ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংস্কৃতি সংবাদ

আনিসুজ্জামানের জন্মদিনে অনুরাগীদের ভালবাসার অর্ঘ্য

প্রকাশিত: ০৪:৪১, ২৮ অক্টোবর ২০১৭

আনিসুজ্জামানের জন্মদিনে অনুরাগীদের ভালবাসার অর্ঘ্য

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সময়ের এক অগ্রসর মানুষ অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। বাঙালী মনীষার অন্যতম প্রতিনিধি। দেশে যখন মুক্তচিন্তার চর্চা সঙ্কটময় হয়েছে আবির্ভূত হযেছেন আলোর দিশারী হিসেবে। ছড়িয়েছেন শিক্ষার আলোকবর্তিকা। দেশের ক্রান্তিলগ্নে প্রতিটি সাংস্কৃতিক-সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে রেখেছেন তেজস্বী ভূমিকা। আপন ভাবনার প্রকাশ লিখেছেন অজ প্রবন্ধ ও নিবন্ধ। লিখেছেন সমাজ, সংস্কৃতিসহ বিচিত্র বিষয়ে তাঁর গবেষণাধর্মী কাজগুলো হয়ে আছে কালের সাক্ষী। আলোকিত এই মানুষটির আশিতম জন্মদিন অতিবাহিত হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৮ তারিখ। অসুস্থতার কারণে সে সময় ছিল না কোন আয়োজন। সেই সুবাদে জন্মদিনটি উদ্্যাপিত হলো শুক্রবার। সে আয়োজনে ফুলেল ভালবাসায় সিক্ত হলেন কীর্তিমান এই মানুষটি। তার বর্ণিল জীবনের কথা উচ্চারিত হলো বিশিষ্টজনদের কথনে। কামনা করা হলো তাঁর শতবর্ষী জীবনের। শিল্পীর গানের সুুরে জানানো হলো জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি। এভাবেই প্রিয়জন, শুভাকাক্সক্ষী ও অনুরাগীদের হৃদয়ের গভীর মমতায় উদ্যাপিত হলো বরেণ্য এই ব্যক্তিত্বের ধরণীতে আগনের শুভ দিনটি। শুক্রবার হেমন্ত সন্ধ্যায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে প্রকাশনা সংস্থা চন্দ্রাবতী একাডেমি। আয়োজনের শুরুতেই সুরের ধারার শিশু শিল্পীদের কণ্ঠে ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ শিরোনামে মাঙ্গলিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে পুষ্পবৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে মিলনায়তনে প্রবেশ করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান অশীতিবর্ষপূর্তি উদ্্যাপন শিরোনামে এ আয়োজনে প্রধান অতিথি ছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আনিসুজ্জামান সম্পর্কে নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালব শামসুজ্জামান খান, নারীনেত্রী অধ্যাপক মালেকা বেগম, মানবাধিকারকর্মী এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল, কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মফিদুল হক, কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, এবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক গোলাম মুস্তাফা। সভাপতিত্ব করেন আনিসুজ্জামান অশীতিবর্ষপূর্তি উদ্্যাপন কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন আনিসুজ্জামানের সহধর্মিণী সিদ্দিকা জামান। শংসাবচন পাঠ করেন সাংবাদিক জাহীদ রেজা নূর। অনুষ্ঠানে আনিসুজ্জামানের প্রিয় গানগুলো গেয়ে শোনান শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও অদিতি মহসিন। অনুষ্ঠানে চন্দ্রাবতী একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘আনিসুজ্জামান সম্মাননা গ্রন্থ’র মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সকলের ভালবাসায় সিক্ত আনিসুজ্জামান রসিকতার ছলে অনুভূতি ব্যক্ত করেন। বললেন, এই ফেব্রুয়ারি মাসে আমার জীবনের ৮০ বছর পূর্ণ হলো। এতদিনে নিজেকে বিজ্ঞ বলে দাবি করার উপযুক্ত মনে হলো। পত্রিকায় পড়ি ৭০ বছর বয়স্ক মানুষের মৃত্যুসংবাদ। সেখানে লেখা থাকে বার্ধক্যগত কারণে মৃত্যু হয়েছে। ৮০ বছর পেরিয়ে যাওয়া আমার ক্ষেত্রে কি বলা হবে? অধিক বার্ধক্যজনিত কারণে? আশি পেরুলেও জীবনতৃঞ্চায় আমি এখনও তরুণ। তবে আধুনিক প্রযুক্তির মুখোমুখি হলে নিজেকে মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য মনে হয়! আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, আনিসুজ্জামান আমার রেফারেন্স বুক। লেখালেখি বা বক্তৃত্বার ক্ষেত্রে শব্দ চয়নের বিষয়ে আমি তার উপদেশ নেই। এভাবেই গত ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে সে আমার এনসাইক্লোপিডিয়া হিসেবে সহায়তা করছে। এ দেশের, এ সমাজের বাতিঘর তিনি। অন্যায়ের প্রতিবাদে আনিসুজ্জামান দুঃসাহসী। