জানিয়েছেন একাধিক রোহিঙ্গা নেতা। শুধু মিয়ানমারের নেত্রী আউং সান সুচির দেয়া আশ্বাসের দ্রুত বাস্তবায়ন দরকার। দেরি হলে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশই রাখাইনে ফিরে যেতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে। কারণ, টেকনাফ এবং উখিয়া ক্যাম্পে থাকতে থাকতে একপর্যায়ে এরা এখানকার পরিবেশ এবং প্রতিবেশীর সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে ফেলবে। মন-মানসিকতাও একপর্যায়ে ঘুরে যেতে পারে। তাছাড়া এখানে বিভিন্ন মতের অনেকেই সক্রিয় রয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফুসলিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও রয়েছে। এ জন্য যত দ্রুত সম্ভব কোফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা জরুরী। তারা বলেছেন, রাখাইনে অনেকের নিজস্ব জায়গা জমি আছে। কারও কারও বড় বড় ব্যবসা আছে। কিন্তু দেশটিতে তাদের নাগরিক এবং সমান অধিকার মর্যাদা নেই। নিগৃহীত রোহিঙ্গারা রাষ্ট্রক্ষমতার ভাগ চায় না। শুধু নাগরিক অধিকার এবং শান্তিতে বসবাসের নিশ্চয়তা চায়।
×