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদ্্যাপন থেকে শুরু সব আন্দোলনেই আমরা তার সে পরিচয় পায়। বাংলাদেশ, সাহিত্য, ঐতিহ্য, কৃষ্টিতে তার নাম দিয়ে গর্ববোধ করতে পারি। এ জন্য আমরা তৃপ্তি বোধ করতে পারি, আনিস আমাদের প্রতিনিধি। সেলিনা হোসেন বলেন, সরাসরি শিক্ষক না হয়েও, আমার জীবনের ও মানবিক চেতনাবোধের শিক্ষক তিনি। সময়ের আধুনিক মানুষ তিনি। সব সময় হেঁটেছেন শুভ ও কল্যাণের পথে। শামসুজ্জামান খান বলেন, পা-িত্যের বিভা থেকে সাধারণ মানুষের পর্যায়ে নেমে এসেছেন, এখানেই তার স্বতন্ত্রতা। এ কালের শ্রেষ্ঠ মনীষী তিনি। উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম বিদ্বান তুমি। দেশের গ-ি পেরিয়ে হয়ে উঠেছেন আন্তর্জাতিক মানের বুদ্ধিজীবী। এ কালে তিনি জাতির বিবেক, পথপ্রদর্শক। সুলতানা কামাল বলেন, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের কারণে আনিসুজ্জামান সব মানুষের ভরসার স্থলে পরিণত হয়েছেন। তিনি সবার কাছের ও শ্রদ্ধার মানুষ। মফিদুল হক বলেন, তার সান্নিধ্যটা মননের ভিন্নরকম অনুভূতি সঞ্চার করে। তার কাছে গেলেই যেন মনের গ্লানি কিংবা লাঞ্ছনাগুলো মুছে যায়। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে সমাজটা যে এগিয়ে যাচ্ছে তারই সাক্ষী আনিসুজ্জামান। ভাষা আন্দোলনকে শিল্প-সাহিত্যে যারা উন্মোচিত করেছেন তাদেরই একজন তিনি। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ নিয়ে অসাধারণ কাজ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তাঁর লেখায় রয়েছে চিন্তার গভীরতা, ভাষার ধৃষ্টতা। মননশীল লেখাকেই তিনি পরিণত করেছেন সৃজনশীল রচনায়। খুব সহজেই বলে ফেলেন কঠিন কথাটি। তিনি যখন কথা বলেন সেখানেও থাকে সৃজনশীলতা। চমৎকারভাবে কথা সাজানো দক্ষতা রয়েছে তার। গোলাম মুস্তাফা বলেন, বাঙালী মুসলমানের মনোজগত আমাদের কাছে অনেকটা অজানা ছিল। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বাঙালী মুসলমানের সেই মনোজগত উন্মোচিত করেছেন। মুসলমানের দ্বিধা-সঙ্কটসহ নানা বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন। মানুষের অগ্রগতির সঙ্গে ঐতিহ্যের সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেছেন। অনুষ্ঠানে অধ্যাপক আনিসুজ্জামানকে ফুলেল ভালবাসা নিবেদন করেন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য ড. সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, জাতীয় কবিতা পরিষদের সভাপতি মুহাম্মদ সামাদ ও সাধারণ সম্পাদক তারিক সুজাত, রবীন্দ্র বিশ^বিদ্যলয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ^জিৎ ঘোষ, বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের, জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সভাপতি মাজহারুল ইসলাম প্রমুখ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ফুলেল ভালবাসা জানায় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ, সময় প্রকাশন, রকমারি ডটকম, জার্নিম্যান বুকস, প্রতিভা প্রকাশ, বাঙালী প্রকাশ ও স্বনন। জাদুঘরে হামিদুজ্জামান খানের শিল্পকর্ম প্রদর্শনী ॥ দেশের অন্যতম প্রধান ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান। জলরঙ, তৈলচিত্রের পাশাপাশি নিয়মিত ভাস্কর্যশিল্পের চর্চা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের অনারারি এই অধ্যাপকের পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে শিল্পচর্চা করছেন। শিল্পীর সারা জীবনের নির্বাচিত সেরা শিল্পকর্ম নিয়ে জাতীয় জাদুঘরে শুরু হয়েছে তাঁর একক শিল্পকর্ম প্রদর্শনী। ১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত গত ৫৩ বছরে নানা মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অসংখ্য শিল্পকর্ম নির্মাণ করেছেন তিনি। তার মধ্যে বাছাই করা কাজ নিয়ে ‘হামিদুজ্জামান খান রেট্রোস্পেকটিভ’ শিরোনামে আয়োজিত হয়েছে এ প্রদর্শনী। ভিন্নধর্মী এ প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে শিল্পীর বিভিন্ন সময়ে গড়া প্রায় তিন শতাধিক ভাস্কর্য ও ২৫টি চিত্রকর্ম। শুক্রবার বিকেলে জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে এ প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন শিল্পসমালোচক ও লেখক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর। শিল্পী হাশেম খানের সভাপতিত্বে এ সময় উপস্থিত ছিলেন গবেষক ও লেখক মফিদুল হক, সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহম্মদ আজিজ খান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী। সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষে জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী মিলনায়তনে উদ্বোধন করা হয় শিল্পী হামিদুজ্জামান খানের এ প্রদর্শনী। গোটা মিলনায়তনে থরে থরে সাজানো তাঁর নানামাত্রিক শিল্পকর্ম। কোথাও ভাস্কর্য, কোথাও চিত্রকর্ম। ভাস্কর্য ও চিত্রকর্মের যেন এক অনবদ্য যুগলবন্দী। উদীচীর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালা ॥ সাংস্কৃতিক সংগ্রামের খর¯্রােতা পথ বেয়ে ২৯ অক্টোবর প্রতিষ্ঠার ৫০ বছরে পদার্পণ করছে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠনটির ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী এবং ৫০তম বছরে পদার্পণ উপলক্ষে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালা নিয়েছে উদীচী। ‘চলছি তো অবিরাম মুক্তির মিছিলে, লড়ছি তো মুক্তির শপথে’ প্রতিপাদ্যে এ আয়োজনের উদ্বোধন হবে কাল রবিবার। ওই দিন বিকেলে রাজধানীর সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান স্মৃতি মিলনায়তনে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। শুক্রবার রাজধানীর তোপখানার উদীচী কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। উদীচী কেন্দ্রীয় সংসদের সভাপতি অধ্যাপক ড. সফিউদ্দিন আহমদের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক জামসেদ আনোয়ার তপন। তিন গুণীজনকে গীতাঞ্জলি পদক প্রদান ॥ প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর পূর্ণ করল সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র গীতাঞ্জলি ললিতকলা একাডেমি। সংগঠনের ত্রয়োদশ বর্ষপূর্তিতে উত্তরার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প ইনস্টিটিউট অডিটরিয়ামে তিন দিনের দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক উৎসবের সূচনা হয় শুক্রবার। ‘শান্তির জয় হোক, সাম্যের জয় হোক, সত্যের জয় হোক’ স্লোগানে এদিন সন্ধ্যায় উৎসব উদ্বোধন করেন পররাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দীপু মনি। এ বছর শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গীতাঞ্জলি ললিতকলা একাডেমির গীতাঞ্জলি পদক পেয়েছেন তিন গুণীজন। তারা হলেনÑ চিত্রশিল্পী সমরজিৎ রায় চৌধুরী, কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তাদের হাতে এ পদক তুলে দেয়া হয়।
×